বাবা হবিবার সানা আগে কৃষি কাজ করে সংসার চালালেও এখন অসুস্থ।
অভাব অনটনের কারণে চারজনের সংসারে তিন বেলা ভাত জোটানোই ছিল কষ্টকর।
সংসারের অভাব নামক শত্রুকে তাড়াতে ২০১৬ সালের জুন মাসে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা হন বাবু। তাও আবার অবৈধভাবে পানিপথে। বড় জাহাজে বাবু ছাড়াও ছিলেন ৮৮৬ জন। কিন্তু অবৈধ অভিবাসন ও দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে তাদের ঠিকানা হয় অন্ধকার জঙ্গলে। দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে সাগর পথে অবৈধ অভিবাসী হয়ে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করেন অনেক বাংলাদেশি।
যাওয়ার পথে নানা বিপদ ও নির্যাতনের শিকার বাবু জানান, যাত্রাপথে সাগরে ট্রলারডুবিতে মোট ৩৫ জনের সলিল সমাধি হয় তার চোখের সামনেই। কোনোভাবে উত্তাল সাগর পারি দিয়ে বড় জাহাজ থেকে ট্রলারে করে থাইল্যান্ডের উপকূলে পৌঁছার পর শুরু হয় আরেক ভয়াল অধ্যায়। কারণ ট্রলারগুলো ভেড়ানো হয় দুর্গম কোনো উপকূলে। সেখান থেকে নেমে হাঁটতে হয় দুর্গম বনের ভেতর দিয়ে। প্রায় মাসখানেক হাঁটতে হয় তেমন কোনো খাবার ও পানি ছাড়াই। অভুক্ত অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফেলেই চলে যান অন্যরা। পরে দালাল পরিবর্তনের সময় কোনো একটি খুপরি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। দরজাও বাইরে থেকে থাকে তালাবদ্ধ। দালালদের আসার নির্দিষ্ট সময় না থাকায় আলো-বাতাসহীন সেসব ঘরে সৃষ্টি হয় অবর্ণনীয় কষ্টকর পরিবেশ। এতে কারও মৃত্যু হলেও সেই মরদেহ থাকে জীবিতদের সঙ্গেই। পাশাপাশি দালালদের মাধ্যমে দেশে ফোন করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের নামে টাকা আদায়ের ঘটনা তো আছেই। টাকা না দিলে ভাগ্য ‘ভালো’ থাকলে অর্ধেক পথেই বিক্রি হয়ে যেতে হয় ক্রীতদাস হিসেবে। আর তা না হলে দালালদের গুলিতে বা নির্যাতনে পথেই প্রাণ হারাতে হয়।
বাবু আরো জানান, পথে অনেকেই জীবন হারাচ্ছেন, অনেকেই বিদেশের কারাগারে বছরের পর বছর আটকে আছেন। দেশে স্বজনদের অনেকেই জানেন না তাদের জন্য উপার্জন করতে যাওয়া প্রিয়জনটি কি ভয়ানক বিপদে আছেন। অনেকে বেঁচে আছেন কিনা তাও জানে না পরিবার। মালয়েশিয়া যেতে বাবুর মোট খরচ হয়েছিল দুই লাখ ২০ হাজার। বাবলু নামে এক দালালের মাধ্যমে দেড় মাস পানিপথ পারি দিয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছান বাবু। দালালের বাড়ি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার খাইজু গ্রামে। মালয়েশিয়ায় দুই বছর তিন মাস চুরি করে কাজ করেছিলেন বাবু। সেখানে কংক্রিটের কাজ করতে গিয়ে মেশিনের ভুল ব্যবহারে ডান হাত কাটা পড়ে তার। এ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হলে খোঁজ পেয়ে যায় মালয়েশিয়ান পুলিশ। অবৈধ অভিবাসী হওয়ায় তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
পৈত্রিক জমি যা ছিল, তাতো তাকে বিদেশে পাঠাতেই চলে গেছে। তাই এক হাত নিয়েই এখন রাজধানীর বুকে রিকশা চালান বাবু। মালয়েশিয়ায় হাত হারিয়ে এখন রিকশাই তার সম্বল। প্রতিদিন ১০০ টাকা রিকশা খরচ ও খাবার খরচ বাদে মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। সেই টাকা বাড়ি পাঠান তিনি। তবে এক হাত দেখে অনেকেই ভয়ে তার রিকশায় উঠতে চান না।
বাবু বাংলানিউজকে বলেন, এক হাত না থাকায় রিকশা চালাতে নানা সমস্যা হয়। অনেকে বলেন, তুমি এক হাতে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। অনেকে আমার রিকশায় চড়তে চান না, ভয় পান। তখন অনেক কষ্ট লাগে। নিজে কষ্ট করে চললেও লোকের কাছে হাত পাতি না। কাজ করে ভাত খাই। নিউমার্কেট, গুলিস্তান, আমিজপুর এলাকায় রিকশা চালাই।
এক হাতে রিকশা চালাতে শারীরিক সমস্যা হয় জানিয়ে বাবু বলেন, শরীরের এক সাইড ব্যথা করে। আমি চাকরির জন্য অনেককে বলেছি, কিন্তু কেউ নিতে চান না। সবাই বলেন, তুই এক হাতে আর কি করবি? তাই এখন রিকশাই আমার সম্বল।
ভিডিওটি দেখুন এখানে-
বাংলাদেশ সময়: ১৯২২ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০২০
এমআইএস/এসআই