ঢাকা : আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির শেকড় ‘যাত্রা’। সহস্রাব্দকাল পার করলেও প্রাচীন এ সাংস্কৃতিক মাধ্যমটি পূর্ণ অবয়ব নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এখনো।
অথচ ধার করা ভিনদেশি সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলো শতাব্দীরও কম সময়ের ব্যবধানে এদেশে গেড়েছে স্থায়ী আসন। কেবল তাই নয়- এ সংস্কৃতিকে বিকশিত রূপ দিতে রয়েছে নানান পৃষ্ঠপোষকতা!
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাত্রার মানোন্নয়নে অতীতে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা না থাকায় সীমাহীন অবহেলা নিয়ে আপন গতিতেই বিকশিত হয়েছে মূলত: গ্রামীণ এ শিল্পমাধ্যম।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পেশাদার যাত্রাদলের হাত ধরে একটি সুস্থিত কাঠামোতে ফিরে আসে যাত্রা। আশির দশকে কিছুটা প্রাণসঞ্চার হয় যাত্রাশিল্পে।
১৯৮৭-৮৮ সালে দেশে ২১০টি পেশাদার যাত্রাদল ছিল। যা পরবর্তীকালে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে শুধুই হ্রাস পেয়েছে সংখ্যা।
২০১২ সালে এসে পেশাদার যাত্রাদলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৫-তে। বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী- বর্তমানে কুশলী ও কর্মীসহ যাত্রাশিল্পীর সংখ্যা ২০ হাজার ৩শ’।
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৫ লাখ। ৯০’র পর থেকে অশ্লীলতা, নিরাপত্তা সমস্যাসহ নানা অজুহাতে যাত্রাশিল্পকে আবদ্ধ করা হয় নিয়ন্ত্রনের বেড়াজালে।
১৯৯১-৯৬’র মধ্যে ৬ বার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় যাত্রানুষ্ঠান বন্ধের জন্য। সে সময় ১০১৪ দিন সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে যাত্রানুষ্ঠান। সংশ্লিষ্টদের দাবি- এতে যাত্রাশিল্পের ক্ষতি হয় ৩৩ কোটি ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা।
যাত্রাই একমাত্র সাংস্কৃতিক জনমাধ্যম যার মাধ্যমে এক সঙ্গে ১৫/২০ হাজার মানুষের বিনোদন চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। বিনোদনের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের মাঝে শিক্ষণীয় নানা বার্তা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও যাত্রার যথেষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে।
উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ:
প্রাচীনকালে ধর্মীয় উৎসবে শোভাযাত্রার আবহে পৌরাণিক কাহিনীর গীতিবদ্ধ উপস্থাপনা এক সময় যাত্রাগান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
কবি তপন বাগচীর রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলায় যাত্রাগানের উদ্ভব। ’ বইটিতে বিশ্বকোষ প্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- ‘অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষের সকল স্থানেই প্রকাশ্য রঙ্গভূমে বেশভূষায় ভূষিত ও নানাসাজে সুসজ্জিত নরনারী লইয়া গীতবাদ্যাদী সহকারে কৃষ্ণপ্রসঙ্গ অভিনয় করিবার রীতি প্রচলিত। গীতবাদ্যাদীযোগে ঐ সকল লীলোৎসব- প্রসঙ্গে যে অভিনয়ক্রম প্রদর্শিত হইয়া থাকে- তাহাই প্রকৃত যাত্রা বলিয়া অভিহিত। ’
ফোকলোরবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী মনে করেন, ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে- প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দমূল ‘যা’ ধাতু থেকে, যার অর্থ গমন-যাত্রা শব্দের উৎপত্তি। যাত্রা গবেষকগণ এ শিল্পের উদ্ভবকে দেখেছেন, দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আদিযুগ, ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মধ্যযুগ এবং উনবিংশ শতাব্দী থেকে চলমান সময় পর্যন্ত আধুনিক যুগ হিসেবে।
যাত্রার ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যাত্রা গবেষক ও কবি ড. তপন কুমার বাগচী লিখেছেন, ‘১৮৬০ সালে ঢাকায় কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১১-৮৮) কৃষ্ণ বিষয়ক ঢপ কীর্তন পরিবেশনের পাশাপাশি পৌরাণিক পালা রচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে যাত্রার যে গতি সঞ্চার করেন, চারণকবি মুকুন্দ দাসের (১৮৮৭-১৯৩৪) হাতে তা হয়ে ওঠে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জাগরণী মন্ত্র।
বিশ্ব শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রজেন্দ্র কুমার দে’র (১৯০৭-৭৬) হাতে যাত্রা বিকশিত হয়ে পৌরাণিক পালার পাশাপাশি ঐতিহাসিক, লোককাহিনীভিত্তিক ও সামাজিক পালায়।
পেশাদার যাত্রাদলের আবির্ভাবে যাত্রা হয়ে ওঠে গ্রাহ্য শিল্পমাধ্যম। আধুনিক নগর জীবণে যেমন থিয়েটার, গ্রামীণ জনপদে তেমনি ‘যাত্রা’ এখনো অন্যতম বিনোদন-মাধ্যম হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। স্থূলতা, গ্রাম্যতা ও অশ্লীলতার অভিযোগ এবং নানা নেতিবাচক ধারণা সত্ত্বেও যাত্রার প্রভাব ও বৈভবকে অস্বীকার করা যায় না। ’
বাংলা শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই যাত্রার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলা ভাষার বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন যাত্রায়।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরীশ চন্দ্র ঘোষ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল ব্যক্তি জীবনেই যাত্রা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না, তাদের সাহিত্যকর্মেও ছিল যাত্রার উজ্জল উপস্থিতি।
যাত্রাশিল্পী ও গবেষকরা মনে করেন, যাত্রা কেবল বিনোদন মাধ্যম নয়, লোকশিক্ষার বাহনও। নিরক্ষতার অনগ্রসর সমাজে যাত্রা পালন করছে ভ্রাম্যমাণ বিদ্যালয়ের ভূমিকাও।
রাজাবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির বাসিন্দা যাত্রাশিল্পী কল্পনা ঘোষ (৫২)। শৈশব থেকেই যাত্রার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পুরো জীবনের অভিজ্ঞতা-স্মৃতি বলতে যা কিছু, তার সবই যাত্রাকে ঘিরেই।
সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমী চত্বরে অনুষ্ঠিত একটি যাত্রা উৎসবে অংশ নিতে এসে এ প্রতিবেদককে জানালেন এ শিল্পের নানা সমস্যার কথা।
যাত্রাশিল্পী কল্পনা ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, শিশুকাল থেকে যাত্রাপালায় অভিনয় করছি। এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে ৩ ছেলে মেয়ে মানুষ করেছি। ভালবেসে এখনো ধরে রেখেছি যাত্রাভিনয়। বর্তমানে তরুণরা আর যাত্রাভিনয়ে আসতে চায় না। তরুণরা এগিয়ে আসলে এ শিল্পের উত্তরণ ঘটতো। এটি একটি ভাল মাধ্যম। এখানে শেখার অনেক কিছু রয়েছে।
অতীত ও চলমান সংকট :
প্রাচীন শিল্পমাধ্যম যাত্রার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয় ব্রিটিশ শাসনামলেই। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবি উচ্চারিত হওয়ায় ব্রিটিশ শাসকরা বন্ধ করে দেয় মুকুন্দ দাশের স্বদেশী যাত্রা।
পাকিস্তান আমলেও যাত্রাশিল্পটি রক্ষনশীল ও মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ে। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁ’র নির্দেশে বন্ধ করা হয় রূপবান যাত্রা। যাত্রাশিল্পীদের অভিযোগ, ১৯৭৫’র পর স্বাধীন দেশেই বাঙালি সংস্কৃতির শেকড় যাত্রাকে নিয়ে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র।
১৯৯২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যাত্রা বন্ধে সরকারি আদেশ জারি করা হয়। বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট যাত্রাশিল্পী মিলন কান্তি দে এই শিল্পের চলমান সংকট প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে জানান, যাত্রানুষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়, তার জন্য যাত্রাশিল্পীরা দায়ী নন।
একশ্রেণীর ভূঁইফোড় ও বিকৃত মানসিকতার প্রদর্শকরা এর জন্য দায়ী। এরা কেউ পেশাদার যাত্রা প্রদর্শক না। আমরা একাধিকবার বলেছি, অশ্লীলতা যাত্রাশিল্পীরা করে না, কেউ করলে আমরা প্রশাসনকে তাৎক্ষণিক অবগত করি তা বন্ধ করার জন্য। তারপরও পুরো দায়ভার এ শিল্পকেই বহন করতে হচ্ছে।
তিনি জানান, ‘একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা এ শিল্পের ওপর নির্ভর করে। নানা সময়ে এ শিল্পকে বন্ধ করে দেয়ার যে অপচেষ্টা হয়েছে তা মূলত: বাংলা সংস্কৃতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস।
সরকারের কাছে আমরা এ শিল্প রক্ষায় নানা সময়ে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা আবেদন জানাই। বর্তমান সরকার আমলে যাত্রাশিল্পের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি প্রণীত হলে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমরা মনে করি। ’
মিলন কান্তি দে মনে করেন- যাত্রাশিল্পকে আরো বিকশিত রূপ দিতে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত নাট্যকাররা তেমন ভূমিকা রাখছেন না। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত নাট্যকাররা যাত্রাপালা লেখেন, আমাদের নাট্যকাররা যাত্রাপালা লেখেন না।
এখানে তাই ভালমানের পালা রচিত হচ্ছে না। এ শিল্পের সামগ্রিক বিকাশের পথে এটিও একটি বড় বাধা হিসেবে দেখেন মিলন দে।
উল্লেখযোগ্য পালা:
নামিদামি পালাকারের অভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রাশিল্পীরাই এক সময় পালা রচনায় হাত দেন। এর মধ্যে খুলনার পরিতোষ ব্রহ্মচারীর নদীর নাম মধুমতি, ক্লিওপেট্রা, ইসহাক আলীর সুন্দরবনের জোড়াবাঘ, এমএ মজিদের সোনার বাংলা, যশোরের সাধন মুখার্জির শতাব্দীর মহানায়ক, নিচের পৃথিবী, ঢাকার ননী চক্রবর্ত্তীর ডিস্কো ডেঞ্চার, দস্যুরানি, যৌতুক, চট্টগ্রামের মিলন কান্তি দে’র মায়ের ছেলে, দাতা হাতেম তাই, বিদ্রোহী নজরুল, বাংলার মহানায়ক, গাইবান্ধার আব্দুস সামাদের গরীবের আর্তনাদ, ফরিদপুরের হারুনর রশিদের শতাব্দীর মহানায়ক মুজিব, মুন্সিগঞ্জের আরশাদ আলীর সতী কেন কলঙ্কিনী, গৌরীমালা, মানিকগঞ্জের জ্যোসনা বিশ্বাসের রক্তস্নাত একাত্তর উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ সময় : ১২১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১২