এরইমধ্যে তেজ হারিয়েছে মাঘের সূর্য। জিরানী খালের পচা পানিতে হিম জমতে শুরু করেছে।
বাস্তবিকই কিন্তু সাঁকোর ওপর থেকেও টের পাওয়া যাচ্ছে নিচের পচা কাদা-পানির দুর্গন্ধ। দু’পাড়ের অবৈধ স্থাপনা নদীর বুকে এগিয়ে আরো সরু করে দিয়েছে মরা খালটাকে। অথচ এক সময় বড় বড় নৌকা চলতো এ পথে। বালু থেকে বুড়িগঙ্গা আর বুড়িগঙ্গা থেকে বালুতে আসা যাওয়া করতো পণ্য বোঝাই বাণিজ্য বহর।
রামপুরা হয়ে বালুর দিকে এগিয়ে যাওয়া নড়াই নদীতে এই খাল আর দেবধোলাই মিশে ত্রিমোহনী নামে যে গুদারাঘাটের জন্ম দিয়েছে, সেটাও এখন মৃতপ্রায়। তুরাগ-বালুর সংযোগ হিসেবে এখন আর কাজ করে না নড়াই। রামপুরা ব্রিজ থেকে বালু নদীর দক্ষিণ পাড়া পর্যন্ত ছোট ছোট নৌকা এখনো চলে বটে, তবে পণ্যবাহী বড় নাও বর্ষা ছাড়া চলেই না। আর জিরানী খাল হিসেবে পরিচিত নন্দীগ্রাম-ত্রিমোহনী অংশটা তো এখন বছরভরই মরে আছে। নদী দখল করে ভেঙচি কাটছে পাকা-কাঁচা মার্কেট আর ব্যক্তি মালিকানার সাঁকো-সেতু। মরা নদীর বুকে শুয়ে ব্যঙ্গ করছে ওয়াসার স্যুয়ারেজ পাইপ।
অথচ খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে ঢাকায় মসলিন শিল্প নামে যে সভ্যতা বিকশিত হয়েছিলো তার সঙ্গে ধোলাই শব্দটির সম্পর্ক ছিলো অঙ্গাঙ্গী।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, খুবই খরস্রোতা নদী ছিলো বালু আর বুড়িগঙ্গার সংযোগ নদী ধোলাই। এ নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছিলো মসলিন পল্লী। ডেমরার কাছে এখন যে জামদানি হাট সেটাও ওই মসলিন শিল্পেরই ক্ষয়িষ্ণু ধারা। যে মসলিন কাপড় রঙ করার পর ধুয়ে নিতে হতো ভালো করে। আর এই নদীতে পেতে রাখলে এমনিতেই ধোয়া হয়ে যেতো মসলিন কাপড়। এ নদীর নাম তাই ধোলাই হয়ে যায়। আর উপ বা শাখা নদী হিসেবে তার সঙ্গে মিশে থাকে দেবধোলাই-যার উৎস বা পতিত মুখ নড়াইয়ের ত্রিমোহনী।
মূলত এই ত্রিমোহনী বাজারে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে এসে মিশেছে মান্ডা খালের দুই ধারা। মানিকনগরের দিক থেকে বেরিয়ে এই দুই ধারা মূলত ভাগ হয়েছে পুরনো ঢাকা হিসেবে পরিচিত মসজিদের শহর মান্ডায়।
একটি ধারা উত্তর-পূর্বে এগিয়ে আহমেদাবাদ, কদমতলা, দক্ষিণ বাসাবো ও পূর্ব গোড়ানকে বাঁয়ে রেখে এবং নতুনপাড়া ও নন্দীপাড়াকে ডানে রেখে রামপুরা খালে পড়েছে ত্রিমোহনী বাজারে। অপর শাখাটি মাণ্ডা রোড বরাবর বেশ কিছু দূর পূর্বে এগিয়ে বাঁক নিয়েছে উত্তরে। এরপর মানিকদিয়া, শেখের জায়গা পেরিয়ে মিশেছে নন্দীপাড়া বাজারে। পূর্বদিকে নাসিরাবাদের কাছে বালুর উত্তর দিক থেকে বেরিয়ে দাসের কান্দি হয়ে আরো একটি শাখা এসে মিশেছে ত্রিমোহনীর একটু পূর্ব দিকে। এগুলোর মধ্যে ধোলাইখালের দিক থেকে দয়াগঞ্জ-মানিকনগর হয়ে আসা যে ধারাটি সোজা ত্রিমোহনীর দিকে এগিয়ে এসেছে তার পরিচিতি এখন কেবল খাল হিসেবে। তবে জিরানী খাল হিসেবে এর নাম আছে ঢাকা ওয়াসা’র খাতায়। তার পশ্চিম-উত্তর ছুঁয়ে শুয়ে থাকা সড়কটার নাম খালপাড় সড়ক।
এ সড়কেরই খালপাড়ের সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। খাল পাড়ের লোকালয়ে লোকালয়ে এখন তারই আলোচনা। খাল উদ্ধার হলে কাদায় নামতে পারবে কি না সে চিন্তায় বিভোর রাহুলের মতো কৌতূহলী শিশুরা।
এ নদীর সুস্থ ধারা দেখার সৌভাগ্য ওদের হয়নি বটে, কিন্তু বয়সীদের মুখে শুনে শুনে এ নদী সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা ওরা লালন করে বুকের ভেতর। বছর দশেক আগেও নাগরিক জীবনের হ্যাপা ছোঁয়নি এই খালকে। বন্যায় তখন পাড় উপচাতো জিরানী খালের। কিন্তু নগরায়নের ধাক্কায় এর বাঁকে বাঁকে এখন জীবন হারানোর হাহাকার। সেই নদীটায় ফের আনাড়ি হাতে মাছ ধরার স্বপ্ন দেখে রাহুলরা, শরীর জুড়িয়ে নিতে চায় স্নিগ্ধ সলীলে। সেজন্য কিন্তু কেবল উচ্ছেদই যথেষ্ট নয়, খনন কাজও জরুরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১৬
এইচএ/জেডএম/