এমন একটা সময় স্ত্রী, সন্তান আত্মীয় স্বজনে ভরপুর ছিল সংসার। সকলে হাসিখুশিতে থাকতেন।
আ. মালেক: আ. মালেক, বয়স ৭০ বছর। সুঠাম দেহের অধিকারী। যুবক বয়সে হয়তো আরও দেখতে শুনতে ভালোই ছিলেন। গ্রামের স্থায়ী বাড়ি বরিশাল সদরের আস্তাকাঠি এলাকায়। সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়ায় ডিফেন্সে চাকরি না হলেও বিভিন্ন কোম্পানিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চাকরি করে সন্তানদের লেখাপড়াসহ জীবিকা নির্বাহ করতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস দীর্ঘ ৩৫ বছর আগে প্রথম স্ত্রী ও সন্তানরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কাজের তাগিদে বরগুনার পাথরঘাটায় এসে দিন মজুরি করেন। এক পর্যায় এখানেই দ্বিতীয় বিয়ে করে কালমেঘা ইউনিয়নের ঘুটাবাছা গ্রামে স্থায়ী হিসেবে বসবাস করেন তিনি। দ্বিতীয় সংসারে ২ ছেলে ও ২ মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ সংসারের দু’টো সন্তানটি ছোট থাকায় তাদের মামা বাড়িতে থাকে। আড়াই বছর আগে দ্বিতীয় স্ত্রী আ. মালেককে রেখে অন্যত্র চলে যায়। নিজের কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমেই ঠাঁই হয় তার।
আ. মালেক বলেন, এক সময় সব ছিল, এখন বয়স হয়েছে, সব চলে গেছে। তাদের এখন আমাকে প্রয়োজন নেই, যখন প্রয়োজন ছিল তখন...। আমার আর কোনো ইচ্ছা নেই, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই (বৃদ্ধাশ্রমে) থেকে যেতে চাই। মৃত্যুর পর যেন আমাকে এখানেই দাফন দেওয়া হয়। পোলাপাইন আছে না মারা গেছে তাও কিছু জানিনা।
মোসা. নিলুফা বেগম: জিজ্ঞাসা করতেই নাম বললেন। বয়স কতো জিজ্ঞাসা করা মাত্রই বললেন ফিফটি টু। তখনই বুঝে ফেললাম, লেখাপড়া করেছেন তিনি। এক সময় সু-স্বাস্থ্যে অধিকারী ছিলেন। লেখাপড়াও কম করেনি। এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করে তৃণমূলে নেতৃত্বও দিয়েছেন। বাবার বাড়ি কাঁঠালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের একবার নির্বাচিত হয়ে মেয়রও হয়েছিলেন। বয়সকালে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে চলছেন, যে ব্যক্তি সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে হাত দিয়ে অসহায়দের সহযোগিতা করেছেন আজ সে নিজেই অন্যের সাহায্য নিয়ে দিন যাপন করছেন। স্বামী আলম তালুকদার সরকারি চাকরি করতেন ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে মারা গেছে ২ বছর আগে। দুই মেয়ে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের সংসারেই ছোট দুই ছেলে থাকেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর বাড়ির ভিটেমাটি শ্বশুর বাড়ির লোকজন নিয়ে যাওয়ায় থাকার জায়গা বৃদ্ধাশ্রমে।
নিলুফা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, মানসিক বড় কষ্টে আছি, সন্তানরা মাঝে মধ্যে এসে দেখে গেলেও কাছে না পাওয়ার কষ্ট। বয়স হওয়ার কারণে শরীরের নানা রোগে আক্রান্ত। এখন ঠিক মতো হাটতে পারছিনা অনেক কষ্ট হয়। ভাগ্য আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
হাজেরা বেগম: প্রতিদিন বিকেলে লাঠি ভর দিয়ে ৬০ বছরের হাজেরা বেগম বৃদ্ধাশ্রমে আঙ্গিনায় ঘোরাফেরা করেন। বাক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। স্বামী মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। চোখেও কম দেখছেন তিনি। তাদের দাম্পত্য জীবনে কোন সন্তানাদি নেই। ৩ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে থাকছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর কয়েকবছর স্বামীর ভিটেতেই ছিলেন, কিন্তু পরে শ্বশুর বাড়ির লোকজন বের করে দিলে বাবার বাড়িতে আসেন। বাবাও বাড়িতেও কয়েক বছর থাকার পর জীবিকার তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তি করে দিনযাপন করেন। বাপের ভিটিতে একমাত্র ভাইয়ের কাছে থাকায় তিনিও মারা যাওয়ার কারণে অভাবের সংসার থেকে বার্ধক্যের ভারে ও চোখে কম দেখায় ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে তিন বছর আগে বৃদ্ধাশ্রমে আসেন হাজেরা বেগম।
হাজেরা বেগম বলেন, এখানেই ভালো আছি। স্বামী মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করেছি, ভিক্ষা করেছি। এখন এখানে শান্তিতেই আছি। এখানে যারা আছে, তারা আমার পোলা মাইয়া। সবাই আমারে ভালো চোখেই দেখে।
সন্তানের কাছে পিতা-মাতার বেশি কিছু চাওয়ার থাকে না। থাকে শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করার ইচ্ছা। আর এ ইচ্ছা নিয়েই প্রতিটি পিতা-মাতা প্রহর গুণতে থাকেন দিবা-রজনী। কিন্তু অনেকেরই সেই সন্তানের কাছে আশ্রয় না হয়ে; কাঞ্চন আলী হাওলাদার, আ. মালেক ও আ. আজিজের মতো অনেক বাবারই আশ্রয় হয় আপনজনহীন বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ বয়সে মস্ত ফ্ল্যাটের ঘরের কোণেও জনমদুঃখী মা-বাবার এতোটুকুও জায়গা মিলে না। তাদের ছুড়ে দেয়া হয় প্রবীণ নিবাসনামীয় নরকে। তবুও প্রতিবাদ দানা বাঁধে না; মন অভিশাপ দেয় না।
কথা হয় এনআইখান রেসিডেন্সিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষক রফিকুল ইসলাম কাকনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এনআই খান সাহেবের উদ্যোগে যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা হয়েছে তা প্রশংসনীয়। এখানে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায় এতিম শিক্ষার্থীদের ফ্রি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া অগ্রজ নিবাসে প্রবীনদের রাখার ব্যবস্থা এটি এ এলাকায় প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কথা হয় অগ্রজ নিবাসের প্রতিষ্ঠাতা দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম শিক্ষাবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম খানের (এনআইখান) সঙ্গে। তিনি বলেন, সব-হারানো বাবা-মায়ের অভিভাবক হয়ে তাদের আগলে রাখার চেষ্টা করছি। আমি নিজ অর্থে গড়ে তুলেছি ‘অগ্রজ নিবাস’নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সম্পূর্ণ নিজ অর্থে এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, রেসিডেন্সিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। নিজ অর্থে এতো বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার ভালো লাগছে তাই করছি। আমি নিজের শেষ জীবনে এসে ওদের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসি। এতিম শিশু, সন্তান পরিত্যাক্তা মা-বাবাদের নিয়ে থাকতে খুব ভালোই লাগছে। ’
‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার/ নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি/ সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি/ ছেলের আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/ আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম। ’ নচিকেতার গানের মতোই জীবন এখানকার মানুষের। ৭ একর জমির ওপরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রম। মনোরোম পরিবেশ। এখানে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর, ২০১৯
এসএইচ