১৯৮১ সালের আজকের এই দিনে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিচারণে বঙ্গবন্ধু কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার (১৭ মে) গণভবনে অনির্ধারিত এক অনুষ্ঠানে এভাবেই স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতা করছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান আওয়ামী লীগ এবংএর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘিরে ঘরের ও বাইরের ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধু হত্যা, পরবর্তী দুঃসময়, ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসার পর সংগঠনের বিভক্তি, সংগঠন গোছানো, দেশের মানুষের কাছে যাওয়া, নানান প্রতিবন্ধকতা ও ঘুরে দাঁড়ানোর স্মৃতিচারণ করেন।
পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘কখনো ভাবতেও পারিনি এ রকম ঘটনা আমাদের জীবনে আসবে। ৭৫ এর কালো দিন আমাদের জীবনের সব কিছু কেড়ে নিয়েছিলো। ’
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর যারা ছিলো, তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিলো। যারা এ দেশের স্বাধীনতাই চায়নি, মূলত তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ’
‘এ হত্যাকাণ্ডটা হয়েছে ইতিহাসকে পুরোপুরি পরিবর্তন করতে... বিজয়কে একেবারে অর্থহীন করে দিতে। ’
ষড়যন্ত্রকারীদের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুর্ভাগ্য এখানে আমাদের দলের, আমার বাবার ক্যাবিনেটের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাকসহ অনেকে জড়িত ছিলো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। ’
‘আসলে ঘরের শত্রু বিভীষণ। ঘরের ভেতর থেকে শত্রুতা না করলে বাইরের শত্রু সুযোগ পায় না। ’
‘যারা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত তাদের অনেকে আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করতো। ’
প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘ডালিম, ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, ডালিমের শালি, ২৪ ঘণ্টা আমাদের বাসায় পড়ে থাকতো। ওঠা বসা,খাওয়া-দাওয়া সবই। ’
‘মেজর নূর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলো। তখন কামালও ওসমানীর এডিসি ছিলো। দু’জন একসঙ্গে কর্মরত ছিলো। ’
‘এরা তো অত্যন্ত চেনা মুখ। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কর্নেল ফারুক ক্যাবিনেটের অর্থমন্ত্রী মল্লিক সাহেবের শালির ছেলে। এভাবে যদি দেখি এরা কেউ দূরের না, এরাই যড়যন্ত্র করলো। ’
জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়া জড়িত ছিলো। ’
‘জিয়াউর রহমানের যে পারিবারিক সমস্যা ছিলো সেটা সমাধানের জন্য সেনাবাহিনীতে এক পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছিলো। তার পারিবারিক সমস্যা সমাধান করে দেওয়া হয়েছিলো। ’
‘জিয়াউর রহমান প্রায়ই, প্রতি সপ্তাহে একবার তার স্ত্রীকে নিয়ে ওই ৩২ নম্বর বাড়িতে যেতো। ’
ষড়যন্ত্রকারীদের কপটতার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বলেন, ‘এদের আন্তরিকতা নয়; চক্রান্ত করাটাই ছিলো তাদের লক্ষ্য। সত্যি কথা বলতে কী, সেটা কেউ বুঝতে পারিনি। ’
‘আমরা খোলা-মেলা মানুষের সঙ্গে মিশতাম, সকলের জন্য অবারিত দ্বার। ’
বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মোশতাক তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। যারা এভাবে বেঈমানি করে তারা থাকতে পারে না। ’
‘মীর জাফরও তিন মাস থাকতে পারেনি। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মোশতাক রাষ্ট্রপতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। এতে স্পষ্ট যে তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিলো এবং ষড়যন্ত্র জড়িত ছিলো। ’
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের ভূমিকার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৬ তারিখে ড. কামাল হোসেন আসলেন বনে (জার্মানির শহর) হুমায়ুন রশিদ সাহেবের বাসায়। রেহানা ছোট, সে বললো চাচা আপনি মোশতাকের মন্ত্রিত্ব নেবেন না। আপনি প্রেস কনফারেন্স করেন, আপনি এ হত্যার প্রতিবাদ করেন। ’
‘হুমায়ুন রশিদ সাহেব প্রেস কনফারেন্সের ব্যবস্থা নিলেন। কিন্তু উনি কোনো কথা বলতে রাজি হলেন না। হত্যার নিন্দা জানানোর একটা কথাও উনি বললেন না। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘হুমায়ুন রশিদ সাহেব নিজে আমাদের নিয়ে প্রেসের সামনে বসেন এবং হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান। ’
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বিদেশের মাটিতে ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে যাপিত কষ্টের দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
পরে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিসেস (ইন্দিরা) গান্ধীকে বার্তা পাঠালাম আমরা ভারত চলে এলাম। দেশের কাছে আসি। হয়তো ডিটেইল খবর পাবো। কেউ যদি বেঁচেও থাকে। ...যদি কেউ বেঁচে থাকে ইন্ডিয়াতে এসে শেল্টার নেবে। ’
বিদেশের মাটিতে থেকে দেশের মাটিতে কী ঘটেছে তার পুরো খবর পেতেন না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কখনো শুনি মা বেঁচে আছেন, কখনো শুনি রাসেল বেঁচে আছে। একেক সময় একেক খবর পেতাম। সঠিক খবর পেতাম না। ’
‘২৪ আগস্ট দিল্লিতে পৌঁছাই। মিসেস গান্ধী আমাদের ডাকলেন। ওনার কাছ থেকে শুনলাম কেউ বেঁচে নাই। ’
‘হুমায়ুন রশিদ সাহেব আগে বলেছিলেন। কিন্তু, আমি রেহানাকে বলতে পারি নাই। কারণ, ওর মনে একটা আশা ছিল, কেউ না কেউ বেঁচে থাকবে। ’
অর্থের কারণে ১৯৭৭ সালে বোন শেখ রেহানার বিয়েতে লন্ডনে যেতে না পারার বেদনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে যাবো, অত টাকা ছিল না। আর, কোথায় থাকবো?’
নির্বাসিত জীবনে অনটনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘টাকাও ছিল না। আর, কার কাছে হাত পাতা.. ভালো লাগতো না। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই না আমরা যেভাবে সব একদিনে হারিয়েছি, এরকম কেউ হারাক। এটা যে কী কষ্টের, যন্ত্রণার—কাউকে বোঝানো যাবে না। ’
দেশের তরে বাঙালির তরে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও ত্যাগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব কিছু বিলীন করে দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষের জন্য। মানুষের স্বার্থে। ’
‘যিনি বাংলাদেশের জনগণকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছিলেন, তাদের একটা বিক্ষিপ্ত অংশ, তাদের গুলিতে জীবন দিতে হলো। ’
‘বঙ্গবন্ধু যখন দেখেছেন যে তাকে গুলি করছে তারই দেশের লোক, তার হাতে গড়া ওই সেনাবাহিনীর সদস্য। তার হাতে গড়া মানুষ। জানি না তার মনে তখন কী প্রশ্ন জেগেছিলো?’
বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট নিহত সবার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক তৎপরতা, দেশে ফিরে নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার পাশাপাশি সারাদেশ ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে যাওয়া এবং জিয়াউর রহমান সৃষ্ট দেশের মাটিতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুনিরা বহাল তবিয়তে বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত। স্বাধীনতার বিরোধীরা তখন বহাল তবিয়তে। তারাই ক্ষমতার মালিক। যে পরিবারকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো, সে পরিবারের একজন এসে রাজনীতি করবে...। ’
‘সেটা এত সহজ ছিল না, প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা ছিল। ’
দেশের বাইরে নির্বাসনে থাকার সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এত বড় সংগঠন করার অভিজ্ঞতাও আমার ছিলো না। আমার চলার পথ অত সহজ ছিল না। ’
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৪ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৭/আপডেট ১৮২১ ঘণ্টা
এমইউএম/এইচএ/