ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নদীর খালও মরে দখলের খাঁড়ায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৭
নদীর খালও মরে দখলের খাঁড়ায় বুড়িগঙ্গার বিলুপ্তপ্রায় ধারার হাজারীবাগ-কামরাঙ্গীরচর দু’পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে এমন অজস্র অবৈধ স্থাপনা। ছবি: শোয়েব মিথুন

হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ ঘুরে: নাটাই নেই। ঘুড়িটাও বানানো হয়েছে দু’টো কাঠিকে ভেঙে তার ওপর হলদে কাপড় পেঁচিয়ে। ২০-২২ হাত সুতো দিয়ে ঘুড়িটাকে ওড়াতে চায় ১০-১১ বছরের কিশোর রনি। কামরাঙ্গীরচর আর হাজারীবাগের সেকশনকে জোড়া দেওয়া ছোট্ট ব্রিজটার একবার এ মাথায় দৌঁড়ায় তো, আরেকবার ও মাথায়। 

কিন্তু ঘুড়ি ওড়ে না। উড়বে কেন? বাতাস কোথায়? ঘুড়ি নিয়ে দৌঁড়াবার খোলা মাঠ কোথায়? রনি থেমে যায়।

মন খারাপ হয় বোঝা যায়। খানিকবাদে সুতো টেনে গুটিয়ে নেয় ঘুড়িটা।

ঢাকার পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বিশাল জলরাশির বুড়িগঙ্গায় একসময় চর গজিয়ে ওঠে, কামরাঙ্গীরচর। এই চরের কারণে বিভাজিত হয় বুড়িগঙ্গার প্রবাহ। মূল নদী সরে যায় দূরে। ইট-সিমেন্টের জঙ্গলে আড়ালে পড়ে যায় হাজার সৈন্যের আবাস থেকে নাম পাওয়া মুঘল হাজারীবাগ আর হাতিশালা থেকে মহল্লা হয়ে ওঠা গজমহল।  

হাজারীবাগ ঘেঁষে প্রবাহিত স্রোতধারায় অসাধু চক্রের নজর পড়লে খাল হয়ে ওঠে আবর্জনার ভাগাড়। এরপর গড়ে তোলা হয় বাঁশ-কাঠের খুটির ওপর টিনের বেড়া-চালার ছোট ছোট দোকান, তারপর ইট-পাথরের দালান-কোঠা, রিকশার গ্যারেজ আর বড় বড় মার্কেট। বিদ্যুতের একটা সাব স্টেশনও গড়ে তোলা হয় খালের ওপর। খালপাড়ের আলগা মাটির ওপর চেপে বসে পুলিশ বক্স, রাজনৈতিক দলের শাখা অফিস। ছিল স্বচ্ছ স্রোতধারা।  এখন এই খাল দিয়ে যায় কেবল স্যুয়ারেজ লাইনের পানি।  ছবি: আনোয়ার হোসেন রানাদখলে দখলে বুড়িগঙ্গার এই অংশটা এখন গুটিয়েই গেছে। ‘নেই’ হয়ে গেছে নদীর বিশাল-বিস্তৃত পাড়, জলধারা আর এর গা জুড়োনো বাতাস!

আহা! ভাবতেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ইসলামবাগের ষাটোর্ধ্ব দুলু মিয়া। ২০-২৫ বছর আগেও সেই গা জুড়োনো বাতাস ছিল বুড়িগঙ্গার এই পাড়টায়। নদীর পানি কী স্বচ্ছ ছিল! সোয়ারীঘাট-আলীরঘাট থেকেই নৌকা নিয়ে একেবারে সেকশন, ঝাউচর হয়ে বুড়িগঙ্গা বেয়ে সাভারের আমিনবাজার যেতে পারতেন। চোখের সামনে কীভাবে দখল হয়ে গেল নদীটা। এখন তো সেকশনের পর থেকে পরের অংশটা বোঝাই যায় না যে এদিকে কোনো স্রোতধারা ছিল।

সেদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দিয়েছেন রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলো দখলমুক্ত করার এবং বেড়িবাঁধের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করার। যেন বর্ষায় এ খাল-নদী দিয়ে দ্রুত সরে যেতে পারে পানি। তিনি সিটি করপোরেশন এলাকার খালপাড়গুলোর সৌন্দর্য বর্ধনের কথাও বলেছেন।

বুড়িগঙ্গার বিলুপ্তপ্রায় ধারার হাজারীবাগ-কামরাঙ্গীরচর দু’পাড় ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে এমন অজস্র অবৈধ স্থাপনা।  ছবি: আনোয়ার হোসেন রানাহাজারীবাগের সেকশন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে বুড়িগঙ্গা দেখার সময় খাল হয়ে যাওয়া ধারাটাই যেন প্রশ্ন ছুঁড়ছিল, এই যে মহীরূহ ভবন, মার্কেট, এমনকি সরকারি সড়ক-কার্যালয়, এসব উচ্ছেদ করবে কে? বুড়িগঙ্গার এই অংশের ধারা ফেরানোর উদ্যোগইবা নেবে কে?

এই প্রশ্ন আরও বেশি ভাবাবে ঝাউচরের আরএস সিএনজি ফিলিং স্টেশনের পাশ থেকে সেকশন পর্যন্ত অস্তিত্বহীন অংশটি। বয়স্কদের মতে, সোয়ারীঘাট-আলী ঘাট থেকে যে অংশটা হাজারীবাগ ঘেঁষে ঢুকেছে, সেটা ঝাউচরের পাশে এসেই আবার বুড়িগঙ্গার এখনকার মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু সোয়ারীঘাট থেকে সেকশন পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার ধারাটা বোঝা গেলেও তারপর ঝাউচর পর্যন্ত আবর্জনার ভাগাড়, মার্কেট, ভবন, হোটেল, হকার, মাজার, উপাসনালয়, বিভিন্ন কারখানার নিচে চাপা পড়া বুড়িগঙ্গা যেন অতলে হারিয়ে গেছে। দখলদারদের স্থাপনা এতোই শক্ত হয়ে গেড়েছে যে, কামরাঙ্গীরচর-হাজারীবাগকে এখন একই ভূখণ্ড ভাবাটাও বোকামি ভাবার সুযোগ নেই।

আবার সেই প্রশ্ন, এই মহীরূহ সব স্থাপনা সরানোর উদ্যোগে কি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারবেন মেয়র?

খাল যেন আবর্জনার ভাগাড়।  ছবি: শোয়েব মিথুনআলীর ঘাটে বসে সাহস-প্রেরণার বুলি ছোঁড়েন সেই দুলু মিয়া, “মেয়র কইছেন। আর কী। সরকার চাইলে সব সম্ভব। কী দিন আছিল, কী দিন হই গেছে! এই খাল আবার ঠিক হইয়া (উদ্ধার) গেলে আগের মতো মানুষ গাবতলী-আমিনবাজার যাইতে পারবো কতো সহজে। ”

বুড়িগঙ্গার পাড়জুড়ে এখন এমনই সাহস আর স্বপ্নের কথা। মেয়র এখানে হাতিরঝিলের আদলে ‘বঙ্গবন্ধু ঝিল’ বানাবেন বলেছেন বলে শুনেছেন তারা। যদি তা হয়, তবে ঢাকার মানুষ এবার হাতিরঝিলে যেমন যায়, আসবে তেমনি বুড়িগঙ্গার পাড়ে কল্পনার ‘বঙ্গবন্ধু ঝিলে’।

আলীরঘাট ঘেঁষে ইসলামবাগ মসজিদ সংলগ্ন রিকশা গ্যারেজের ফাঁক গলে একটু জায়গা নিয়ে তখন ঘুড়ি উড়াচ্ছিল আরও দুই কিশোর। দু’জনেই থাকে ইসলামবাগে। এই ঘুড়িতে নাটাইও আছে, উড়ছেও বহুদূরে। বিদ্যুতের খুঁটির তার পেরিয়ে যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। মেয়র সাঈদ খোকন বুড়িগঙ্গার এই পাড়টা নিয়ে যে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখছেন, এই ঘুড়ি বুঝি সে স্বপ্নকেই সাহস যোগাচ্ছে!

বাংলাদেশ সময়: ২১২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৭
এইচএ/জেডএম/

আরও পড়ুন
** উচ্ছেদের ঘোষণায় হাত গোটালো দখলদাররা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।