ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

পর্ব ২৩:

রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, মে ২, ২০১৭
রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ রেশম যুগের মুর্শিদাবাদ/ছবি: লেখক

মুর্শিদাবাদ ঘুরে: রেশম চাষের জন্য মুর্শিদাবাদের খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপি। সতেরো শতকে মুর্শিদাবাদ রেশম এবং রেশম বয়নের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ইংরেজ বণিকরা মুর্শিদাবাদের রেশমের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে ১৬২১ সালের দিকে। দিল্লি-আগ্রায়  মুঘল শাসন যুগ থেকেই মুর্শিদাবাদের প্রশাসনিক গুরুত্ব বাড়তে থাকে। রেশমই এ প্রশাসনিক গুরুত্বের কারণ।

১৬৬০-এর দিকে মুর্শিদাবাদ একটি পরগনা সদর দফতর হিসেবে গণ্য হয়। এসময়েই মুর্শিদাবাদের কাসিমবাজারে ইউরোপীয়রা কুঠি স্থাপন করে।

মুর্শিদাবাদের তুতগাছের ক্ষেতবাংলাদেশের রাজশাহী ও ভারতের মালদাতেও রেশম চাষের বিস্তার হয়। রাজশাহী ও মালদার সিল্ক ইতিহাসের সেই নজিরই বহন করে। রাজশাহীতে রেশম কারখানা ও সিল্ক তৈরির কারখানা ইতিহাসের রেশম যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়। Bengal Silk  বলতে মূলত রাজশাহী, মালদা ও মুর্শিদাবাদের সিল্ককেই বোঝায়।

বেঙ্গল সিল্কের টানে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজা-মহারাজারাও বাংলায় পাইক-পেয়াদা-পন্ডিত পাঠিয়ে রেশম চাষের দীক্ষা নিতেন। কথিত আছে, রেশম চাষের পদ্ধতি ও ব্যবসায় সম্পর্কে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শেরে মহীশুর টিপু সুলতান মহীশুরের তাঁতিদের পাঠিয়েছিলেন এই বাংলায়। বাংলা থেকেই পরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে গুটি পোকা তার জাল বিস্তার করে, রেশম বিস্তৃত হয়।   এই বেঙ্গল সিল্ক তখন ইউরোপে রপ্তানি করা হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসে রেশমের টানে। রেশম বাণিজ্যে দখলদারিত্ব থেকেই পরে তারা ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব কায়েম করে। বাংলায় রেশমের ইতিহাস আরো দীর্ঘ! মুর্শিদাবাদের তাতিপাড়ারেশম কাপড়ের সোনালী দিন আজ আর নেই সত্য। নেই বাংলার নবাব, সম্রাট, ইংরেজ বণিক অথবা কাসিমবাজার কুঠি। কিন্তু চারশ’ বছরে সব কিছুই কি একেবারে হারিয়ে গেছে? হয়তো বা না। তাই মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে আজো চাষ হয় তুঁত গাছ, চাষ হয় রেশমগুটি। খোসবাগ থেকে রোশনি বাগ যেতে এরকম অনেক তুঁতক্ষেত চোখে পড়বে। সচরাচর তুতঁগাছে আমাদের চোখে পড়েনা। তাই রাস্তার দুই ধারে এরকম গাছ দেখে চোখ আটকে গেলো। গাড়ি চালককে জিজ্ঞেস করতেই বললেন গুটিপোকার জন্য তুঁত গাছ। গাড়ি থামিয়ে শ্যামল মন্ডল নামে এক তুঁতচাষী কেও পাওয়া গেলো। কেজি প্রতি ৩১০ টাকা করে বিক্রি করেন তুঁতপাতা। খরচ বাদে লাভ মন্দ নয়। ব্যবাসায়ীদের কাছে সরাসরিই বিক্রি করেন। তাই দামও ভালো।   মুর্শিদাবাদে এরকম ছোটবড় অনেক তুঁতক্ষেত আছে। মুর্শিদাবাদের তাতিপাড়াবহরমপুরে মতোই জিয়াগঞ্জ মুর্শিদাবাদের আরেকটি শহর। জিয়াগঞ্জ পার হয়ে একটু পরেই রয়েছে তাতিপাড়া। এখানে তৈরি হয় সিল্কের শাড়ি। লোকে একে সিল্ক সিটিও বলে। নামে যদিও তাতিপাড়া, কিন্তু এখানে তাতিপরিবার রয়েছে হাতে গোনা ৫-৬টি। কারখানার মালিকরাই এগুলো পরিচালনা করেন। মালিক-পরিবারের সদস্যরাই এখানে কর্মচারি। আলাদা করে কর্মচারি নিলে লাভ থাকে না। মুর্শিদাবাদের তাতিপাড়াসিল্ক ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি কোনো সহায়তা নেই, সেই হতাশা সর্বত্রই। সরকার খাদির জন্য টাকা দেয়, সিল্কের জন্য না। মুর্শিদাবাদের সিল্কের পাশাপাশি বাঙালোরের সিল্কও এখানে জনপ্রিয়। শাড়ি ভেদে ১০০০ থেকে ১৬০০ রুপি পর্যন্ত কারখানা মালিকরা মজুরি পান। অনেক সময় মহাজন সূতা দেয়, সেক্ষেত্রে মজুরি হেরফের হয়। তখন আর লাভ বলতে কিছু থাকে না। ‘তবুও বাপ-দাদার পেশা’-তাতি পাড়ার সবারই একই কথা।

মালিক অমল বাবু বললেন, ‘আর ৮/১০ বছর পর সিল্ক উঠে যাবে’। তার আরো তিন ভাই-বিমল, শ্যামল ও বৃন্দাবনও কাজ করে একই কারখানায়। তাদের মেসো মশাই থাকেন বাংলাদেশের চাপাইনবাবগঞ্জে। মুর্শিদাবাদের তাতি দম্পতি এক কারখানার মালিক সত্তুরোর্ধ অমরনাথ, তিন বছর বয়সে বাবা-মার সাথে বাংলাদেশের শিবগঞ্জ থেকে এসেছেন। স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে তার বিরাট সংসার। এ পাড়ার বেশির ভাগেরই কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে বাংলাদেশের সাথে। কারো বাপ-ঠাকুরদাদার ভিটা বাংলাদেশে, কেউ হয়তো শৈশবে এসেছেন। তারপর বহুযুগ...। বাংলাদেশের কথা শুনে এগিয়ে এলেন অমরনাথ পস্তি ও তার স্ত্রী কল্পনা পস্তি (রাজশাহীর মেয়ে), জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা সবাই ভালো আছো তো?’ 

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১৭

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।