ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিনোদন

বাংলানিউজ আর্কাইভ থেকে

‘কোথাও কলঙ্ক লাগতে দেইনি’

সোমেশ্বর অলি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২২ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৭
‘কোথাও কলঙ্ক লাগতে দেইনি’ ছবি: বাংলানিউজ

নয় নম্বর প্রশ্নটি করার সময় নায়করাজ উচ্চারণ করলেন, ‘না বাবা, আর প্রশ্ন নয়, বেশি কথা বলা ডাক্তারের বারণ আছে।’ বললেও, শেষ প্রশ্নের উত্তর তিনি ঠিকই দিয়েছেন, ধৈর্য নিয়ে।

পুত্র সম্রাটের পরিচালনায় নাটকের মাধ্যমে প্রায় দু’বছর (২০১৫ সাল) পর তার অভিনয়ে ফেরা। পরিচালক অন্য শিল্পীদের নিয়ে অদূরেই আউটডোরে ছিলেন।

ওই বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে উত্তরার শুটিংবাড়িতে রাজ্জাক তখন একা, বিশ্রামে। বিশ্রাম বলতে, এই সাজঘর, এই বারান্দা, পায়চারি। কোথাও স্থির নন। সত্যি কী স্থির নন তিনি! বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে তার মতো স্থায়ী আসন আর ক’জনার আছে? সে সময়ে বাংলানিউজে প্রকাশিত নায়করাজের সাক্ষাৎকার পড়ুন আবার— 

বাংলানিউজ: প্রায় দু’বছর পর ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন। তা-ও আবার ছেলের পরিচালনায়। কেমন লাগছে?
রাজ্জাক: ভালো লাগছে। আমি অসুস্থ হওয়ার আগে আমার বড় ছেলে বাপ্পারাজের পরিচালনায় ‘কার্তুজ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলাম। এখন ছোট ছেলে সম্রাটের নাটকে (দায়ভার) অভিনয় করছি। ওর স্ক্রিপ্ট আমি সবসময় দেখে দিই। নাটকের একটি চরিত্র আমার খুব পছন্দ হলো। সম্রাটকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবার চরিত্রটা কে করছে? ও বলল, ‘ঠিক হয়নি। এটা করার মতো তো কেউ নেই। ’ আমি ওকে আমার আগ্রহের কথা জানালাম। খুব খুশি হলো। ও নিজে থেকে আমাকে প্রস্তাব দেয়নি, কারণ ডাক্তারের বারণ আছে। আর আমার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ওরা (পরিবার) সবসময়ই চিন্তিত। সত্যি বলতে, কাজ করলেই কেবল আমি সুস্থ বোধ করি। আমি তো প্রায় মরেই গিয়েছিলাম! উপরওয়ালার রহমত আর মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় কাজে ফিরে এসেছি। আমি সবার কাছে সবসময় এমন দোয়া চাই।
রাজ্জাক
বাংলানিউজ: যে সন্তানদেরকে (বাপ্পারাজ ও সম্রাট) হাতে ধরে অভিনয়ে নিয়ে এলেন। এখন তাদের পরিচালনায় অভিনয় করছেন। কখনও কী ভেবেছিলেন এমন আনন্দের দিন আসবে আপনার জীবনে?
রাজ্জাক: এটা আমার জন্য গর্বের বিষয় যে, আমার দুই সন্তান আমার পথ অনুসরণ করেছে। এই দিনগুলো আমার কাছে নতুন নয়। অবশ্যই স্বপ্ন দেখেছিলাম। প্রথমে অভিনয়, এখন পরিচালনা করছে, আমি ওদের পরিচালনায় কাজ করছি। একজন অভিনেতা পিতার কাছে এর চেয়ে আনন্দের ঘটনা আর কী হতে পারে!

বাংলানিউজ: আপনার দুই সন্তান সুঅভিনেতা। সাফল্যের দিক দিয়ে ওরা আপনাকে অতিক্রম করুক— এটা আপনার প্রত্যাশা হতে পারে। বাপ্পা ও সম্রাটের কাজের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?
রাজ্জাক: সবার জায়গা তো সবাই নিতে পারে না। বাপ্পা বাপ্পার জায়গায় আছে। সে ভালো অভিনেতা। সম্রাট সম্রাটের জায়গায় আছে। সে-ও ভালো অভিনেতা। আমি বাবা হিসেবে গর্ববোধ করি এই কারণে যে, তারা চলচ্চিত্রে কিংবা যেখানেই থাকুক, ওরা মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। আমার ছেলেরা অসম্ভব ভদ্র। ওদের নিয়ে কেউ কোনো বাজে কথা বলতে পারবে না। খুব ভালো লাগে যে, ওরা আমার আদর্শে বড় হয়েছে। আমার সম্মান রাখছে।
রাজ্জাক
বাংলানিউজ: ক্যারিয়ারে নায়ক হিসেবে দীর্ঘ স্বর্ণযুগ ছিলো আপনার। এফডিসি ছিলো আপনার দ্বিতীয় সংসার। এর বীজমন্ত্র কী? চলার পথে কোন বিষয়গুলো মেনে চলেছেন কিংবা এড়িয়ে গেছেন?
রাজ্জাক: বীজমন্ত্র কিছু না। এই মাধ্যমটাকে (চলচ্চিত্র বা অভিনয়) আমি ভালোবাসি। আমার স্বপ্ন আর প্রেম ছিলো অভিনয়কে ঘিরে। হ্যাঁ, সংসার ছিলো আমার, সন্তান-সন্ততি ছিলো। কিন্তু ওগুলো ছিলো সেকেন্ডারি। প্রথমে ছিলো অভিনয়। কীভাবে অভিনয়টা ঠিকঠাক করা যায়, এ নিয়েই ধ্যানজ্ঞান ছিলো। আর আমি টাকার পেছনে ঘুরিনি, টাকা আমার পেছনে দৌঁড়েছে। এখন হয়ে গেছো উল্টো। অধিকাংশ মানুষই টাকার পেছনে ঘুরছে।

সবচেয়ে বড় কথা আমি সংযত থাকতে শিখেছি। কোথায় ছিলাম কোথায় এলাম- এই ভাবনা আমার মধ্যে সবসময় জাগ্রত ছিলো। নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকা সবার জন্যই জরুরি। আমার ব্যক্তিগত কিংবা অভিনয় জীবন- কোথাও কলঙ্ক লাগতে দেইনি। সবই সম্ভব হয়েছে আমার ভক্ত ও দর্শকদের সুবাদে। তাদের প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থেকেছি। তাদের ভালোবাসার সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার লক্ষ্য ছিলো চলচ্চিত্রের উন্নতি করা। অনেক যুদ্ধ করেছি আমরা। উর্দু ফিল্মের বিরুদ্ধে বাংলা ছবির সুদিন ফেরাতে অনেক চেষ্টা করতে হয়েছে।
রাজ্জাক
বাংলানিউজ: অনেক কালজয়ী নির্মাতা আপনাকে নিয়ে ছবি বানিয়েছেন, সফল হয়েছেন। আপনার কী কখনও মনে হয় যে, কিছু ছবিতে অভিনয় না করলেও হতো?
রাজ্জাক: মনে হয়। কিন্তু সেটা তীব্র নয়। খ্যাতিমান পরিচালকরা আমাকে নিয়ে সাহিত্যনির্ভর কিংবা সুন্দর গল্প বলেছেন। পাশাপাশি এমন কিছু ছবিতে আমাকে অভিনয় করতে হয়েছে যেগুলো তখন চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচানোর জন্য দরকারি ছিলো। সে সময়, যাদের ছবিতেই অভিনয় করেছি তাদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য ছিলো বাংলা ছবিকে এগিয়ে নেওয়া। আমাকে সামনে রেখে তারা সেই কাজটা সহজভাবে করতে পেরেছিলেন।

আমি চলচ্চিত্রে আসার আগেও এই চেষ্টা করা হয়েছে। তখন ছিলেন আনোয়ার হোসেন, রহমান, খলিল, শওকত আকবর, হাসান ইমাম সাহেব। তারা উর্দু-বাংলা দুই ভাষার ছবিতেই অভিনয় করেছেন। আমি আসার পর বাংলা ছবির জোয়ারটা লাগলো। খান আতাউর রহমান, জহির রায়হান, কাজী জহির, আলমগীর কুমকুম, নারায়ণ ঘোষ মিতা, জহিরুল হক, নজরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান- এমন অনেক গুণী পরিচালক তখন ছিলেন। তারা চেয়েছিলেন, দর্শক চাহিদা যেহেতু আছে, ছবিগুলো একের পর এক চলুক, বাংলা ছবির দর্শক বাড়ুক। সেটাই হয়েছিলো। আমি শুধু চেষ্টা করেছি। আর আমার তেমন কোনো ছবি ফ্লপ যায়নি।
সপরিবারে রাজ্জাক
বাংলানিউজ: আপনি কী ভাগ্যে বিশ্বাস করেন? আপনার ঈর্ষণীয় চলচ্চিত্র জীবনের পেছনে ভাগ্য কতোটা সহায় ছিলো বলে মনে করেন? 
রাজ্জাক: ভাগ্য তো আছেই। তবে ভাগ্যে আছে বলে বসে থাকলে চলবে না। ভাগ্যকে গড়ার দায়িত্ব যার যার কাছে। এজন্য খাটতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, সৎ থাকতে হবে।

বাংলানিউজ: আপনার সমবয়সী অনেক শিল্পীই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবনা হয়!
রাজ্জাক: আমি আগেও অনেক জায়গায় বলেছি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে থাকতে চাই। মৃত্যু নিয়ে ভাবনা তো হয়। কিন্তু মুত্যুকে ভয় পাই না। শুধু চাই আমার যেন কষ্টাদায়ক মৃত্যু না হয়। কাজ করতে করতে যেন আরামদায়ক মৃত্যু হয় আমার।  

বাংলানিউজ: এবার একটা মজার প্রশ্ন করি। ধরুন, আপনাকে নির্বাসনে পাঠানো হলো। প্রিয় একজনকে সঙ্গে নিতে পারবেন। তিনি কে?
রাজ্জাক: প্রিয় মানুষ তো অনেক, কয়জনকে সঙ্গে নেবো! এর চেয়ে এই ভালো, এমন একজনকে নেবো যে কথা বলতে পারে না…(হা হা হা)।  

বাংলানিউজ: আপনার বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্রজীবন। এ ব্যাপারে ছোট-বড় সবারই আগ্রহ আছে। আত্মজীবনী লিখছেন?
রাজ্জাক: হ্যাঁ, আত্মজীবনী লিখছি। কাজটা অনেকদূর এগিয়েছে। তাড়াহুড়ো করে লিখছি না।

বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১৭
এসও

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।