এরশাদ প্রথমবার বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ওপাশের জিনজিরা (কামরাঙ্গীরচর) যাচ্ছেন। মোহাম্মদপুর থেকে হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ হয়ে ইসলামবাগ এসে এখানকার আলীরঘাট নেমে নৌকায় জিনজিরা ঘাটে উঠবেন তিনি।
অথচ দুই আড়াই দশক আগেও বুড়িগঙ্গার দশা এমন বেহাল ছিল না। স্বচ্ছ জলের এ নদীতে মানুষ মাছ ধরেছে, গোসল করেছে, সাঁতার কেটেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রান্না পর্যন্তও হয়েছে এ বুড়িগঙ্গার পানিতে। সেই স্মৃতিচারণে শ্বাস দীর্ঘ হয় ষাটোর্ধ্ব রাশেদ মিয়ার। তার চোখের সামনেই মিষ্টি-চিকচিক করা পানি কেমন কালচে-দুর্গন্ধময় হয়ে গেলো। বিশাল-বিস্তৃত জলরাশির বুড়িগঙ্গা কেমন খাল হতে হতে বুজে যাওয়ার উপক্রম হলো।
২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সোয়ারীঘাট-আলীরঘাট থেকে জিনজিরা ঘাটে যাত্রী পারাপার করছেন তিনি। রাশেদ মিয়ার বাড়ি বিক্রমপুরে (মুন্সীগঞ্জ)। আলীরঘাট থেকে জিনজিরা ঘাট পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৩০টা নৌকা যাত্রী পারাপার করে। খানিক আগেই ৬ জন করে যাত্রী নিয়ে দু’টো নৌকা ছেড়ে গেছে। সিরিয়ালে রাশেদ মিয়ার নৌকা পরের তিন নম্বরে। তার আগে আছেন শফিকুল, কবির ও সোনামিয়া। প্রথম দু’জনের বাড়ি বরিশালে, পরেরজন শরীয়তপুরের। সবাই ভাড়া বাসায় জিনজিরায় থাকেন।
আলীরঘাট থেকে জিনজিরাঘাটে পারাপারে এখানকার মাঝিরা যাত্রীপ্রতি ভাড়া নেন ৫ টাকা করে। ভোর ৫টা-৬টা থেকে রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত পারাপার করেন। মাঝে থাকে দুপুরের খাবার-চা নাস্তার বিরতি। কেউ কেউ কয়েক ঘণ্টা নদীতে থেকেই উঠে যান, কেউ থাকেন সারাদিন। সারাদিন কাজ করলে ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। ঘাটের ইজারাদারকে প্রতিদিন দিতে হয় ৬০ টাকা করে। নৌকা কিনে আনা হয় টাঙ্গাইল থেকে। কাঁঠাল গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি এ নৌকাগুলোর দাম পড়ে ১৮-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসি) মেয়র সাঈদ খোকন রাজধানীর খাল ও বেড়িবাঁধ দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের ঘোষণা দেন। স্থানীয়দের বলেন বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যবর্ধন করে এখানে ‘বঙ্গবন্ধু ঝিল’ বানানোর কথাও।
এ বিষয়টি জানেন কিনা আলাপ করলে রাশেদ-শফিকুল-কবির-সোনামিয়াদের মুখে হাসি খেলা করে। তারাই প্রশ্ন করেন? “খাল কি সত্যি উদ্ধার হইবো?”
মেয়র তো বলেছেনই, তাছাড়া ওই যে সোয়ারীঘাট থেকে তো এরমধ্যে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরুই হয়ে গেছে। এ কথায় এবার খানিকটা স্বস্তি প্রকাশ করতে চান বুড়িগঙ্গার নোংরা পানির মধ্যে থেকে জীবিকা খোঁজা মাঝিরা। শফিকুল বলেন, “যদি নদী আগের মতো হয়ে যায়, তাইলে তো ভালোই হইবো। মানুষের নাক-মুখ চেপে বুড়িগঙ্গায় আসতে হইবো না। রোগবালাই ধরবো না। ”
তবে সম্ভব কিনা সে উদ্বেগও ঝরে মাঝিদের কণ্ঠে। সোনামিয়া বলেন, “এদিকে তো তাও এখন নৌকা চলে। ওই দিকে সিকশন-ঝাউচরের দিকে তো সব মার্কেট, ময়লার স্তূপ, দালান-কোঠা, রিকশার গ্যারেজ, অনেক পার্টির অফিস, বিদ্যুতের অফিস (সাব স্টেশন)। এতো কিছু উচ্ছেদ করা যাইবো?”
সোয়ারীঘাটের উচ্ছেদ কার্যক্রমের দিকে হাত তুলেই সায় দিতে চান শফিকুল। বলেন, “অল্প অল্প কইরা কাজ করে, ক’দিন লাগে কে জানে? তবে সরকার তো কইছে, ইচ্ছা থাকলে হইবো। ”
সেজন্য সাহস যোগান রাশেদ-সোনামিয়া-শফিকুল-কবিররা, “নদী উদ্ধারের কাজে সবাই খুশি হইবো। সরকার আসুক। মেয়র এ কাজ করলে এই দুই পাড়ের মানুষ তার জন্য দোয়া করবো। ”
যদি বুড়িগঙ্গার এই দখল হওয়া অংশটা উদ্ধার হয়ই, তবে এখানে মেয়রের কথা মতো ‘বঙ্গবন্ধু ঝিল’ গড়ে উঠবে। তখন মানুষ এদিকেও বেড়াতে আসবে। তাহলে কী হবে? সোনামিয়াই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “মানুষ বেড়াতে এলে তো আমাদের আয়-ইনকামও বাড়বো। এলাকাও উন্নত হইবো, দেশও উন্নত হইবো। ”
বোঝা গেল উন্নয়নের স্বপ্নের সঙ্গে এখন বুড়িগঙ্গার এই মাঝিরা স্বচ্ছ জলের ফের নাও বাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ফিরবে কি সে সুদিন?
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৭
এইচএ/জেডএম/
আরও পড়ুন
** উচ্ছেদের ঘোষণায় হাত গোটালো দখলদাররা
** নদীর খালও মরে দখলের খাঁড়ায়