কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ওয়ারাঙ্গাল ফোর্ট। ফোর্টের বাংলা দূর্গ হলেও, এখানে সবাই ওই নামেই চেনে।
এর কারণ অবশ্য ওয়ারাঙ্গাল দূর্গ। এর সঠিক প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের দ্বিমত রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন, ১২ শতকের শেষের দিকে। ঐতিহাসিকদের মত, ১৩ শতকের মাঝামাঝি। তবে সর্বজনগ্রাহ্য খুব সম্ভব অনুমান, প্রতাপরুদ্র (১ম) ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দে কাকাতিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর শক্তি-সামর্থ বাড়াতে দূর্গের কাজ শুরু করেন।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, শুরুতে দূর্গ ছিলো ইটের তৈরি। কাকাতীয় রাজা গণপতিদেব ইটের জায়গায় পাথর প্রতিস্থাপন করেন। নানা রকমের পাথরে নতুন রূপ পায় দূর্গটি।
গণপতিদেব মারা যান ১২৮৯ সালে। ঐতিহাসিকরা এখান থেকেই সিদ্ধান্তে আসেন, দূর্গের প্রতিষ্ঠাকাল ১৩ শতকের মাঝামাঝি। তারা গণপতিদেবের পাথরে প্রতিস্থাপিত দূর্গের সময়কে প্রতিষ্ঠাকাল ধরেন।
এরপর আসে রুদ্রমা দেবীর শাসনামল। তিনি ১২৮৯ সাল অব্দি রাজ্য পরিচালনা করেন। তার পর রাজ্যের দায়িত্ব কাঁধে নেন নাতি প্রতাপরুদ্র (২য়)। তার শাসনামল তথা পরবর্তী ২০ বছরকে বলা হয় কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ। গণপতিদেব, রুদ্রমাদেবী ও প্রতাপরুদ্র (২য়)— প্রত্যেকেই তাদের শাসনামলে দূর্গের উচ্চতা, ভবনের প্রবেশদ্বার, দেয়াল প্রভৃতি বাড়িয়েছেন। ফলে দূর্গ হয়ে উঠেছে আরও শক্তিশালী। দক্ষিণের রাজাদের কাছে অভেদ্য ছিলো ওয়ারাঙ্গাল দূর্গ। এজন্য কেউ আক্রমণ করতে সাহস পেতো না! কিন্তু প্রকৃতির বিধান অন্য, সবকিছুরই শেষ থাকে।
দিল্লিতে তখন আলাউদ্দিন খিলজির দৌরাত্ম্য। প্রতাপরুদ্র (২য়) দিল্লি সালতানাতের কাছে মাথা নত করতে অস্বীকার করলেন। ১৩০৯ সালে মালিক কাফুরের নেতৃত্বে খিলজির এক লাখ সৈন্য দূর্গ ঘিরে ফেললো। শুরু হলো যুদ্ধ। প্রতাপরুদ্র (২য়) ও তার বাহিনী বীরত্বের সঙ্গে লড়ে গেলেন। কয়েকমাস দূর্গে ঢোকা থেকে খিলজির এক লাখ সৈন্যকে আটকে রাখলেন। এভাবে আর কতোদিন?প্রতাপরুদ্র (২য়) কাফুরের সঙ্গে শান্তি চুক্তিতে এলেন, কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের সব ধনসম্পদ, মণি-মাণিক্য দিয়ে দেবেন— বিনিময়ে সৈন্য নিয়ে ফিরে যাবেন কাফুর। সেইসঙ্গে বাৎসরিক খাজনা এবং রোজ একবার করে দিল্লির দিকে মুখ করে সুলতানের প্রতি কুর্নিশ করবেন।
এই মণি-মাণিক্যের মধ্যে কোহিনূর হীরাও ছিলো বলে অনেক ঐতিহাসিকের মত। পরবর্তীতে সেটি আসে আমীর খসরুর হাতে। তিনি পরবর্তীতে বর্ণনা করেছেন, দূর্গটি কতোটা শক্তিশালী ছিলো।
তার বর্ণানায়, পুরোপুরি পাথরে নির্মিত দূর্গটি গভীর পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিলো যেটি খুব কষ্টে সাঁতরে পার হতে হয়েছিল মুসলিম সৈন্যদের। ভেতরে ছিলো আলাদা আরও দু’টি বৃত্তাকার দূর্গ।
১৩১০ সালে কাফুর যাওয়ার সময় এতো ধনসম্পদ নিয়ে যান যা বয়ে নিয়ে যেতে প্রায় দুই হাজার উট লেগেছিল। যাইহোক, আগের মতো শাসনকার্য চালিয়ে যেতে লাগলেন প্রতাপরুদ্র। কিন্তু এই নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়ে তার অধীনে থাকা কয়েকজন ছোটখাটো রাজা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করে দিলেন। রে অবশ্য কয়েকজনকে দমনও করেন। কিন্তু তাদের সামলাবেন কী, প্রতাপরুদ্রেরই (২য়) তখন নাজেহাল অবস্থা। ১৩১৮ সালে তিনি দিল্লির সুলতানকে খাজনা দিতে অস্বীকার করায় আবার আক্রমণ হয় ওয়ারাঙ্গালে (তৎকালীন ওরুঙ্গাল)। শক্তিশালী দূর্গের কল্যাণে সে আক্রমণ কোনোভাবে রোখা গেলেও প্রতাপরুদ্র (২য়) আবারও শান্তি চুক্তিতে যান। সেবারও তাকে বিপুল পরিমাণ মণি-মাণিক্যসহ হাতি-ঘোড়া দিতে হয়।
ঠিক পরের বছর তথা ১৩২০ সালে প্রতাপরুদ্র (২য়) আবারও খাজনা দিতে অস্বীকার জানান। দিল্লি সালতানাতে খিলজির জায়গায় তখন তুর্কি শাসক গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ। কিন্তু প্রতাপরুদ্রের (২য়) ভাগ্যের বদল ঘটে না। গিয়াসউদ্দিন ১৩২৩ সালের দিকে বিশ্বস্ত ও চৌকস উলুগ খানকে পাঠান ওরুঙ্গালে। উলুগ খানের প্রাথমিক আক্রমণ প্রতিহত করা গেলেও কিছুদিন পর কাকাতিয়া রাজ্যের অপ্রস্তুত সৈন্যবাহিনী তার কাছে পরাজিত হয়। কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী ওরুঙ্গালে এক মাস পর্যন্ত লুণ্ঠন ও ধ্বংসলীলা চলতে থাকে। কতো শত হীরা, মাণিক্য, রৌপ্য, গহনা লুণ্ঠন করে পাঠানো হয় দিল্লিতে।
অনেক ঐতিহাসিকের মত, রাজা প্রতাপ রুদ্র এই যুদ্ধে অতর্কিত প্রাণ হারান এবং এইসময়ই কোহিনূর হীরা লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক বলেন, পরাজিত রাজা প্রতাপ রুদ্র আত্মসমর্পণ করেন এবং তাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গোদাবরী নদীর তীরে তার মৃত্যু হয়। কথিত রয়েছে, তিনি আত্মহত্যা করেন।
উলুগ খান ওরুঙ্গালের নতুন নাম দেন সুলতানপুর। পরবর্তীতে ওয়ারাঙ্গাল ফোর্ট কুতুব শাহী সাম্রাজ্য এবং এরও পরে হায়াদ্রাবাদের নিজামদের অধীনে আসে।
দিল্লি সালতানাতের ধ্বংসলীলার সময়ই ভূলুণ্ঠিত হয় বিখ্যাত ওয়ারাঙ্গাল ফোর্ট, শিব মন্দির, কালী মন্দির এবং অসংখ্য দেব-দেবীর ভাস্কর্য। এরপর শুরু হয় মুঘল শাসন। ভারত ব্রিটিশদের করায়ত্বেও ছিলো ২শ বছরেরও মতো। ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টানোর মতো কেটে যায় একে একে ৭শ বছর।
এই দীর্ঘ কালের পরিক্রমায়ও কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের স্মৃতিধন্য একটি শিব মন্দিরের ভগ্নাংশ, ফোর্টের কিছু পাথুরে ধংসাবশেষ, কিছু ভাঙা-আধাভাঙা দেব-দেবীর ভাস্কর্য, পাথরে নির্মিত ফোর্টে ঢোকার গেট, ভাঙা প্রাচীর এবং বিভিন্ন জায়গায় ছড়নো-ছিটানো কিছু নিদর্শন রয়ে গেছে।
এগুলো দীর্ঘদিন অযত্নে-অবহেলায় পড়ে ছিলো। ধ্বংস, দখল, নষ্ট প্রভৃতির পর যা অবশিষ্ট রয়েছে তা এখন আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে। যেখান থেকে যা মিলেছে জড়ো করে এক জায়গায় সাজিয়ে পার্কের মতো করে রাখা হয়েছে। ভারতীয় হলে জনপ্রতি ১৫ রুপি, বিদেশি হলে ২০০ রুপি দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা সেসব দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। ওয়ারাঙ্গাল শহর থেকে মাত্র এক-দুই কিমির পথ। প্রকৃতির এই এক অলীক বিধান, আজকের সুদৃশ্য ফুল কাল ধূলায় লুটিয়ে পড়ে। তেজী যুবকও একদিন বৃদ্ধ হয়। এক সময়কার প্রতাপশালী কাকাতিয়া, তুঘলক, কুতুব শাহী, নিজাম বা ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য আজ নেই। সবই ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু ওয়ারাঙ্গাল ফোর্টটি রয়ে গেছে।
অবশ্য বলা ভালো, ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ। দুই দুইবার দিল্লি সালতানাতের আক্রমণ রুখে দিয়েছিল এই ফোর্ট। সেসময় সেটি খুব সহজ ছিলো না। আবার কাকাতীয়দের পক্ষেও সম্ভব ছিলো না দিল্লির আক্রমণের বিরুদ্ধে জয়লাভ। ছিলো না বলেই দুই পক্ষ দুইবার শান্তির পথ নিয়েছে।
কিন্তু শেষবার আর সঙ্গত কারণেই সম্ভব হয়নি। এর আগে দুইবার যুদ্ধ করে প্রতাপরুদ্র ব্যাপক দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি পরাজিত হলেও অজেয় রাজপুতের লড়ে গেছে ওয়ারাঙ্গাল ফোর্ট!
বলা হয়, মাথা কাটা গেলেও নিজের সম্মানের জন্য লড়ে যায় রাজপুতের ধড়। তেমনি উলুগ খানের ধ্বংসলীলার পরও যেনো সেসময় লড়ে গিয়েছিল দূর্গের টুকরো পাথরগুলো। এরপর কতো শাসকের বদল, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা— ওয়ারাঙ্গাল ফোর্টের টুকরো পাথরের প্রতাপ এখনও রয়ে গেছে। ইতিহাসের পাতায় আক্ষরিক পরাজয় হলেও, প্রত্নতত্ত্বের মূল্যে সেগুলো অজেয়-অমূল্য…
বাংলাদেশ সময়: ০৭১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৭
এসএনএস