কিন্তু ভারতের কোথায় তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার রিপন স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের কথা। এখানকার কোনো একটি বাড়িতে থাকতেন মাজেদ।
মূলত জায়গাটিতে অবাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত। এখানকার অধিকাংশ মানুষ তাবলিগ জামাতের সঙ্গে জড়িত। এমনকি দিল্লির মসজিদের যে গণজমায়েত থেকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছিল সেই জমায়েতে ছিলেন এখানকার অনেকে। তারপর থেকে করোনার রেড জোন ঘোষণা করে পুরোপুরি লকডাউন। তবু কলকাতা পুলিশের সহায়তায় ঢোকা যায় এলাকায়।
যে বাড়িতে মাজেদ থাকতেন সে বাড়ির মালিকের নাম শফিক। বাড়িটি চারতলা। প্রতি তলায় চারটি করে রুম। বাইরে কোনো প্লাস্টার নেই, ইট খসে পড়ছে। ভিতরের অবস্থাও একই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখা যায় মাজেদ যেখানে থাকতেন সে রুমে তালা ঝোলানো। দরজায় আবার কলাপসিবল গেট। ভিতরে পর্দা।
শফিক জানান, তার বাড়ির দোতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন আব্দুল মাজেদ। পরিবার বলতে মাজেদের চেয়ে ৩২ বছরের ছোট স্ত্রী সেলিনা বেগম ও তাদের ছয় বছরের মেয়ে। বিয়ের আগে তালতলার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন মাজেদ। বিয়ের পর তার বাসায় ওঠেন। পরিবারের কেউই সেভাবে পাড়ায় মেলামেশা করতেন না। খুব কম সময়ের জন্য বেরোতেন মাজেদ। বাসার গেটে সব সময় থাকতো তালা। বাইরের কেউই কোনোদিন বাসার ভেতরে যায়নি।
এমনকি মাজেদের পাশের রুমের ভাড়াটে দৌলত আলমের কথায়, কোনোদিন সেভাবে কথা বলতে দেখিনি। যাতায়াতের পথে সেলাম ছাড়া কিছুই কথা হতো না। ঈদের সেমাই কোনোদিন দেওয়া-নেওয়া হয়নি। আমরা ভাবতাম, মহল্লার মুরুব্বি আদমি আছে তাই বেশি ঘাটাতাম না। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় কারণে চাঁদা চাইলে কোনোদিন নাও করেননি।
শফিক জানান, তার জানা মতে বাসার ভেতরে সেরকম কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মাজেদের বসবাস কালে শফিকও নিজেও কোনোদিন রুমের ভেতরে ঢুকতে পারেননি। তবে প্রতি মাসের ভাড়া ঠিকঠাক দিয়ে দিতেন। মাজেদের শ্বশুরবাড়ি হাওড়ার উলুবেড়িয়ায়। আব্দুল মাজেদ চলে যাওয়ার পর, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে যায় এবং রুমে তারাই তালা দিয়ে যায়।
কলকাতার প্রশাসনিক সূত্র জানায়, পরিচয় গোপন করে মাজেদ লিবিয়া থেকে প্রথমে এলিয়ট রোড সংলগ্ন তালতলায় ছিলেন ৪ বছর। পরে ভিন্ন মতলবে বিয়ে করেন উলুবেড়িয়ার এক মেয়েকে। একে একে নাগরিকত্বসহ নিজের নামে রেশন, ভোটার আইডি কার্ড, পাসপোর্ট সবই বানান। তার মোবাইলে বঙ্গবন্ধুর পলাতক অন্য খুনিদের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য রয়েছে। ভারতের বহুল আলোচিত এনআরসি ইস্যুতেও এলাকার নেতৃত্ব দেন মাজেদ।
তবে এলাকায় পরিচিত ‘ইংরেজির মাস্টারমশাই’ হিসেবে। ইংরেজির পাশাপাশি দারুণ হিন্দিও নাকি জানতেন মাজেদ। আর এলাকায় সখ্যতা বলতে ছিল শুধু এক ওষুধের দোকানির সঙ্গে। সেই দোকানি মাজেদ গ্রেফতারের খবরের পর থেকেই পলাতক। আর চা খেতেন শুধু একটি দোকানেই। বাজার করতেন মহল্লা থেকে।
জানা যায়, ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা চিকিৎসার কারণে বাসা থেকে বের হন মাজেদ। এরপর আর ফিরে আসেননি। আগে কোনোদিনই এরকম করেননি। স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হয়ে স্ত্রী ২৩ ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিট থানায় মিসিং ডায়েরি করেন। তদন্ত শুরু করে পার্ক স্ট্রিট থানা। পুলিশ মাজেদের ভাড়াবাড়ি থেকে একটি ব্যাগ পায়। সেই ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে কয়েকটি সিম কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার আইডি, ভারতীয় পাসপোর্ট ও ঢাকার এক পরিবারের ছবি পায়। ওই ব্যাগ নাকি কাছ ছাড়া করতেন না মাজেদ। টাকাপয়সা সব ওই ব্যাগেই থাকতো। এমনটাই মত এলাকার লোকেদের। আর বাসাভাড়া নাকি ২ হাজার রুপি দিতেন বলে জানান এলাকাবাসী।
তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, যে লোকটা পাড়ায় মিশতেন না, চুপচাপ থাকতেন, সেই মাজেদ কীভাবে পাড়ার লিডার হয়ে ওঠেন? কেনইবা এলাকার লোক তাকে এত পছন্দ করতেন? তাহলে কী কোনো কিছুর নেতৃত্বে ছিলেন এই ‘আলি আহমেদ’? সে তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে মহল্লার অনেকেই বিপদে পড়তে পারে? সে কারণেই কি ওষুধের দোকানের মালিক নিখোঁজ? কী করে একটা অচেনা লোক দীর্ঘ ১৯ বছর কাটিয়ে দিলেন একটি এলাকায়? কী করে বানিয়ে ফেললেন সমস্ত ভারতীয় নথি?
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২০
ভিএস/এএ/এজে