ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

২০ বছরে নৌদুর্ঘটনায় দেড় হাজারেরও বেশি প্রাণহানি

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৪ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২০
২০ বছরে নৌদুর্ঘটনায় দেড় হাজারেরও বেশি প্রাণহানি

ঢাকা: দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাই ছোট-বড় নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভৌগোলিক কারণে প্রায় ২৫ শতাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। দুর্ভাগ্যবশত মাঝে মাঝে এ পথেও দুর্ঘটনা ঘটে। নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ও অদক্ষ চালক, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ প্রায় ১০টি কারণে ঘটে এ ধরনের দুর্ঘটনা। এরমধ্যে গত ২০ বছরে ১২টি বড় দুর্ঘটনায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে।

এরপরও সতর্ক হচ্ছে না লঞ্চ মালিক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এছাড়া সারাদেশে ছোট-বড় মিলে কতটি নৌযান চলাচল করে তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই মন্ত্রণালয়ে।

সারাদেশের নৌযানের ডাটা তৈরির জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও পরিকল্পনা কমিশনে তা আটকে আছে। তাই দেশের অবৈধ নৌযানের কোনো তথ্য নেই নৌপরিবহন অধিপ্ততরে। ফায়ার সার্ভিস কিংবা নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, নৌযানে ত্রুটিপূর্ণ নকশা প্রণয়ন ও অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে নৌযান নির্মাণ, অবকাঠামোগত ও যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস দেওয়া, অদক্ষ মাস্টার ও ড্রাইভার দিয়ে নৌযান পরিচালনা, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য বোঝাই করে অবৈধ নৌযান চলাচল, আবহাওয়ার পূর্বাভাস যথাযথভাবে অনুসরণ না করাসহ একাধিক কারণে ঘটনা ঘটে। এছাড়া নৌপথে লঞ্চের নকশাজনিত ত্রুটি, নিরাপত্তা আইন অমান্য করা, বাতি বা সার্চলাইট না থাকা, চলার পথে দুই লঞ্চের মধ্যে প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া চালানো, পর্যাপ্ত লাইফবয়া না থাকা, লঞ্চে ‘কার্বন ডাই অক্সাইড সিলিন্ডার’ না রাখা, নাব্য সংকট ও ডুবোচর, নৌপথে কারেন্ট জাল বিছিয়ে রাখা এবং আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে একাধিক লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বাংলানিউজকে বলেন, গতকাল বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনায় তদন্ত ছাড়া কিছু বলা যাবে না। তবে আমার মনে হয় এটা ইচ্ছা করে অসর্তকতা। এ দুর্ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ ঘটানোর অভিযোগ এনে ইতোমধ্যে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক, মাস্টারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নৌপুলিশ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে দুটি লঞ্চেরই ফিটনেস সদন ছিল। একটি লঞ্চ ঘাট ছেড়ে যাচ্ছিল। অপরটি ঘাটে নোঙর করার জন্য আসছিল। এরমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। এটা একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট। তাই তদন্ত ছাড়া কিছু বলা যাবে না। সারাদেশে নৌযানের ডাটা তৈরির জন্য একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া আছে। কিন্তু এখনও অনুমোদন করা হয়নি বলে কাজ শুরু করা যায়নি। দুর্ঘটনাজনিত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে মেঘনা নদীতে ‘এমভি জলকপোত’ ও ‘এমভি রাজহংসী’ নামে দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের সংঘর্ষে প্রাণ হারান ১৬২ যাত্রী। ২০০২ সালে চাঁদপুরের ষাটনল সংলগ্ন মেঘনায় সালাহউদ্দিন-২ নামে লঞ্চ ডুবে ৩৬৩ যাত্রী মারা যান। ২০০৩ সালে ‘এমভি নাসরিন-১’ চাঁদপুরের ডাকাতিয়া দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে ১২৮ পরিবারের প্রধানসহ সরকারিভাবে ৬৪১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে মরদেহ উদ্ধার করা হয় প্রায় ৮০০। ২০০৪ সালের ‘এমভি লাইটিং সান’ লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৮১ এবং ‘এমভি দিগন্ত’ ডুবির ঘটনায় শতাধিক যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে। ২০০৬ সালে মেঘনা সেতুর কাছে ‘এমএল শাহ পরাণ’ লঞ্চ দুর্ঘটনায় ১৯ জন মারা যান। ২০১৪ সালে মুন্সিগঞ্জের কাছে মেঘনা নদীতে এমভি মিরাজ-৪ ডুবিতে ২২ যাত্রীর মৃত্যু হয়। একই বছরে পদ্মায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামে একটি লঞ্চ। উদ্ধার করা হয় ২১ মরদেহ।

এরপর ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শরীয়তপুরের নড়িয়ায় পদ্মা নদীর ওয়াপদা চেয়ারম্যান ঘাটের টার্মিনালে তীব্র স্রোতে ডুবে যায় তিনটি লঞ্চ। এতে একই পরিবারের তিনজন, লঞ্চ স্টাফ, যাত্রীসহ ২২ জন ছিলেন। ২০১৯ সালের ২২ জুন মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌরুটে এমভি রিয়াদ নামে একটি লঞ্চের তলা ফেটে অর্ধেক পানিতে ডুবে যায়। তলা ফেটে পানি উঠতে শুরু করলে অন্য ট্রলার গিয়ে লঞ্চযাত্রীদের উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসে। এরপর ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি বরিশাল-ঢাকা নৌপথের মেঘনা নদীর চাঁদপুর সংলগ্ন মাঝ কাজীর চর এলাকার নদীতে দুই লঞ্চের সংঘর্ষে দুই যাত্রী নিহত এবং আটজন আহত হন।

সর্বশেষ সোমবার (২৯ জুন) সকালে রাজধানীর শ্যামবাজার এলাকা সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মঙ্গলবার (৩০ জুন) দুপুর পর্যন্ত ৩৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ‘এমএল মর্নিং বার্ড’ নামে ওই লঞ্চটি সোমবার সকালে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল। শ্যামবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ নামের আরেকটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’ ঘটানোর অভিযোগ এনে ইতোমধ্যে ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক, মাস্টারসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে নৌ পুলিশ। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিআইডব্লিউটিএ- এর পক্ষ থেকে আলাদা দুটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩৬টি, মামলা হয়েছে ৩৪০টি, সাজা হয়েছে ২০০টি মামলার। আর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ৫০টি। বিচারাধীন রয়েছেন ৯০টি মামলা। এই ২৩৬ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তিন হাজার ৬২৭ জন। আহত হয়েছেন ৪৮১ জন। আর নিখোঁজ ৪৫৭ জন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২০
জিসিজি/টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।