সে-ই প্রথম, সে-ই শেষবারের মতো রাষ্ট্রীয় সম্মান পায় পরিবারটি। এরপর থেকে আর কখনো কোনো সরকারই খবর নেয়নি শহীদ কবিরের পরিবারের।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে শহরের নতুন বাহারছড়ায় এক কুঁড়ে ঘরে বসবাস করা এই নারী বাহাত্তরের পরে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়া তো দূরের কথা, বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতাও পাননি।
বাংলানিউজ শহীদ কবির আহম্মদের স্ত্রী আলমাস খাতুনের কুঁড়ে ঘরে গিয়ে কথা বলে তার সঙ্গে। এই শহীদ পত্নী বাংলানিউজকে বলেন, ‘একাত্তরের কোনো এক শুক্রবার বিকেলে শহরের বাজারঘাটা থেকে গোলপাতা আর ঘরের ছাউনি কিনে বাড়ি ফিরছিলেন স্বামী কবির। পথিমধ্যে বনবিভাগের সামনে থেকে এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদাররা। বর্তমানে যেখানে ইসলামিয়া আদর্শ কামিল মহিলা মাদ্রাসা, সেখানেই ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্প। সেখানে নিয়ে বেয়নেটের গুঁতো দিয়ে আমার স্বামীসহ চার জনকে হত্যা করে পাষণ্ডরা। ’
তিনি স্মৃতিচারণ করেন সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের, ‘সেসময় হানাদার ক্যাম্পে খাবার ও পত্রিকা সরবরাহকারী এক লোক আমাকে বিষয়টি জানালে আমি সেখানে ছুটে যাই। সঙ্গে ছিল আমার চার বছর বয়সী কন্যা শাহেনা আকতার, আর কোলে ছিল নয় মাস বয়সী ছেলে নাছির উদ্দিন বাচ্ছু। কিন্তু সেখানে আমার স্বামীর সঙ্গে দেখা করা তো দূরের কথা! কথাও বলতে দেয়নি। পরে খবর পাই তারা আমাকে স্বামী হত্যা করে তার হাতে খোঁড়া কবরেই তাকে মাটি চাপা দিয়েছে। ’
চোখে অশ্রু ঝরে বৃদ্ধা আলমাসের, ‘সেই থেকেই স্বামী হারানোর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলো নিয়ে কতো যে কষ্ট আর যন্ত্রণায় কেটে গেলো আমার জীবন। জীবন বাচানোর জন্য শামুক-ঝিনুক গেঁথে, মালা বানিয়ে বিক্রি করেছি। অসুখে-বিসুখে ঝিনুক মালা গাঁথুনি ঠিকই ঠিক রেখেছি। এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারি না। ’
শহীদ পত্নীর গলায় অভিমান-ক্ষোভ ঝরে, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হলেও কোনো সরকারই এই চার শহীদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করে কী লাভ হলো- সে প্রশ্নটিও রাখেন আলমাস।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ছিলেন নৌকা মার্কার অন্ধ ভক্ত। যেখানে যেতেন, সেখানেই নৌকার লিফলেট বিলি করতেন। এ কারণেই তাকে খুন করে হানাদার বাহিনী। ’
ঘর দেখিয়ে আলমাস দুঃখ-কষ্টের কথা বলেন বাংলানিউজকে। চারিদিকে ভাঙা বাঁশের বেড়া। ওপরে পলিথিন আর নারিকেল পাতার ছাউনি। ঝুপড়ি ঘরটি প্রকাশ করছে বয়সের ভারে ন্যুব্জ আলমাস খাতুনের নিদারুণ অসহায়ত্ব। হাঁটুতে ব্যথা। এর সঙ্গে বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগ। তারপরও বেঁচে থাকার তাগিদে চলছে তার সংগ্রাম।
আলমাস খাতুন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়েছি। চিঠি পেয়েছি। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ আমার কিংবা আমার পরিবারের খবর নেয় না। শুনেছি সরকার শহীদ পরিবারকে ভাতা দেয়। বিধবা ও বয়স্কদেরও ভাতা দেয়। কিন্তু আমার কপালে কিছুই নেই। ’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি এ মাসের মধ্যেই ওই মহিয়সী নারীর বয়স্ক ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা নেবো। ’
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, ‘আমি আপনার কাছ থেকে ওই নারীর কথা শুনলাম। এর আগে কেউ কখনো আমাকে ওই শহীদ পরিবারের ব্যাপারে জানায়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য কাজ করবো। এছাড়া তাকে সরকারি অনুদান পেতেও আমি সহযোগিতা করবো। ’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘শহীদ পরিবার হিসেবে ওই নারীর নাম নেই। ত্রিশ লাখ শহীদের বিনিময়ে আমাদের দেশে স্বাধীনতা এসেছে। তবে সবাইকে তো শহীদ পরিবারের মর্যাদা আমরা দিতে পারি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা। তবে সে নারী যেন এককালীন ভাতা ও বয়স্ক ভাতা কিংবা বিধবা ভাতা পান, সেই ব্যবস্থা নেবো। ’
স্থানীয় সংসদ সদস্য (মহেশখালী–কুতুবদিয়া আসন) ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। তবে আমি শিগগির ওই মহিয়সী নারীর জন্য কিছু করার চেষ্টা করবো। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭
টিটি/এইচএ/