কিন্তু ‘সর্ষের মধ্যেই যে ভূত’ লুকানো সেটা টের পেতে দেরি হলো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন বঙ্গবন্ধুকে।
বলা হচ্ছে ‘আপন আলোয় বিশ্ব ভুবন’ নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের আদ্যপান্ত নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী সম্পাদিত বইয়ের কথা। যে বইয়ে নিয়ম, অনুমতির তোয়াক্কা না করে ভুল-ভাল বানান-বাক্যে পুরোটাই ডাহা চুরি করেছেন তিনি। নিজস্বতা বলতে কিছু ‘ভুল’ ছাড়া তাতে কিছুই নেই। কপি-পেস্ট করে ভাওতাবাজির পাশাপাশি বইটি মৌলভীবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষিকা অঞ্জনা ঘোষের সহায়তায় প্রকাশ করেছেন।
** বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিকুলের ভুলে ভরা বই শিক্ষার্থীদের হাতে
প্রকাশের পর ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঘটা করে প্রকাশনা উৎসবও করেছেন বিকুল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোবাশশেরুল ইসলাম, সাবেক স্বাস্থ্য পরিচালক, সিলেট ডা. হরিপদ রায়, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দিলীপ কুমার বর্ধন, মোহাজিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. কামরুল হাসান বিদ্যালয়ের স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. সেলিম আহমেদ প্রমুখ।
শুধু তাই নয়, বইটি গত মাসের ২২ অক্টোবর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ছয়দিন আগে মৌলভীবাজার শহরের কাশিনাথ আলাউদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল দুই নেতার উপস্থিতিতে সুকৌশলে বই বিতরণ করান বিকুল চক্রবর্তী। অপ্রয়োজনীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা অংশে জিয়াউর রহমানকে টানা, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংস হত্যার বিষয় বর্ণনায় দোসরদের এড়িয়ে এক, দু লাইনে শেষ করে দেওয়া, বঙ্গবন্ধুকে ‘তিনি বলে’ সম্বোধন করা, জহুর আহমেদ চৌধুরীকে জহুরুল লেখা ছাড়া অসংখ্য বানান-বাক্যে অসঙ্গতি রয়েছে বইটি।
ভুলে ভরা বইটি খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, যশোর, নড়াইল, ঢাকা, নায়ায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে ২০ টাকা মূল্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলে জোর করে বিক্রিও করা হচ্ছে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে- ১৯২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার মৃত্যু পর্যন্ত সাল উল্লেখ করে যে সংক্ষিপ্ত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার পুরোটাই কপি-পেস্ট করা। সরকারি শিক্ষকদের সরকারিভাবে পরিচালিত ওয়েবসাইট ‘শিক্ষক বাতায়ন’ এ ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর প্রকাশিত ‘এক নজরে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে প্রকাশিত হয়েছে। বহু পত্র-পত্রিকা-টিভি চ্যানেলে কাজ করা, অপরাধে চাকরিচ্যুত হওয়া, শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব থেকে বহিষ্কৃত সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তী এই ওয়েবসাইট থেকে নিবন্ধটি হুবহু কপি-পেস্ট করে নিজে সম্পাদনা করেছেন বলে চালিয়ে দিয়েছেন। চালাকি করে তিনি বইয়ের তথ্যসূত্রও প্রকাশ করেননি।
নাটরের গুরুদাসপুর পাইলট হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. রাসেল নিবন্ধটি লিখেছেন বলে ওয়েবসাইটের নিচে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। রাসেলের লেখা কপি-পেস্ট করে বিকুল কিছু বানান ঠিক করার চেষ্টা করেছেন মাত্র। তবে সে চেষ্টা একেবারেই বৃথা গেছে। বইটির ৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ১৯৪৬ সালের প্যারায় ‘প্রদেশিক’, ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ১৯৪৮ সালের প্যারায় ‘হিশাব’ ও ‘তৎক্ষণিক’, ৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ১৯৭০ সালের প্যারায় ‘জলোচ্ছাস’ ১০নম্বর পৃষ্ঠায় ১৯৭১ সালের প্যারায় ‘অসযোগ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু বলে’, ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ১৯৭২ সালের প্যারায় ‘পাশ’ ১৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উপর থেকে ৭ম লাইনে ‘আকাক্ষা’, ২৯ নম্বর লাইনে ‘জাতীর’ প্রভৃতি বানান এবং সম্বোধনসূচক ভুল তার সামান্য উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অযত্ন-অবহেলায় এহেন দায়সারা কাজ জানাজানি হলে স্থানীয় এমপি, ইউএনও, আওয়ামী লীগ নেতা ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বাংলানিউজের কাছে। তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান।
এলাকাবাসীর কাছে ‘ধান্ধাবাজ’ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত বিকুলের পরিচিতি:
কে বিকুল চক্রবর্তী?
বিকুল চক্রবর্তী সম্পাদিত আপন আলোয় বিশ্বভুবন এ বইয়ের শেষ পাতায় একটি অংশে উল্লেখ করা হয়েছে- তিনি দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার, একুশে টেলিভিশন, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম, দ্য ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি, চ্যানেল এস এর মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধি। এছাড়া তিনি দৈনিক শ্যামল সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক মৌলভীবাজারের বার্তাসম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন।
আগে চ্যানেল আই এর নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে স্থানীয় প্রতিনিধি পদ থেকে চাকুরিচ্যুত হন তিনি। সম্প্রতি তিনি ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব’ থেকেও বহিষ্কৃত হয়েছেন।
শ্যামলী পরিবহনের কাউন্টারে ‘নিউজ কর্নার’ নামে আরো একটি সিন্ডিকেট কেন্দ্র চালু ছিল। মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন পেরুতে না পারাদের সংবাদকর্মী বানিয়ে গড়া তোলা এ নিউজ কর্নারে তোফায়েল নামের এক সাংবাদিক ইয়াবাসহ র্যাবের হাতে ধরা পড়লে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।
২০১৬ সালের ২ ডিসেম্বর শুক্রবার দুপুরে ১৮৮ পিস ইয়াবাসহ র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার মাঈন উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে তাকে ও তার অপর এক সহযোগী কালামকে গ্রেফতার করেন। আর ডান পাশে চশমা পরা আকাশি রঙের শার্ট পরিহিত বিকুল চক্রবর্তীর সঙ্গে এই ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক তোফায়েলকে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে বিকুল চক্রবর্তী ‘নিউজ কর্নার’ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
অর্থের যোগান:
তথাকথিত সাংবাদিক বিকুল চক্রবর্তীর রয়েছে বহু অর্থের যোগানদাতা। হাইল-হাওরখেকো গোলাম মোস্তফা রাজা মিয়াকে ‘পাখিপ্রেমী মাস্টার’ হিসেবে স্বীকৃতি কিংবা বৃক্ষ ও পরিবেশ ধ্বংসকারী শ্রীমঙ্গলের কিবরিয়া মহালদার ‘সমাজসেবক’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থসহ নানা সুযোগ-সুবিধা আদায় করেন। শুধু এ দু’জনই নয়, তার অর্থের যোগানদাতার তালিকায় রয়েছে বহু নাম।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৭
এএ