একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ছয়মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বন্দি শিবিরের দুর্বিষহ যন্ত্রণা ও পাকিস্তানি সেনাদের ঔরস সন্তান নিয়ে সামাজিক নানা বিড়ম্বনা যেন এখনও তাকে খামচে ধরে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসের নগর বাজার সংলগ্ন ভাদাইর-দেউল গ্রামের সুঞ্জর খানের মেয়ে জয়গুণ স্থানীয় রামচিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তখন সবে পঞ্চম শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়েছেন।
রাজাকার বাড়ির [বিটি বারী নামে পরিচিত] নেতৃত্বে তখন থমথমে শমশের নগর। একদিন ভোর বেলা তাকে তুলে নেওয়া হয় শমশের নগর বন্দি শিবিরে। সেখানে পাকিস্তানি সেনা সুবেদার লালখান, মেজর আজিজ, ক্যাপ্টেন রফিক ও ক্যাপ্টেন দাউদ টানা ছয়মাস পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন জয়গুণ।
যুদ্ধ শেষের দিকে একদিন ক্যাম্প থেকে তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসেন। কিন্তু ততদিনে জয়গুণ তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পরবর্তীতে নিমসানা আক্তার নামে এক মেয়ের জন্ম দেন তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নিমসানার বাবার পরিচয় না থাকায় বিপাকে পড়েন তিনি। এরপর কুলাউড়ার শরিফপুর ইউপির লালারচক গ্রামের ভূমিহীন ও সহজ-সরল মারুফ আহমদকে ‘ঘরজামাই’ করে বিয়ে দেওয়া হয় জয়গুণের সঙ্গে। যুদ্ধশিশু নিমসানাকে মারুফের পিতৃ পরিচয়ে বিয়ে দেন তিনি।
যুদ্ধশিশুর বাবার পরিচয়ের জন্য যার কাছে বিয়ে দেওয়া হয় সেই সংসারে তার এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম দেন জয়গুণ নেছা। স্বামীও অকালে মারা যান। বছরখানেক আগে একমাত্র ছেলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে চলে যান। এখন তিনি এক মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
জয়গুণ নেছা খানম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছোট একটি ঘরে আমাকে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনারা সেই ঘরে আমার ওপর নির্যাতন চালাতো। একটা সময় শুধু রক্ত দেখেছি। মাটিতে পড়ে গেলে ওরা চারজন আমাকে চেপে ধরতো। আমি বাঁচার জন্য চিৎকার করলে একজন বাইরে থেকে কালো আটা জাতীয় রাবার এনে আমার ঠোঁটে-মুখে লাগিয়ে দিতো। এভাবে ছয়মাস সহ্য করেছি। ’
তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। সেসময় হানাদার বাহিনীর ধারাবাহিক নির্যাতনের কারণে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাই। আমরা বাড়ি ফিরে দেখি সবকিছু ধ্বংস। আত্মহত্যার জন্য হাতে ইঁদুর মারার ওষুধ নেই। তখন মা-বাবা বলেন— ‘তুমি একলা নায়। আরও অনেক মেয়ে আছে। ’
‘এদিকে মানুষ বলতে থাকে ‘পেঠ হইছে’। লজ্জায় ঘরে বসে থাকি। মা বললেন— ‘যদি তুমি মর তবে বেহেশত পাইতায় নায়। ’ অবশেষে ফাল্গুন মাসে আমার মেয়ের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় নিমসানা আক্তার। এ মেয়ে বড় হতে থাকলে- লোকে বলতে থাকে ‘লালখানের পুড়ি’। তখন কতো মানুষ যে আমাকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। ’
জয়গুণ নেছা আরও বলেন, ‘আমার এখন থাকার মতো একটি ভিটে নেই। অন্যের জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছি। এ অবস্থায় হয়তো চলে যাব পরপারে। কিন্তু মরার আগে আমি চাই রাষ্ট্র যেন আমাকে স্বীকৃতি দেয়। সমাজের মানুষ আমাকে যেভাবে ঘৃণা করেছে তাদের মুখে কালি দিয়ে যেন আত্মতুষ্টি নিয়ে মরতে পারি। ’
বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গবেষণা করে আসছেন মৌলভীবাজার টিচার্স ট্রেনিং ইনসটিটিউটের ইন্সট্রাক্টর দীপঙ্কর মোহান্ত। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘জয়গুণ নেছার জীবনী সবার আড়ালেই ছিল। নানা বঞ্চনা নিয়ে তিনি লড়াই করে যাচ্ছেন। আমি বহু কষ্টে তার কাছে পৌঁছাই। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পিটিআইতে আমাদের একটি অনুষ্ঠানে তাকে পরিচয় করিয়ে দেই। আমি আশা করি রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দিয়ে পরবর্তী জীবনে গর্ব করে বাঁচার অধিকার দিবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৯
জিপি