এছাড়া শুঁটকি মাছ উৎপাদন, বিপণনসহ এসব কর্মযজ্ঞে লিপ্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন এলাকার অন্তত কয়েক হাজার মানুষ। সেই সঙ্গে ভোজনরসিকদের কাছে চলনবিলের উৎপাদিত এসব শুঁটকি মাছ এখনও রয়েছে স্বাদে-ঘ্রাণে অতুলনীয়।
অথচ এবার ভরা মৌসুমেও মাছের তীব্র সংকট, সংরক্ষণাগার, প্রক্রিয়াজাতকরণের আধুনিক ব্যবস্থা না থাকা ও বাজারজাতকরণের ভালো ব্যবস্থা না থাকার কারণে চলনবিলের শুঁটকি মাছ উৎপাদনকারীরা রয়েছেন চরম বিপাকে। মাছও নেই, শুঁটকি উৎপাদনও কমে গেছে। তবে যেটুকু উৎপাদিত হচ্ছে, তাতে বাজারজাত করতে সমস্যা হচ্ছে। দামও ঠিকঠাক মতো পাচ্ছেন না তারা। আবার উৎপাদন খরচও উঠছে না।
এ অঞ্চলের শুঁটকি মাছ উৎপাদনকারী ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, তাদের উৎপাদিত শুঁটকি মাছ সংরক্ষণে হিমাগার ও প্রক্রিয়াজাতের আধুনিক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর এ অঞ্চলে কোটি কোটি টাকার শুঁটকি মাছ নষ্ট হয়। কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করে শুধু লবণ মিশিয়ে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি প্রস্তুত করা হয়। তাই এসব শুঁটকি বেশি দিন ঘরে ফেলে রাখাও যায় না। তাই এ অঞ্চলের শুঁটকিশিল্পকে বাঁচাতে হলে হিমাগার তৈরির পাশাপাশি শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে বলে তারা জোর দাবি জানান।
এদিকে শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) সকালে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে সিংড়ার নিংগইন এলাকার শুঁটকিপল্লি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি শুঁটকির চাতাল। চিংড়ি, টেংরা, পুঁটি, খলসে, বাতাসি, চেলা, মলা, টাকি, বাইম, শোল, বোয়াল, গজার, মাগুর, শিং, কৈ মাছ সারি-সারি বাঁশের বাতার চালায় বিছিয়ে রাখা হয়েছে। চালার পাশে বস্তায় বস্তায় ভরা শুঁটকি মাছ। নারী-পুরুষরা চাতালে শুঁটকি পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন।
শেরকোল ইউনিয়নের পুঁটিমারী গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী জহির উদ্দীন জানান, শুঁটকি মাছ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকা কারও মুখে হাসি নেই। পানি শুকিয়ে বিলে এখন শুধু কাদা। মাছ নেই। অল্প কিছু পুঁটি পাওয়া গেলেও, দাম চড়া। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে খলইয়ে কেজি দশেক পুঁটি উঠেছে। লবণ মেখে দুই দিন পর প্রতি কেজি ১০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।
শুঁটকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আনোয়ার হোসেন বাংলানিউজে জানান, এখন চলনবিলে মাছ সংকট। আগে প্রতিটি বিল থেকে দেশি প্রজাতির শোল, টাকি, বোয়াল, টেংরা, পুঁটি, চান্দাসহ বিভিন্ন মাছ সংগ্রহ করা হতো। দিনরাত চাতালে ব্যস্ত থাকতে হতো। কিন্তু এবার মাছ নেই। শুঁটকি উৎপাদন কমে গেছে।
এছাড়া মাছের আকালের কারণে শুঁটকি তৈরিতে দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। মাছ বেশি বা কম হোক শ্রমিকদের নির্ধারিত টাকাই মজুরি দিতে হয়। সব মিলিয়ে শুঁটকি উৎপাদনে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।
চাতাল মালিক নাসির উদ্দীন জানান, কয়েক বছর আগেও শুঁটকির মৌসুমে দিনে অন্তত ৫০ কেজি মাছ কিনতেন। এখন মাছ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ কেজি করে। মাছের অভাবে আগের মতো শুঁটকি তৈরি হচ্ছে না। তার ওপর দামও ভালো নেই। বাজারজাতকরণেও নানা সমস্যা রয়েছে।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে জানান, চলনবিলের সিংড়াসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অন্তত দেড় শতাধিক স্থানে শুঁটকি চাতাল রয়েছে। এসব চাতালে মৌসুম এলেই মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। এখানকার শুঁটকি দেশ ও দেশের বাইরে অন্তত ২৫টি দেশে রপ্তানি করা হয়।
তিনি বলেন, শুধুমাত্র সিংড়া উপজেলার শুঁটকিপল্লীতেই প্রতি মৌসুমে ৩০০ মেট্রিক টন করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকি উৎপাদন হয়। চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রায় ১৫২ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। এখানকার শুঁটকির গুণগত মানও ভালো এবং চাহিদাও রয়েছে। এ শিল্পের বিকাশে প্রক্রিয়াজাত, বাজারজাতকরণে ব্যবস্থাগ্রহণ করা দরকার। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সংসদ সদস্য ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বাংলানিউজকে বলেন, সিংড়ার কৃষি ও মৎস্য সম্পদের সংরক্ষণে ইতোমধ্যে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এতে মাছ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা ও অবকাঠামোগত সুবিধা বিদ্যমান থাকবে। এটি বাস্তবায়িত হলে শুঁটকিসহ মৎস্যকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বিপ্লব সূচিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৯
এসএইচ