কারবারি আগুলা দা-কে নিয়ে একটু পরেই উঠলাম। মেনতাং কমলাই দা’র ছোটছেলে।
হেডম্যানের বাড়িতে যেনো উৎসব উৎসব ভাব। মাসখানেক পর এলেন। এটা-সেটা মুছছেন, কোনোটি সরিয়ে অন্যকোথাও রাখছেন। এখন তার পুতি (নাতির ছেলে-মেয়ে) হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়েরা আলাদা ঘর তুলেছেন। স্ত্রী নিয়ে তিনি দায়িত্ব পালনে এখন থাকেন আলিকদম সদরে।
২৯১ তৈনফা মৌজার হেডম্যান তিনি। বহুদিন পর তালা দেওয়া বাড়িতে এসে যেনো ফিরে গেলেন পুরনো জীবনে। সেসময় উদয়াস্ত রেংমিটচা ভাষায় কথা বলতেন। সেসব সময় এখন ধূসর অতীত। ধুলো ঝেড়ে সে সময়কার ছবি বের করে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। আঙুল দিয়ে দেখালেন, টগবগে যুবক থাকতে কেমন দেখতে ছিলেন। কোনোটিতে পাশে স্ত্রী, কোনোটি ছেলে-মেয়েসহ।
পা ছড়িয়ে কাঠের বাটিতে মরিচ পিষছেন ম্রোবাহিনীর সদস্য কমলাই দা। ঘরের মধ্যে এককোণে মাটি ফেলে চুলা পাতা। ম্রোদের সব বাড়িতেই একইরকম ব্যবস্থা। শীতের সময় কাঠ জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখা এবং আগুন পোহানোর কাজটিও হয়ে যায় একইসঙ্গে। পশ্চিমাদের ঘরে ফায়ার প্লেস রাখার যে অভিজাত ব্যাপার, তা আমাদের আদিবাসীরা চর্চা করে আসছেন তাদেরও আগে থেকে।
যাহোক, চুলায় হাঁড়ি চড়ে জুম চালের। গরম ভাতের সুগন্ধে ঘর ভরে যায়। সঙ্গে পাহাড়ি কুমড়ার তরকারি ও মুরগি ভুনা। খিদে দ্বিগুণ নয়, বেড়ে যায় চারগুণ।
দুপুর অব্দি পাহাড়ে ওঠা-নামা করে যে খিদে পেয়েছে, তাতে সামনে মাটি আর পাতা দিলেও নিমেষে নেই হয়ে যেতো! সেখানে সামনে হাজির হয় কলাপাতায় মোড়ানো গরম ভাত এবং আরও যা যা রয়েছে। প্রথম পনেরো মিনিট কোনো কথা হয় না, এরপর ধীরে ধীরে টিনের থালা থেকে মাথা ওঠে। পেটপূর্তি খেয়ে ভাতঘুমে পেয়ে বসে।
এরকম সুখসময়ের ফাঁকে দুঃসংবাদ আসে, হেডম্যান পাড়ার কারবারি (পাড়া প্রধান) হক্কে ম্রো দক্ষিণের তিনওয়াই পাড়ায় বিচারে গেছেন। আশি ছুঁই ছুঁই এ বয়ঃজ্যেষ্ঠ রেংমিটচা ভাষা জানেন।
এদিকে, ভরপুর মধ্যাহ্নভোজের পর আয়েশ করে পান নিয়ে বসেন হেডম্যান। গামারি কাঠের তক্তার ফাঁক দিয়ে পিক ফেলতে ফেলতে বলেন, পাকিস্তান পিরিয়ডে আমার পাড়াসহ আশেপাশে চার-পাঁচ পাড়ার অধিকাংশই রেংমিটচা ভাষা জানতো। রেংমিটচা ভাষাতেই কথা বলতাম আমরা।
হেডম্যান বলে চলেন, রেংমিটচা ভাষায় কথা বলা ম্রোরা এই পাড়াগুলোতেই বেশি থাকতেন। এরপর সবাই বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যেতে থাকেন। অন্য অঞ্চল থেকেও ম্রোরা এই পাড়াগুলোতে থাকতে শুরু করেন। তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষা নিয়ে আসেন। ম্রোদের মধ্যে অঞ্চলভেদে অনেকগুলো ভাষা রয়েছে।
পাশ থেকে বলে ওঠেন কমলাই ম্রো, অনেক রেংমিটচা জানা ম্রো মায়ানমার চলে গেছেন। অনেকে উঁচু পাহাড়ের গভীর বনের দিকে ঢুকে গেছেন।
এখন ম্রোদের মধ্যে দমরং ভাষা বেশি চলে। আবার তারা চলে গিয়ে যদি মুরুংচা বা সাংমা (ম্রোদেরই ভাষা) বলা লোক এখানে বেশি চলে আসেন, ওটাই বলবে সবাই। তখন রেংমিটচার মতো দমরং ভাষাও হারিয়ে যাবে, যোগ করেন কমলাই।
এরকম ধারণা হেডম্যানের স্নাতক পাস নাতি সাকনাও-ও আলিকদম বসে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, চিম্বুকের দিকে অনক, থানচিতে সাংমা, আলিকদমে ডওপ্রেং ও দমরং ভাষাটি বেশি চলে। মিশ্রিতভাবে তামছা ভাষাটিও বলেন অনেকে। এর মধ্যে রেংমিটচা এখন একেবারেই কেউ বলে না। এমনকি ভাষাটি জানা লোকের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এভাবে একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে রেংমিটচা।
কম কথা বলা আগুলা দা তাড়া দেন। সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। এক্ষুণি না বেরোলে বেলা থাকতে তিনওয়াই পাড়ায় পৌঁছানো যাবে না। তখন এখানেই থেকে যেতে হবে। পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে খুব তাড়াতাড়ি।
এরপর গন্তব্য তিনওয়াই কারবারি পাড়াতেই। সেখানে রেংমিটচা ভাষা জানা পাঁচজন রয়েছেন। হক্কে ম্রো আগে থেকেই ওখানে রয়েছেন, সঙ্গে হেডম্যান যোগ হলে রেংমিটচা ভাষায় সাতজনের জমাটি আড্ডা হবে।
ভাতঘুম দূরে ঠেলে আবারও পা চলে। আঁধার জেঁকে বসার আগেই আরও উঁচু পাহাড়ে চড়তে হবে। এই মানুষগুলো হারিয়ে যাওয়ার আগে সংরক্ষণ করতে হবে রেংমিটচা ভাষাটিও!
**পাহাড়-ঝিরি পেরিয়ে রেংমিটচার টানে
**‘পাড়ায় গিয়ে রেংমিটচা ভাষার সব দেখাবো’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৭
এসএনএস/এসএইচ