শুনলে অবাক লাগলেও খাস কলকাতায় খোজ মিললো। ইনি যে সেই দেবী নন।
দেবীর নৈবেদ্য হাঁসের ডিম। তাও একটা কিংবা দুটো নয়, সংখ্যাটা এক লাখেরও বেশি। শুনতে অবাক লাগলেও দক্ষিণ কলকাতার বিজয়গড়-শ্রীকলোনির বারো ভূত দ্বাদশ অবতার মন্দিরে মকর সংক্রান্তির উদযাপনে গিয়ে দেখা গেলো এমনই চিত্র।
বারো ভূত অর্থাৎ বিষ্ণুর দশ অবতারের পুজো বুধবার (১৬ ডিসেম্বর)। তার আগে হয় বনদেবীর পুজো। আর সেই পুজোয় গামলা গামলা হাঁসের ডিম দফায় দফায় দেওয়া হয়েছে বনদুর্গাকে।
দক্ষিণ কলকাতার বেশ পরিচিত মেলা; যা পরিচিত বারো ভূতের মেলা হিসেবে। বিগত ৬৮ বছর ধরে যাদবপুর-বাঘাযতীন-বিজয়গড়-শ্রীকলোনি অঞ্চলে এই মেলা চলে আসছে। কিন্তু দেবীকে ডিম কেন নিবেদন করা হয়?
উত্তরে মেলা কমিটির সদস্য কালু ঘোষ জানান, বনদুর্গা, বনের দেবী। তার অত বাচবিচার থাকলে কি চলে! ডিমে তাই বনদুর্গার কোনো আপত্তি নেই, বিশেষ করে হাঁসের ডিমে।
তার ভাষায়, ‘হাঁসের ডিম তো নিরামিষ। মুরগির ডিম কিন্তু আমিষ। মুরগির ডিমে দোষ আছে, হাঁসের ডিমে নেই। তাই পুজোয় হাঁসের ডিম দেওয়াই হয়। ’
ইতিহাস বলছে, এক সময় এসব অঞ্চলে অধুনা বাংলাদেশের শরণার্থীরা ঠাঁই পেয়েছিলো। ঢাকার রোহিতপুর গ্রামের ছিন্নমূল মানুষেরা এপারে এসে যাদবপুর-বাঘাযতীন-বিজয়গড়-শ্রীকলোনি তল্লাটে বসতি গড়ে তুললেন।
সেই সঙ্গে তাদের সংস্কৃতি ও লোকাচারের অঙ্গ হিসেবে বারো ভূতের মেলা ও বনদুর্গার পুজোকেও নিয়ে আসেন কলকাতায়।
ঢাকার রহিতপুর গ্রামের জনৈক গণক ঠাকুর এই অঞ্চলে এসে তার বাড়ির বনদুর্গার পুজো করতে থাকেন। জঙ্গল ঘেঁষা গ্রাম রহিতপুরে ওই গণকঠাকুরের বাড়িতে বনদেবীর পুজো হতো।
সময়টা ১৯৫১, ঢাকা থেকে কলকাতায় এসে দেবী আর শুধু একজনের ঘরে আবদ্ধ থাকলেন না। তার দরজা খুলে গেলো সবার জন্য। এলাকায় প্রচলিত কাহিনী বলছে, এই পুজো এবং হাঁসের ডিম ঘিরে।
মেলা কমিটির সম্পাদক কাশীনাথ শীল জানান, কথিত আছে, ভিখারির বেশে বনদুর্গা এক গরিব ঘরে গিয়েছিলেন। সেই বাড়িতে ছিল শুধু চাল আর বাড়িতে পোষা হাঁসের ডিম। ভাত আর ডিম রান্না করে দেওয়া হয়েছিল বনদুর্গাকে। তিনি প্রসন্ন হয়েছিলেন। সেই থেকে দেবীকে হাঁসের ডিম দেওয়ার প্রচলন।
মন্দিরে গিয়ে দেখা যায়, শুধু এলাকার মানুষ নন, কলকাতা এবং কলকাতার সংলগ্ন অঞ্চল থেকেও আসা বহু ভক্তই বনদুর্গার পুজো দেন।
এজন্যই এদিন ভোর ৫টা থেকে বারো ভূত দ্বাদশ অবতার মন্দিরের সামনে লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদের অনেকেই নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী, হাঁসের ডিম মানত করছেন। আবার মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ায় কেউ গতবার যা মানত করেছিলেন, ততগুলো হাঁসের ডিম দিচ্ছেন বনদুর্গাকে। কারো ঝুড়িতে ডিমের সংখ্যা ১০০ কারোর ২০০ অনেকের হাজার বেশি।
কী করা হয় এই বিপুল পরিমাণ ডিমে? এই প্রশ্নের উত্তরে এর উদ্যোক্তারা জানালেন, শুধু ভক্তদের মধ্যে বিতরণ নয়, আশপাশের কয়েকটি হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, অনাথ আশ্রমেও বিপুল সংখ্যায় পাঠানো হয় মায়ের প্রসাদের ডিম।
বিগত ৬৮ বছর ধরে একাধারে ধর্ম পালন অন্য দিকে লোকাচার আর এই দুইয়ের মাধ্যমেই জনসেবায় পালন হয়ে আসছে বনদুর্গার পুজো।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৯
ভিএস/ এমএ