সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: পরিবেশ ও মাটির ক্ষতি রোধে পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক টাওয়ার ক্রেন। ১৯৯৪ সালে যুক্ত হয়েছে ম্যাগনেটিক ক্রেন।
কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিবেশগত বিষয়, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্র সংযোজন করা হয়েছে। শ্রমিকদের জন্য পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই), প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিতের পাশাপাশি, ক্ষতিকর বর্জ্য সংরক্ষাণাগার, ব্লিজ ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে।
হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেশন (এইচকেসি) বাস্তবায়নের বিষয়টি মাথায় রেখে আগেই থেকেই প্রস্তুত হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে দাবি ওঠা জাহাজভাঙা শিল্পের শীর্ষতম এই প্রতিষ্ঠান। এইচকেসি সনদ পেলে বিশ্বের বড় বড় জাহাজ মালিকরা বাংলাদেশে জাহাজ পাঠাতে দ্বিধা করবে না মনে করছেন প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ।
এরই মধ্যে পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড সংস্কারের বিভিন্ন সংস্থার প্রশংসা কুড়িয়েছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে টাওয়ার ক্রেন নেই। আমরাই প্রথম স্থাপন করেছি।
অত্যাধুনিক এসব যন্ত্র স্থাপনে অনেক টাকা ব্যয় হয়েছে তারপরও করেছি। কারণ হলো-বাংলাদেশের শিপব্রেকিং নিয়ে বিশ্বে যে দুর্নাম আছে তা আমরা ঘুচাতে চাই। এইচকেসি সনদ পেলে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। এতে দেশের পুরো শিপব্রেকিং শিল্প উপকৃত হবে।
তিনি বলেন, আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি তা এখনো কোনো শিপইয়ার্ড শুরু করেনি। কিন্তু আগামীতে করতে হবে। আমরা যেহেতু আগে করেছি তাই এখন অনেক ইয়ার্ডের মালিক দেখতে আসেন। সরকারি দপ্তরে গেলে আমাদের ইয়ার্ড দেখার পরামর্শ দেন।
পিএইপি ফ্যামিলি দেশে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পিএইচপি পরিবার সব প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে চায়। আমাদের লক্ষ্য হলো কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের কারণে যাতে পুরো গ্রুপের দুর্নাম না হয়।
‘পরিবেশ ধ্বংস হোক সেটা যেমন আমরা চাই না তেমনি আমাদের কোনো শ্রমিক আহত হোক সেটাও কামনা করি না। কারণ তারা আমার সহকর্মী। সর্বোপরি এই দেশ আমাদের সবার। আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর দেশ দিয়ে যেতে চাই। ’
অ্যাসবেস্টস হ্যান্ডলিং ফ্যাসিলিটি:
২০০২ সাল থেকে আইএমও রুলস অনুযায়ী যেসব জাহাজ নির্মিত হচ্ছে সেগুলোতে অ্যাসবেস্টস দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এর আগে নির্মিত জাহাজগুলোতে ক্ষতিকর এই বর্জ্য রয়েছে।
জাহাজ কাটার আগে অ্যাসবেস্টস পরিবেশগতভাবে অপসারণ করা না হলে শ্রমিকদের ফুসফুসে ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই খুবই সাবধানতার সঙ্গে এ বর্জ্য জাহাজ থেকে নিয়ে অবমুক্ত করতে হয়। ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য হলেও অ্যাসবেস্টস হ্যান্ডলিং ফ্যাসিলিটি রয়েছে পিএইচপি শিপইয়ার্ডে।
অ্যাসবেস্টস অবমুক্ত করতে তিনজন প্রশিক্ষিত শ্রমিক রয়েছেন। তবে সব জাহাজে এটি পাওয়া যায় না বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জাহাজ কাটার আগে সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অ্যাসবেস্টস শনাক্ত করে স্টিকার লাগিয়ে ওই জায়গায় রেপিং করে দেওয়া হয়। যাতে আশপাশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
এরপর জাহাজ থেকে স্ক্রু এবং নাট খুলে অ্যাসবেস্টস হ্যান্ডলিং ফ্যাসিলিটি নেগেটিভ প্রেসার চেম্বার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন শ্রমিক নির্দিষ্ট পোশাক, উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মাস্ক পরে অ্যাসবেটস অবমুক্ত করে মেটেরিয়ালটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখেন। অবমুক্ত অ্যাসবেস্টস বর্জ্যকে একটি সিমেন্ট পাইপে ঢুকিয়ে মুখ ঢালাই করে দেওয়া হয়। পরে তিন ধাপের ওয়াশিং ফ্যাসিলিটি রুমে প্রথমে কাপড়সহ গোসল, দ্বিতীয়বার কাপড় ছাড়া সর্বশেষ পোশাক ধুয়ে বেরিয়ে আসেন। সব কিছুই সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে পাশের কক্ষ থেকে মনিটর করা হয়। যাতে কোনো সমস্যা হলে দ্রুত সহায়তা করা যায়।
গোসলের সেই পানি একটি ট্যাংকে সংরক্ষণ করা হয় জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা জানান, সেই পানি তিন ধাপে ফিল্টার করে ফেলে দেওয়া হয়।
ক্ষতিকর বর্জ্য সংরক্ষণাগার:
ইয়ার্ডের দক্ষিণ পাশে জাহাজের ক্ষতিকর বর্জ্য সংরক্ষণ করতে আটটি আলাদা কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে প্রথম কক্ষে জাহাজের তৈলাক্ত কাপড় ও বালু জমা করা হয়। দ্বিতীয় কক্ষে সিসাযুক্ত ব্যাটারি, তৃতীয় কক্ষে আবর্জনা থেকে যে বর্জ্য হয় তা, চতুর্থ কক্ষে ইলেকট্রিক ও পিসিবিযুক্ত পদার্থ, পঞ্চম রুমে খালি ও চাপযুক্ত কনটেইনার, ষষ্ঠ কক্ষে ভাঙা লাইট, সপ্তম কক্ষে রং ও প্লাস্টিক বর্জ্য এবং আট নম্বর কক্ষে গ্লাসউল রাখা হয়। এর পাশেই রয়েছে ইনসিনারেটর। এতে নিয়মিত আবর্জনা, তেল মিশ্রিত কাপড়, বালু, উচ্ছিষ্ট খাবার পুড়িয়ে ফেলা হয়। এসব বর্জ্য পোড়ানোর সময় যে ধোঁয়া বের হয় তা এয়ার স্কবারের মাধ্যমে তিন ধাপে পিউরিফাই করা হয়।
এছাড়া ব্লিজ ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট ফ্যাসিলিটি, ইটিপি, সেন্ট্রাল ড্রেনেজ সিস্টেম করা হয়েছে। রয়েছে দুটি রেসকিউ বোট।
একসঙ্গে পাঁচটি জাহাজ কাটার সক্ষমতা থাকা প্রতিষ্ঠানটি কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে আইএসও ৯০০১, এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে আইএসও ১৪০০১, হেলথ সেফটি অ্যাসেসমেন্ট সিরিজে আইএসও ১৮০০১ এবং শিপ রিসাইক্লিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আইএসও ৩০০০০ সনদ লাভ করেছে।
১৯৮৫ সালে ‘ট্রেড ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ নামের ২২ হাজার টনের একটি বড় জাহাজ কাটা হয় বলে বাইশহাজারি ইয়ার্ড নামে পরিচিতি লাভ করে এই ইয়ার্ড। ২০০৩ সালে বিশ্বের চতুর্থতম বৃহৎ জাহাজ ‘এমটি আর্কটিক ব্লু’ কেটে ইতিহাস সৃষ্টি করে। ইয়ার্ডে এ পর্যন্ত ১৩৬টি জাহাজ কাটা হয়েছে।
** টাওয়ার ক্রেন বসিয়ে ইতিহাস গড়ল পিএইচপি শিপইয়ার্ড
** ৩০০ লোকের কাজ করছে একটি ম্যাগনেট ক্রেন
** পিএইচপি শিপ ব্রেকিং: গ্রিন শিপইয়ার্ডের পথিকৃৎ
বাংলাদেশ সময়: ২২০৩ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৬
এমইউ/টিসি