যেভাবে আগুনের সূত্রপাত: ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা। পুরান ঢাকার চকবাজারে ব্যস্ত মানুষ।
তখনও আশপাশের লোকজন জানে না কী ঘটেছে, আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছেন সবাই। কেউ দোকানের সাটার বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান নেন। ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ভবনেও।
স্থানীয়দের বর্ণনায়, আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের বহু ইউনিট দ্রুত ছুটে এলেও সড়ক সরু থাকায় আগুন নেভাতে হিমশিম খেতে হয়। রাতভর আগুন নেভাতে কাজ করে ফায়ার সার্ভিস। ভোরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু এরইমধ্যে হারিয়ে যায় বহু তাজা প্রাণ।
পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টা যেন হয়ে ওঠে এক মৃত্যুপুরীতে। এতো মানুষের প্রাণহানিতে একুশে ফেব্রুয়ারি শোকের ছায়ায় ভাসে পুরো বাংলাদেশ।
সেই রাতের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এখনো স্থানীয় বাসিন্দাদের তাড়া করে ফেরে। এলাকার বাসিন্দা মাসুম আহমেদের শূন্যদৃষ্টি এখনও যেন চোখের সামনে আগুন আর সবকিছু ছাই হয়ে যাওয়া দেখছে।
একুশে ফেব্রুয়ারির চুড়িহাট্টা: ওইদিন ভোরে চোখের সামনে হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের ধ্বংসস্তূপ দাঁড়িয়ে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া চারতলার অবয়ব। ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া পানির ফোঁটা আর স্তিমিত হয়ে আসা ধোঁয়া দুটোই নজর কাড়ে। শাহী মসজিদটার ঠিক সামনের রাস্তার এপার-ওপার দুটো গাড়ি, শুধু কাঠামোটা বলছে, এটা রাতে আগুন লাগার আগ পর্যন্ত গাড়িই ছিল।
অনেকগুলো রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ির কিছু অংশ যেগুলো দাহ্য নয়, সেগুলো পড়ে আছে। পোড়া মোটরসাইকেল আর পিকআপও চোখে পড়ে। দোকান কোনোটা খোলা, কোনোটার শাটার অর্ধেক বা পুরো বন্ধ। তবে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে ভেতরের অবস্থা সবগুলোর একইরকম।
রাস্তায় পায়ের নিচে শর্ষেদানার মতো প্লাস্টিকের কাঁচামাল। ধবধবে সাদা প্লাস্টিকের গুঁড়া কালো, পানি কালো, রং বেরংয়ের বিভিন্ন প্রসাধনী প্যাকেট ও পারফিউমের কৌটা সব পুড়ে কালো।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন চারদিক। এ সময় ভোরে ফের হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ।
ওয়াহেদ ম্যানশনের তিনতলার জানালা দিয়ে দেখা মেলে আগুনের লেলিহান শিখা। মূহূর্তের মধ্যে শুরু হয় উপস্থিত জনতার হুড়োহুড়ি, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ব্যস্ততা। আধাঘণ্টার চেষ্টায় আবারো সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর উৎসুক মানুষের ভিড় বাড়ে। আর কোনো পরিচিত স্বজনদের পাওয়ার আশা যখন শেষ তখন তর্ক শুরু হয় আগুনের সূত্রপাত নিয়ে। পুরান ঢাকার এই স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে তখন স্পষ্টত দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল রাসায়নিক কারখানাকে কোনোভাবেই দায়ী করতে রাজি নয়।
তদন্ত: সরকার একাধিক কমিটি গঠন করে, কিন্তু প্রতিবেদন প্রকাশ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ফলে পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের কথারও সুরাহা হয়নি।
চুড়িহাট্টার বাসিন্দা আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমাদের একটাই অনুরোধ, এই রাসায়নিক কারখানাগুলো সরকার সব সরিয়ে নিক’।
মসজিদের সামনে পুড়ে যাওয়া গাড়ির মালিক মাহাবুবুর রহমান বলেন, জ্যামে আটকা পড়ে ছিলাম। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো আর আগুনের উল্কাপিণ্ডের মতো কিছু একটা গাড়িতে উড়ে এসে পড়ে আগুন ধরে যায়। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার পুরো গাড়িতে আগুন। দেখি আমার দরজাও খুলছে না। এ সময় ড্রাইভার তার দরজা খুলে বের হয় ও আমাকে বলে ভাই তাড়াতাড়ি বের হন। এরপর কীভাবে আমি বের হইছি বলতে পারি না'।
প্রাণে বাঁচলেও এই আতঙ্ক তাকে অনেকদিন তাড়া করে ফিরবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
টিএম/জেডএস