বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের মূল্যবান সুন্দরী গাছ পাচার রোধ ও বাঘ, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী নিধন ঠেকাতে আধুনিক অস্ত্র ও নৌযান নিয়ে আলো আঁধারে তারা দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে এই ‘অপ্রতিরোধ্য স্মার্ট পেট্রোলিং’।
সম্প্রতি সুন্দরবন ভ্রমণে গেলে টহলরত অবস্থায় কথা হয় খুলনা রেঞ্জের স্মার্ট পেট্রোলিং টিমের লিডার সুলতান মাহমুদ টিটুর সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সুন্দরবনের স্মার্ট পেট্রোলিং টিম বনজ সম্পদ রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমি সার্বক্ষণিক স্মার্ট টিমের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। স্মার্ট পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনে বনদস্যু ও জলদস্যুদের তৎপরতা এবং অপরাধ কমে এসেছে। একইসঙ্গে সুন্দরবন থেকে সুন্দরী কাঠ, কুমির, হরিণ ও বাঘ পাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গ্রুপ বনের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাত থেকে ১০ দিন টহল দেয়। প্রতি টহল দলে আট থেকে ১০ জন সদস্য থাকে। এছাড়া প্রতিটি টহল গ্রুপের সঙ্গে থাকে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) এবং সাইবার ট্র্যাকার। জিপিএস ও সাইবার ট্র্যাকারের মাধ্যমে টহলকালীন সব কর্মকাণ্ড রেকর্ড করা হয়। পরবর্তীকালে সাইবার ট্র্যাকারের ডাটা ল্যাপটপে আপলোড করা ডাটা ম্যানেজারের মাধ্যমে ডাটা কো-অর্ডিনেটরের কাছে পাঠানো হয়। আদাচাই ফরেস্ট অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফারুকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবন রক্ষায় শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে স্মার্ট প্যাট্রোলিং টিম। সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষায় স্মার্ট পেট্রোলিং গ্রুপ যে সফলতা দেখিয়েছে, তা খুবই ভালো।
সুন্দরবনের দুর্গম স্থানে কোনো অপরাধ সংগঠিত হলে বন বিভাগের নিয়মিত যে স্টেশন ও বনরক্ষীরা আছেন, তারা অনেক সময় যেতে পারেন না। অনেক সময় কৌশলে গেলেও পৌঁছাতে পৌঁছাতে অপরাধীরা পালিয়ে যান। কিন্তু স্মার্ট পেট্রোলিং চালু হওয়ার পরে যেকোনো জায়গায় অপরাধের খবর শুনলেই দ্রুত গতির স্পিডবোট ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে ছুটে যান এ দলের সদস্যরা।
সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য বেলাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গোটা সুন্দরবনে চলমান রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিশেষ নিরাপত্তা অভিযান স্মার্ট পেট্রোলিং। সুন্দরবনে বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে এ স্মার্ট পেট্রোলিং টিমের সদস্যরা কাজ করে চলেছেন। যে কারণে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বণ্যপ্রাণী পাচার, শিকার, চোরাচালান ও বনজ সম্পদ ধ্বংস ও অবৈধভাবে বনে প্রবেশ অনেকটা কমে এসেছে।
যেভাবে সুন্দরবন পাহারা দেয় স্মার্ট প্যাট্রোলিং টিম:
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন কেন্দ্রিক চোরাচালান, দস্যু দমন, বন্যপ্রাণী পাচার রোধ এবং বনজ সম্পদ ধ্বংস ঠেকানোর মতো অপরাধ শূন্যের কোঠায় নামাতে স্মার্ট প্যাট্রোলিং (স্পাসিয়াল মনিটরিং অ্যান্ড রিপোর্টিং টুলস) কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সনাতন পদ্ধতিতে সুন্দরবনে টহল পরিচালনার সীমাবদ্ধতাগুলো জয় করে আটজনের একটি দল অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে জলে-স্থলে টহল দিচ্ছে।
দিনের টহল শেষে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ফলাফল জানতে পারছেন। পরবর্তী দিনের টহলের জন্য দিক-নির্দেশনাও দিতে পারছেন। পাশাপাশি বিবিধ তথ্য সমৃদ্ধ প্রতিবেদন প্রস্তুত এবং ডাটাবেজ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণের পথে বন অধিদপ্তরের অর্জনকে সমৃদ্ধ করেছে নতুন এই টহল পদ্ধতি।
প্রতি রেঞ্জে প্রতি মাসে দুইটি টহল পরিচালনা করা হয়। প্রত্যেক টহল দল সাত থেকে ১০ দিন এবং প্রতিদিন ছয় থেকে আট ঘণ্টা করে টহল দেয়। প্রতিটি স্মার্ট টহল দলে আট থেকে ১০ জন প্রশিক্ষিত সদস্য থাকেন। টহল দলের প্রত্যেক সদস্যের সুনির্দিষ্ট একটা দায়িত্ব দেওয়া থাকে।
টহলের সময় সার্বক্ষণিকভাবে বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ এবং বন/বন্যপ্রাণী অপরাধ অনুসন্ধান করা হয়। অপরাধ সংগঠিত হলে সংশ্লিষ্ট আইন/বিধির নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়। সব কার্যক্রম স্মার্ট টহলের লগ বই বা সাইবার ট্র্যাকারে রেকর্ড করা হয়। ডাটা ব্যবস্থাপকের কাছে পাঠানো হয়। ডাটা ব্যবস্থাপক সর্বশেষ ভার্সনের স্মার্ট সফটওয়্যারে ডাটা এন্ট্রি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিবেদন তৈরি করেন। টহল চলাচলের পথের মানচিত্র, জলযান ভিত্তিক বা পায়ে হেঁটে অতিক্রান্ত দূরত্ব, টহল কাভারেজ, গ্রেফতারদের তথ্য, আটকদের মালামালের তথ্য, অপরাধ উদঘাটন বা মালামাল আটকের স্থানের মানচিত্র, অবৈধ কার্যক্রমের তথ্য, অপরাধের হটস্পটের মানচিত্র, বন্যপ্রাণীর পর্যাপ্ততা সংবলিত মানচিত্র ও বন্যপ্রাণী হটস্পটের মানচিত্র প্রতিবেদন প্রস্তুতের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরবর্তী টহল দলকে দিকনির্দেশনা দেয়।
খুলনা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা (সহকারী বন সংরক্ষক) মো. আবু সালেহ বাংলানিউজকে বলেন, অত্যাধুনিক ডিভাইস ও আধুনিক জলযান সমৃদ্ধ স্মার্ট পেট্রোল টিমের কার্যক্রমের ফলে খুলনা রেঞ্জে বন্যপ্রাণী ও মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুরক্ষিত হয়েছে সুন্দরবন।
এই স্মার্ট টিমের অর্জন প্রসঙ্গে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মঈন উদ্দিন খান বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৬ সাল থেকে সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জে (খুলনা, সাতক্ষীরা, চাদপাই ও শরণখোলা) স্মার্ট টিমের কার্যক্রম শুরু হয়।
২০১৮ সালে সুন্দরবনে ৮৩টি পেট্রোল হয়েছে। ৯০ হাজার ৩৮১ কিলোমিটার পেট্রোলিং করা হয়েছে। এই পেট্রোলিংয়ে ২৩ প্রজাতির ১৪ হাজার ৩৪৬টি বন্যপ্রাণী দেখা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে ৪৭৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একইসঙ্গে ৪০০ নৌকা বা ট্রলার, ৬৯৬টি মাছ ও কাঁকড়া ধরার জাল এবং ১৪৩টি কাটিং টুলস জব্দ করা হয়েছে পেট্রোলিংয়ে।
এছাড়া ২০১৯ সালে ১০৪টি স্মার্ট পেট্রোল হয়েছে সুন্দরবনে। ৭৭ হাজার ৪৫৫ কিলোমিটার পেট্রোলিং করা হয়েছে। এই পেট্রোলিংয়ে ২৩ প্রজাতির ১৫ হাজার ৯২৮টি বন্যপ্রাণী দেখা গেছে। বিভিন্ন অপরাধে ৪৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি পেট্রোলিং টিম ৩১১ নৌকা বা ট্রলার, ৩৭২টি মাছ ও কাঁকড়া ধরার জাল, ১২১টি কাটিং টুলস জব্দ করেছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০
এমআরএম/টিএ