ঢাকা, শনিবার, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বিলুপ্তির পথে উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্য ‘শিদল’

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯
বিলুপ্তির পথে উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্য ‘শিদল’ মাছের শুঁটকি-কচুর ডাঁটা বেটে তৈরি করা হয় শিদল। ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: দেশি পুঁটি-দারিকা মাছের শুঁটকি ও কচুর ডাঁটা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের খাবারের নাম শিদল। মুখরোচক খাবার হিসেবে উত্তরাঞ্চলে জনপ্রিয় হলেও কালের বিবর্তনে আজ এটি বিলুপ্তির পথে।

একসময় বর্ষাকালে লালমনিরহাটের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা বিভিন্ন প্রজাতির মাছে ভরপুর ছিল। জাল ফেললেই উঠে আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ।

অনেক সময় বর্ষার শেষে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ডোবা ও পুকুর সেচে এত বেশি মাছ পাওয়া যেতো, যা একসঙ্গে খাওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ফলে বড় মাছ রান্না করে খেলেও পুঁটি-দারিকার মতো ছোট মাছগুলো শুকিয়ে করা হতো শুঁটকি। কেউ কেউ কম দামে বাজার থেকে কিনেও শুঁটকি বানাতেন।  

এসব শুঁটকি দিয়ে গ্রামের নারীরা তৈরি করতেন দীর্ঘস্থায়ী খাবার শিদল। পুঁটি ও দারিকা মাছের শুঁটকি ভালো ভাবে শুকিয়ে তা ঢেঁকি বা উড়ুনে গুঁড়ো করে নেওয়া হয়। এর সঙ্গে কচুর ডাঁটা বেটে ভালোভাবে মেশাতে হয়। এরপর সরিষার তেল ও হলুদ হাতের তালুতে মাখিয়ে মিশ্রণটি গোল গোল করে রোদে শুকাতে হয়। এভাবে ১২ থেকে ১৫ দিন রোদে ভালো করে শুকিয়ে সারা বছরের খাবারের জন্য হাড়িভর্তি করে রাখা হয় শিদল। শুধু নিজেদের জন্যই নয়, মেয়ে-জামাইসহ আত্নীয়-স্বজনদের বাড়িতেও পাঠানো হতো। কালের পরিবর্তনে আজ বিলুপ্তির পথে উত্তরাঞ্চলের এ ঐতিহ্য।

জানা যায়, শিদল আগুনে পুড়িয়ে বা তেলে হালকা ভেজে ভর্তা করে খেতে হয়। শিদল দিয়ে লাউশাকের ঝোলও বেশ সুস্বাদু। বিভিন্নভাবে খাওয়া হলেও সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় শিদল ভর্তা। আগে কৃষকেরা সকালে পান্তাভাত-শিদল ভর্তা খেয়ে কাজে যেতেন। শিদল ভর্তা ছিল উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের একটি মুখরোচক খাবার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও আপ্যায়নে খাবার তালিকায় শিদল ভর্তা ছিল আবশ্যক। এজন্য গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই তৈরি করা হতো ছোট মাছ দিয়ে বানানো এ খাবার।  
দেশি পুঁটি ও দারিকা মাছের শুঁটকি বাটা হচ্ছে উড়ুনে।  ছবি: বাংলানিউজ

কালমাটি আনন্দবাজার এলাকার নজির হোসেন ও তালেব উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, কোনো বাড়িতে শিদল ভর্তা করলে তার ঘ্রাণে পাশের বাড়ির সবাই বুঝতে পারতো। শিদল ভর্তার কথা শুনলে না খেতে চাওয়া মানুষও ভাত খেতে বসে- এমনই সুস্বাদু শিদল ভর্তা। এর জনপ্রিয়তা এখনো আছে। তবে, স্থানীয় বাজারে দেশি পুঁটি ও দারিকা মাছের সরবরাহ কম থাকায় শুঁটকি বা শিদল আগের মতো দেখা যায় না। দিন দিন হারিয়েই যাচ্ছে এটি। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে শিদল শব্দটাই অপরিচিত।  

পাটগ্রামের আলাউদ্দিন সুমন বাংলানিউজকে বলেন, উত্তরাঞ্চলের মানুষের খাবারের তালিকায় শিদল ভর্তা অনেক জনপ্রিয়। আগে প্রতিটি বাড়িতেই শিদল তৈরি হলেও এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। নিজেদের জন্য আমরা এ বছর অল্প কিছু শিদল বানিয়েছি।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা গ্রামের তাহাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ডাল ও শিদল ভর্তা হলে আর কোনো তরকারির দরকার নেই। আগে সকালে শিদল ভর্তা ও পান্তা খেয়ে মাঠে কাজে যেতো মানুষজন। এখন ফ্রিজের যুগে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ মুখরোচক খাবার। এটা তৈরিতেও অনেক ঝামেলা, যা এখকার গৃহিনীরা করতে চায় না। তাই দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে শিদল ভর্তার অমৃত স্বাদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭  ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৯
একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।