ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

এক টাকায় আহার

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫২ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৬
এক টাকায় আহার

চট্টগ্রাম: ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন চত্বর-ই হোক বা মুরাদপুরের বাসস্ট্যান্ড, চলতে-ফিরতে এক দল শিশুর দেখা মিলবেই। পথচারীদের কাছে কখনও খাবার, কখনও বা খাবার কেনার জন্য টাকার আকুতি নিয়ে হাজির হয় তারা।

 কেউবা আবার খাবারের দোকানগুলোর আশপাশে তীর্থের কাকের মতো ঘুর ঘুর করতে থাকে এই আশায়-কখন দোকানি হাতে তুলে দিবে বাতিল খাবার।

সামাজিক পরিচয়ে তারা পথশিশু। বস্তি কিংবা রেলস্টেশনই তাদের ঘর। সেখানেই তাদের বেড়ে উঠা।

আবার একই পথগুলোতে দেখা মেলবে কিছু ভিক্ষুকেরও। তাদেরও আবদার, খাবার কিংবা খাবার কেনার জন্য টাকা।

আগে সহজেই এখানে-ওখানে খাবার মিলতো, এখন বেড়েছে পথশিশু-ভিক্ষুক। তাই নষ্ট খাবারে ভাগ বসানোর প্রতিযোগিতাটাও কোন অংশেই ১০০ মিটার দৌঁড় প্রতিযোগিতার চেয়েও কম হয় না ইদানিং।

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের এই কষ্টগুলো ভাবিয়েছে ক্ষুধার মাঝে বেড়ে উঠা এক মানুষকে। তিনি কিশোর। বঞ্চিত শিশুদের আনন্দময় উপলক্ষের ঠিকানা ‘বিদ্যানন্দ’ নামের সংগঠনটির স্বপ্নপুরুষ। বিদ্যানন্দকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। বহু বছর ধরে পথশিশুদের প্রাণ এই প্রতিষ্ঠানটি।

মূলত কিশোরের উদ্যোগেই এক টাকার বিনিময়ে পথশিশু-ভিক্ষুকদের হাতে একবেলা খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে চলতি বছরের ১৫ মে থেকে। তিনি এই প্রজেক্টটির নাম দিয়েছেন ‘এক টাকায় আহার’।

কিশোরের স্বপ্ন ধরে ১৫ মে চট্টগ্রামের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনে ‘এক টাকায় আহার’ নামের প্রজেক্টির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে। এখন আপাতত চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ আর রামু-এ চারটি শাখায় পথশিশু ও ভিক্ষুকদের এক টাকার বিনিময়ে দুপুরের খাবার দিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি।

খাবার কেনার টাকার অংকটা ছোট হতে পারে, এক টাকার বিনিময়ে খাবার পাওয়ার আকাঙ্খা করাটাও এই দুমূল্যের বাজারে হাসিঠাট্টা যোগাতে পারে নিশ্চিত।  কিন্তু এই প্রতীকি এক টাকার খুব বড় একটা মাহাত্ম্য আছে।

আয়োজকরা বিশ্বাস করেন, টাকার মানটা যতই ক্ষুদ্র হোক ক্রেতারা যাতে বুক ফুলিয়ে বলতে পারে ‘‘ফ্রি তে খাবার নিইনি, টাকা দিয়ে কিনেছি খাবার। ’’ এজন্যই খাবারের এ দাম বসিয়ে দেওয়া, যাতে ক্রেতাদের মধ্যে ‘ভিক্ষা’ এবং দাতাদের মধ্যে ‘দান’ শব্দটির অনুভূতি আর না থাকে।

প্রজেক্টের উদ্যোক্তা কিশোর সূদূর পেরুপ্রবাসী। তাই তিনি স্বপ্নদ্রষ্টা হলেও মূলত যাবতীয় কাজগুলো সম্পাদন করেন পুরো দেশে ছড়িয়ে থাকা বিদ্যানন্দের কয়েক’শ স্বেচ্ছাসেবক। তাদের মধ্যে গুটি কয়েকজন কর্মকর্তা নামমাত্র টাকায় চাকরি করলেও ৯৯ শতাংশই স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে যাচ্ছেন।

ফেসবুকে যোগাযোগ করা হলে পেরু থেকে ফোন দেন কিশোর। সরাসরি তার মুখ থেকেই শোনা হলো এই প্রজেক্টের সবকিছু।

কিশোর বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রতিদিন ৩০০ জনের রান্নার লক্ষ্য নিয়ে আমরা এই প্রজেক্টের যাত্রা শুরু করি। তবে প্রয়োজনীয় অনুদানের অভাবে প্রতিদিন চাহিদামতো প্যাকেট তৈরি করা হয়ে উঠে না সবসময়। খাবারগুলো তৈরি হয় ভাড়া করা রান্নাঘরে। রাঁধুনিরা তৈরি করেন সেই খাবার। পরে সে খাবার সব ঠিক আছে কিনা যাচাই করেন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা। এরপর তারা দুপুর দেড়টার আগেই ভ্যানে কিংবা রিকশা করে খাবার নিয়ে চলে যান নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এক টাকার বিনিময়ে যে কোন পথশিশু কিংবা বৃদ্ধ কিনে নিতে পারে এই খাবার।  ভাত-ডাল-সবজিতে ঠাসা থাকে এক একটি বক্স। ’

তিনি বলেন, ‘এই প্রজেক্টটি পরিচালিত হয় কিছু প্রবাসী এবং প্রতিষ্ঠিত চাকুরে দ্বারা। কিছু প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে এসেছে এর মধ্যে। আর এটি কার্যকর করে স্বেচ্ছাসেবক আর কর্মকর্তারা। আমি শুধু উদ্যোগটা নিয়েছি এই যা। ’

ফেসবুকে এ বিষয়ে ‘এক টাকায় আহার’ শীর্ষক একটি পেজ খুলেছে উদ্যোক্তারা। সেখানে প্রতিদিন কয়জনের কাছে খাবার দেওয়া হলো, কোনা শাখায় কত প্যাকেট খাবার দেওয়া হলো তাও স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়।

ওই পেজে দেখা গেছে, ৯ জুলাই পর্যন্ত মোট ৩৭ হাজার ৭৬৯ প্যাকেট খাবার তারা পথশিশু ও ভিক্ষুকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এর মধ্যে চলতি মাসের ৯ দিনে ৬ হাজার ৪৬৩ প্যাকেট খাবার তৈরি হয়েছে। আবার রমজান মাসের দিনগুলোতে কয়েক হাজার মানুষের মাঝে ইফতার আর সেহেরির খাবারের প্যাকেট বিলি করা হয়েছে একেবারে ফ্রিতেই।

তবে প্রথমদিকে সব শাখায় একযোগে খাবারের প্যাকেট বিলি করা হলেও এখন প্রতিদিন সব শাখায় খাবার প্যাকেট বিলি করা সম্ভব হয়ে উঠে না যথেষ্ট অনুদানের অভাবে।

কিশোর জানান, মাসিক ৫০০ টাকা দিয়ে যে কেউ নিতে পারেন একজন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের খাবারের দায়িত্ব, কিংবা কিনে দিতে পারেন চাল-ডাল-আলু-তেল, স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পারেন খাবার বিতরণে। যে কোন সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে পেজের ইনবক্সে এসএমএস করা হলে জবাব দেওয়া হবে।

প্রতিবেদনের একেবারে শেষের দিকে এসে এই ‘এক টাকায় আহার’ প্যাকেজের সৃষ্টির কারণটা তুলে দেওয়া যাক।

আজ থেকে ২০ বছর আগের নগরীর কালুরঘাট এলাকা। সেখানে চলছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে মানুষদের জন্য খাবারের আয়োজন। তখন বছর ১৪’র এক অভাবী শিশু অন্যদের মতো লাইনে দাঁড়িয়েছিল এক প্লেট খাবারের আশায়। কিন্তু সেখানে অসংখ্য ভুভুক্ষু মানুষের ভিড় ঠেলে এক প্লেট খাবার উদ্ধার করা যেনো অ্যাভারেস্টে ওঠার মতোই দুঃসাধ্য ব্যাপার ! সেই শিশু মন তখনই সিদ্ধান্ত নেয় একদিন এমন কিছু করবে যাতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা খাবারের জন্য কোনো কষ্ট না পায়।

সে দিনের সেই শিশুই আজকের কিশোর। প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভুলেননি সেদিনের কথা। তাই সূদূর পেরুতে বসেও নিত্য ভেবে চলেছেন দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কথা।

প্রজেক্টের বিষয়ে কোনো কৃতিত্ব নিতে নারাজ কিশোর। এমনকি নিজের নামটা গণমাধ্যমে প্রকাশেও যথেষ্ট অনীহা তার। কিশোরের বক্তব্য ‘আমি নিজের জন্য করছি না, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষরা আমার কারণে ভালো থাকুক, তাতেই আমি খুশি। ’

প্রচারের প্রাদপ্রদীপে থাকার এই যুগে এত এত ভালো কাজ করার পরও নিজেকে সেই ছোঁয়া থেকে গুটিয়ে রেখে কেবল কাজ করে যাওয়ার সংজ্ঞাটাই তাই ‘কিশোর। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫১ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৬

টিএইচ/আইএসএ/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

চট্টগ্রাম প্রতিদিন এর সর্বশেষ