ছাউনিতে আমার পাশে এসে বসে ভিচিনা, মেয়েটির এক মাথা কালো চুল। বয়স মধ্যবিশের কোঠায়।
আচ্ছা, এতো শতো ভাবাভাবিতে না গিয়ে সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। বেশ সপ্রতিভভাবে মেয়েটি জবাব দিলো, আমি মেসিডোনিয়ার আলবেনিয়ান, কিন্তু এখন থাকি অস্ট্রিয়ার সলজবুর্গ শহরের কাছে আরেকটি ছোট্ট শহরে। আরে তাই নাকি? আমি তো এই দু’সপ্তাহ আগেই তোমাদের ও শহর থেকে ঘুরে এলাম, ভারি সুন্দর শহর সলজবুর্গ।
ভিচিনার সাথে গল্প জমে ওঠে। জানতে পারি মেয়েটি প্রিস্টিনা যাচ্ছে ওর আলবেনিয়ান ছেলে-বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। সেই ছেলেটির সঙ্গে ওর অস্ট্রিয়াতেই পরিচয়, এই গ্রীষ্মে ছেলেটি কসোভোতে এসেছে ওর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। আর ভিচিনা এসেছিল মেসিডোনিয়ায় ওর অন্য আত্মীয়দের দেখা করতে। এই ফাঁকে বন্ধুটি ওকে কসোভোতে আমন্ত্রণ জানায় নিজ পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে। ভিচিনা যেহেতু আলবেনিয়ান পরিবারের মেয়ে তাই ওর কাছে আমি বেশ কিছু কথা জানতে চাই, যে প্রশ্নগুলো মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিল মেসিডোনিয়ায় আসবার পর থেকেই।
তবে সে কথায় যাওয়ার আগে অন্য একটি কথা উল্লেখ করে নেই। ভিচিনা কিন্তু নিজেকে উল্লেখ করেছিলো মেসিডোনিয়ায় বসবাসকারী আলবেনিয়ান হিসেবে। আরও জনাকয়েক আলবেনিয়ানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিলো, আশ্চর্যজনকভাবে তারাও প্রত্যেকে নিজেকে উল্লেখ করেছে মেসিডোনিয়ায় বসবাসকারী আলবেনিয়ান হিসেবে। আর এখানেই আমার খটকা। কারণ, একটি দেশে যখন অন্যস্থান বা অন্যদেশের মানুষ এসে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে বা তাদের পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম সেই নতুন দেশের আলো-হাওয়ায় বেড়ে ওঠে, তখন তো সে নিজেকে সেই দেশের একজন বলেই মনে করে, পূর্ব জাতিসত্তা তার কাছে হয়ে পড়ে গৌণ।
যেমন বিলেতে বসবাসকারী দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের কোনো বাংলাদেশি হয়তো নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেবেন ব্রিটিশ হিসেবে, তারপর হয়তো বলবেন বাংলাদেশি মূলের কথা, এক্ষেত্রে ব্রিটিশ জাতিসত্তাটাই তার কাছে মুখ্য। একইভাবে আমেরিকায় বসবাসকারী কৃষ্ণাঙ্গরা পরিচিত 'আফ্রিকান আমেরিকান' হিসেবে। তারা কিন্তু বলছে না আমরা 'আমেরিকায় বসবাসকারী আফ্রিকান'। 'আফ্রিকান আমেরিকান' আর 'আমেরিকায় বসবাসকারী আফ্রিকান' এই দু'টোর মধ্যে কিন্তু বেশ দূরত্ব আছে। অথচ মেসিডোনিয়ার আলবেনিয়ানরা নিজেদের 'মেসিডোনিয়ান আলবেনিয়ান' না বলে উল্লেখ করছে 'মেসিডোনিয়ায় বসবাসকারী আলবেনিয়ান' হিসেবে।
ভিচিনার কাছে আমার মূল প্রশ্ন ছিল এ ব্যাপারটি নিয়েই। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পেলাম না। তবে জানলাম আলবেনিয়ান মুসলিম ও মেসিডোনিয়ান অর্থোডক্স খ্রিস্টান- এই দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমন একটা ভাব-ভালোবাসা নেই। এমনকি আলবেনীয়রা যায় ভিন্ন স্কুলে এবং কথাও বলে তাদের আলবেনীয় ভাষায়। যদিও সরকারি কাজকর্ম ও উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে তাদের মেসিডোনিয়ান ভাষাও শিখতে হয় বটে।
ওদের আরও অভিযোগ হলো সরকারি পদ ও রাজনৈতিক অবস্থানগুলোতে মেসিডোনিয়ানদের নাকি একচ্ছত্র আধিপত্য। যদিও এ নিয়ে আবার মেসিডোনিয়ানদের দিক থেকেও পাল্টা যুক্তি আছে। তাদের কথা হলো আলবেনীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মূল জনগোষ্ঠীর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, আর সরকারি পদেও তাদের উপস্থিতি ২৫ শতাংশের মতো, তাহলে এ ক্ষেত্রে বঞ্চনার প্রসঙ্গটি আসছে কীভাবে?
মেসিডোনিয়ান আলবেনিয়ানদের নিয়ে আরেকটি তব্দা খাবার মতো ব্যাপার আমি লক্ষ্য করেছি। স্কপিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে যাচ্ছি, আলবেনিয়ান কিছু গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করি গ্রামের বাড়িগুলোতে পতপত করে উড়ছে আলবেনিয়ান পতাকা। এমনকি এক আলবেনিয়ান বিয়ের বরযাত্রীর গাড়িবহর আমার বাস অতিক্রম করার সময় দেখি গাড়িগুলোর দু’পাশে উড়ছে ওই আলবেনিয়ান পতাকা।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মধ্যে কীভাবে আরেকটি দেশের পতাকা সোল্লাসে ওড়ানো হয় সেটি আমার বোধগম্য হয় না। এই পতাকা ওড়াবার ব্যাপারটি কয়েকজন মেসিডোনিয়ানকে জিজ্ঞেস করলে তারা কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে ২০০১ সালে আলবেনিয়ানদের সঙ্গে সংঘাত ও তদপরবর্তী সময়ে অখ্রিদ শহরে সম্পাদিত চুক্তির কথা তোলে।
কী হয়েছিলো সে সময়ে আর কিই-বা ছিল সেই চুক্তিতে, সে নিয়ে কিছু কথা বলি।
চলবে....
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-১)
**কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-২)
**কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৩)
** কসোভোর অন্ধ বাঁশিওয়ালা (পর্ব-৪)
বাংলাদেশ সময়:০২৩৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭
এএ