সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: বাংলাদেশের জাহাজভাঙা বা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড নিয়ে পরিবেশের ক্ষতি, শ্রমিকদের অকালমৃত্যু বা পঙ্গুত্ববরণ এমন নেতিবাচক ধারণা ছিল বহির্বিশ্বে। ইয়ার্ডের মালিকরা বলছেন, এ ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরির পেছনে কাজ করেছে কিছু এনজিও সংগঠন।
তবে সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিপইয়ার্ড নির্মাণ করে এসব ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড।
২০০৯ সালের চীনে অনুষ্ঠিত হংকং কনভেশন রুলস অনুযায়ী আমূল ঢেলে সাজানো হচ্ছে এ শিপ ইয়ার্ড। যদিও দেশে এখনো অন্য কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ড এ ধরনের উদ্যোগ নেয়নি।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সব শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেশন রুলস অনুযায়ী নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় বিদেশিরা স্ক্র্যাপ জাহাজ বিক্রি করবে না। ২০১৭ সালে একটি আধুনিক ও গ্রিন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে পিএইচপি। কাজ শেষ হলেই সার্টিফিকেশনের জন্য আবেদন করা হবে। হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেট পেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং এ শিল্প দ্রুত এগিয়ে যাবে।
পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিগত ১০ বছরে শিপ ব্রেকিং শিল্পে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যা চোখে পড়ার মতো।
রানা প্লাজা ধসের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, রানা প্লাজার ঘটনার পর পোশাক শিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খায়। পরে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স’র নির্দেশনা মানতে বাধ্য হয়েছে। যারা কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে পারেনি তারা অর্ডার পাচ্ছে না।
‘এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটার আগেই হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেশন অনুযায়ী ইয়ার্ড ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু করি। কারণ আমি চাই আমাদের এই ইয়ার্ড বাংলাদেশের রোল মডেল হোক। তাই ২৫ কোটি টাকা খরচ করে আধুনিক ইয়ার্ড নির্মাণ করেছি। ’
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কথার সত্যতা মিলল সীতাকুণ্ড থানার শীতলপুর এলাকায় অবস্থিত পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে। সোমবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে দেখা গেছে ইয়ার্ডের মূল গেটের সামনে সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে শিশু শ্রমিক নিষিদ্ধ। তার পাশেই রয়েছে কারখানা পরিদর্শকের ঠিকানা।
প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা জানান, শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা না পেলে যাতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন সেজন্য ফোন নাম্বার সম্বলিত অফিসের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে।
প্রায় ২১ একর জায়গায় গড়ে ওঠা পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডে ঢুকতেই দেখা গেল সবুজ রঙের একটি অ্যাংকর। পাশেই রয়েছে নির্মাণাধীন ইয়ার্ডের নকশা। ইয়ার্ডের বড় একটি অংশ আরসিসি ঢালাই করা। মূল ফটকের দক্ষিণ পাশে তিনতলা প্রশাসনিক ভবন। তার উত্তর পাশে দোতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় শ্রমিকদের ডরমেটরি ও ডাইনিং। দক্ষিণ পাশে আরেকটি দোতলা ভবনে রয়েছে ১৫০ জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডরমেটরি, রান্না ও খাবার ঘর।
প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) নুর মোহাম্মদ ফারুক বাংলানিউজকে জানান, আরএম শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে ১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু হয় ইয়ার্ডটির। যা ২০০০ সালে পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে রূপান্তর হয়। এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতিবাচক প্রচারণার কারণে হুমকির মুখে পড়া শিপব্রেকিং শিল্পে এখন বিরাট পরিবর্তন এসেছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের যেসব দেশে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে সেখানেই দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আমাদের দেশের এই শিল্পের নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরেছিল এনজিওগুলো। এতে পুরো বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে।
ইয়ার্ডে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে বিগত কয়েক দশকে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯৪ সাল থেকে ম্যাগনেটিক ক্রেন ব্যবহার হচ্ছে। এতে দ্রুত কাজ হচ্ছে।
একসঙ্গে পাঁচটি জাহাজ কাটার সক্ষমতা থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে আইএসও ৯০০১, এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে আইএসও ১৪০০১, হেলথ সেফটি অ্যাসেসমেন্ট সিরিজে আইএসও ১৮০০১ এবং শিপ রিসাইক্লিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আইএসও ৩০০০০ সনদ লাভ করেছে।
১৯৮৫ সালে ‘ট্রেড ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ নামের ২২ হাজার টনের একটি বড় জাহাজ কাটা হয় বলে বাইশহাজারি ইয়ার্ড নামে পরিচিতি লাভ করে এই ইয়ার্ড। ২০০৩ সালে বিশ্বের চতুর্থতম বৃহৎ জাহাজ ‘এমটি আর্কটিক ব্লু’ কেটে ইতিহাস সৃষ্টি করে। ইয়ার্ডে পর্যন্ত ১৩৬টি জাহাজ কাটা হয়েছে।
** টাওয়ার ক্রেন বসিয়ে ইতিহাস গড়ল পিএইচপি শিপইয়ার্ড
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
এমইউ/টিসি