শুক্রবার (৩ এপ্রিল) বিকেলে দরিয়ানগরে প্রস্তাবিত সংরক্ষিত সৈকত পরিদর্শন শেষে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এ তথ্য জানান।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সমুদ্রসৈকতের বালিয়াড়ির উপর সাগরলতা দূর থেকে দেখতে অনেকটা সবুজ কার্পেটের মতো।
জেলা প্রশাসক বলেন, প্রাথমিকভাবে শহরের দরিয়ানগর থেকে দক্ষিণে এক কিলোমিটার পর্যন্ত সৈকত এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সাগরলতার বনায়ন করা হবে। মূলত সৈকতে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা এবং সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি বালিয়াড়ির পেছনের অংশে সৃজন করা হবে নারকেল বাগানও।
সাগরলতা নিয়ে বাংলানিউজে ‘সৈকতে জাগছে সাগরলতা, বাড়ছে লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাপ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এর পর জেলাপ্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরে আসে বিষয়টি।
শুক্রবার বিকেলে দরিয়ানগরে প্রস্তাবিত সংরক্ষিত সৈকত এলাকা পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন ছাড়াও অন্যদের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আফসার, পর্যটন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান জাহিদ এবং সাগরলতা ও বালিয়াড়ি গবেষক সাংবাদিক আহমদ গিয়াস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এসময় সাংবাদিক আহমদ গিয়াস তার রোপণ করা সাগরলতার বন কীভাবে বালিয়াড়ি তৈরি করেছে তা জেলা প্রশাসকসহ সবাইকে সরেজমিনে দেখান।
সাংবাদিক আহমদ গিয়াস বাংলানিউজকে জানান, বাস্তুশাস্ত্র বা পরিবেশবিদ্যায় বালিয়াড়িকে সমুদ্রসৈকতের রক্ষাকবচ, আর সাগরলতাকে বালিয়াড়ি তৈরির কারিগর বলা হয়। সাগরে ঝড়-তুফান বা ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে উপকূলকে রক্ষা করে বালিয়াড়ি। আর সমুদ্রসৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ ও শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বড় বড় বালির পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরি করে সাগরলতা।
পুরো সৈকতজুড়ে পর্যটন শিল্পের কারণে দখল ও দূষণের শিকার হয়ে গত প্রায় তিন দশকে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্রসৈকতের বড় বড় বালিয়াড়িগুলো প্রায়ই হারিয়ে গেছে। যে কারণে সাগরে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
আর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণে পর্যটকসহ সবার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে মাত্র সৈকতে মানুষের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যায়। যে কারণে মাত্র এই কদিনেই সেই নির্জনতার সুযোগে বিধ্বস্ত প্রকৃতি আবার ডানা মেলেছে। ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। এখন প্রকৃতি আপনা-আপনি পুনর্গঠিত হচ্ছে। যোগ করেন আহমদ গিয়াস।
জানা যায়, সৈকতের পরিবেশগত পুনরুদ্ধারে সাগরলতার মতো দ্রাক্ষালতার বনায়নের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ফ্লোরিডা এবং অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সৈকতের হ্যাস্টিং পয়েন্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন সৈকতে বালিয়াড়ি সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের দেখানো পথে সৈকতের মাটির ক্ষয়রোধ ও সংকটাপন্ন পরিবেশ পুনরুদ্ধারে বিশ্বের দেশে দেশে কাজে লাগানো হচ্ছে সাগরলতাকে। উন্নত বিশ্বের গবেষণালব্ধ ফলাফলে সাগরলতার মতো দ্রাক্ষালতা সৈকত অঞ্চলে পরিবেশগত পুনরুদ্ধার ও মাটির ক্ষয় রোধের জন্য একটি ভালো প্রজাতি বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সাগরলতা ন্যূনতম পুষ্টিসমৃদ্ধ বেলে মাটিতে বেড়ে উঠতে পারে। তার পানির প্রয়োজনীয়তাও কম হয়। উচ্চ লবণাক্ত মাটিও তার জন্য সহনশীল। এর শিকড় মাটির তিন ফুটের বেশি গভীরে যেতে পারে। এটি দ্রুতবর্ধনশীল একটি উদ্ভিদ। বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ না হলে লতাটি চারিদিকে বাড়তে থাকে এবং সর্বোচ্চ সামুদ্রিক জোয়ারের উপরের স্তরের বালিয়াড়িতে জাল বিস্তার করে মাটিকে আটকে রাখে। এরপর বায়ু প্রবাহের সঙ্গে আসা বালি ধীরে ধীরে সেখানে জমা হয়ে মাটির উচ্চতা বাড়ায়। এতে সাগরলতার ও সৈকতের মাটির স্থিতিশীলতা তৈরি হয়।
সাগরলতাকে স্থানীয়ভাবে ডাউগ্গা লতা, ডাউঙ্গা লতা ও পিঁয়া লতা নামে পরিচিত। এর ইংরেজি নাম রেলরোড ভাইন, যার বাংলা শব্দার্থ করলে দাঁড়ায় রেলপথ লতা। আসলেই রেলপথের মতোই যেন এর দৈর্ঘ। একটি সাগরলতা ১শ ফুটেরও বেশি লম্বা হতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea pes caprae.
স্থানীয়ভাবে এর ওষুধি ব্যবহারও রয়েছে। জেলিফিশ এর আঘাতে সৃষ্ট বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে জেলে সমাজ সাগরলতার রস ব্যবহার করে। এই ঐতিহ্যগত এথনো মেডিসিন জ্ঞান থেকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্টিং রোগের প্রতিষেধক তৈরি করা হচ্ছে।
সাংবাদিক, গবেষক, পরিবেশবিদ ও কক্সবাজার ভয়েস-এর সম্পাদক বিশ্বজিত সেন বাঞ্চু বাংলানিউজকে বলেন, মাত্র এক দশক আগেও কক্সবাজার শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতজুড়ে গোলাপি-অতিবেগুনি রঙের ফুলে ভরা সৈকতে এক অন্য রকমের সৌন্দর্যময় পরিবেশ ছিল। কিন্তু সৈকতে মানুষের অবাধ বিচরণের কারণে সেই সাগরলতা এখন হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি নষ্ট হয়ে গেছে বালিয়াড়িও। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের এ উদ্যোগ অবশ্যই প্রসংশনীয়। এ উদ্যোগের কারণে সৈকতে পরিবেশ যেমন রক্ষা হবে, তেমনি সৌন্দর্যও অনেকগুণ বাড়বে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০২০
এসবি/এএ