ইসলাম মানুষকে অর্থনৈতিক জীব হিসেবে নয় বরং মানুষ হিসেবে তাদের জৈবিক চাহিদা, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ পূরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যক্তি সত্ত্বাকে মৌলিক গুরুত্ব দিয়ে এক নিপূণ অর্থব্যবস্থা চালু করেছে।
পুঁজিবাদী সমাজে সরকারিভাবে সামাজিক নিরাপত্তার বিধান নেই বলেই সেখানে জনগণকে কর্তৃত্ববাদী পুঁজিপতিদের কৃপার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
জাকাত ব্যবস্থার ফলপ্রসূ প্রয়োগের মাধ্যমে সপ্তম শতকে সর্বপ্রথম যথার্থ কল্যাণ রাষ্ট্রের মডেল বিশ্ববাসীকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। জাকাতের সঠিক ব্যবস্থাপনার ফলে সমবণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সমাজ থেকে দারিদ্র্য সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হয়েছিল যার ধারাবাহিকতায় হজরত ওমর বিন আ. আযীজ এর শাসনামলে জাকাত গ্রহণ করার মতো একজন লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ বর্তমান বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ মোট জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি হলেও তা মাত্র গুটিকয়েক মানুষের কাছে কুক্ষিগত হয়ে আছে। জাকাতভিত্তিক সমাজে কারো পক্ষে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার যেমন সুযোগ নেই তেমনি কারো পক্ষে গরিব থাকারও সম্ভাবনা নেই।
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জাকাতের গুরুত্ব
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এখন থেকে আরও প্রায় পনেরো শত বছর আগে অন্ধকারাচ্ছন্ন শতধাবিভক্ত সমাজকে কলুষমুক্ত করে স্বপ্নের সোনালী সমাজে পরিণত করেছিলেন যেখানে জাকাতের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য।
জাকাতের কিছু উল্লেখযোগ্য ভূমিকা- ১) হতাশা ও চিন্তামুক্ত সমাজ গঠন ২) ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণ ৩) ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার প্রতিষ্ঠা ৪) অভাব, দূর্দশা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠন ৫) সম্পদকে পবিত্র করে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপন ৬) মজুদদারী বন্ধ করে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি। ৭) ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা।
জাকাতের শরয়ী বিধান
জাকাত একটি আরবি শব্দ যার অর্থ পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা বা পরিবর্ধন। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পূরণের পর সম্পদ পূর্ণ একবছরকাল অতিক্রম করলে ওই সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে জাকাত বলা হয়। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত আদায় করো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, আল্লাহ চান তোমাদের কলুষমুক্ত করে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করতে। (সূরা আহযাব-আয়াত: ৩৩)
ইরশাদ হয়েছে, তাদের সম্পদ থেকে জাকাত নিন যা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে ( সূরা তাওবা, আয়াত-১০৩)।
ইসলামী আইনে কোনো ব্যক্তির মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণের ভিত্তিতেই জাকাত নিরূপিত হয়। জাকাত প্রযোজ্য হয় এমন প্রধান প্রধান সম্পদগুলো হলো- ১) স্বর্ণ ও রোপ্য (নিসাব পরিমাণ)। অন্যান্য ধাতু যেমন হীরা, মুক্তা, মোতি, মণিবিশেষ ইত্যাদির উপর জাকাত ওয়াজিব না তবে ব্যবসার জন্য হলে জাকাত ওয়াজিব হবে।
২) নগদ অর্থ যেমন ব্যাংক নোট, ডলার, রিয়াল ও অন্যান্য মুদ্রা এবং অনুরূপ অর্থের ইনস্ট্রুমেন্ট যেমন চেক ও বিল যার বৈষয়িক মূল্য রয়েছে নিসাব পরিমাণ হলে তার জাকাত দিতে হবে।
৩) ব্যবসায়িক পণ্য যেমন জমি, গাড়ি ও অন্যান্য দ্রব্য-সামগ্রী যা কেনা বেচা হয় তার উপর জাকাত দিতে হবে।
৪) চতুষ্পদ প্রাণী যেমন উট, গরু ও ছাগল ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর জাকাতের কথা হাদীসে উল্লেখ নেই, তবে এসব প্রাণী ব্যবসার জন্য হলে জাকাত ওয়াজিব হবে।
৫) উৎপন্ন ফল ও ফসলের ক্ষেত্রে নিসাব হলো, সেচবিহীন জমির ফসলের শতকরা ১০ ভাগ এবং সেচপ্রদানকৃত জমির ফসলের শতকরা ২০ ভাগ জাকাত আদায় করতে হবে। আবার নিসাব পরিমাণ ২৬ মণ ১০ শের মতান্তরে ৩০ মণ না হলে ফসলের ওশর দিতে হবে না।
যেসব সম্পদের জাকাত দিতে হয় না
১) নিসাবের কম পরিমাণ সম্পদ ২) নিত্য প্রযোজনীয় ব্যবহার্য সামগ্রী ৩) ঘর-বাড়ি ৪) দালান- কোঠা যা বসবাস কিংবা কলকারখানা হিসেবে ব্যবহৃত ৫) ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি ও যানবাহন ৬) ওয়াকফকৃত সম্পত্তি ৭) পোষাপাখি ও হাঁস-মুরগী।
জাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে বর্ণিত সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতের আলোকে জাকাত ব্যয়ের খাত ৮ টি। যথা- ১) ফকির তথা এমন ব্যক্তি যে নিজের জীবিকার ব্যাপারে অন্যের মুখাপেক্ষী ২) মিসকিন তথা এমন অভাবী লোক যাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ হয় না ৩) জাকাত আদায়কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি ৪) ইসলামের জন্য যাদের মন জয় করা প্রয়োজন কিংবা কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে ইসলামের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য ৫) দাসমুক্তির জন্য এবং মুসলিম যুদ্ধবন্দিও এ খাতের আওতায় পড়বে ৬) ঋণগ্রস্থদের ঋণমুক্তির জন্য ৭) আল্লাহর পথে তথা আকীদা, বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছে দেয় যে পথ। ৮) মুসাফির তথা এমন ব্যক্তি যার নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে কিন্তু সফরে সে বিপদগ্রস্থ ও নিঃস্ব।
জাকাত না দেওয়ার পরিণাম
জাকাত আদায় না করলে তার ভয়াবহ শাস্তি বর্ণনায় কুরআনের ভাষ্য- আর যারা সোনা (অর্থ-সম্পদ) জমা করে রাখে এবং সেগুলো আল্লাহর পথে জাকাত হিসেবে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। কিয়ামতের দিন সেগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং সেগুলো দ্বারা তাদের মুখমণ্ডল, পার্শ্বদেশ এবং পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। আর বলা হবে এগুলোই সেই সম্পদ যা তোমরা পুঞ্জিভূত করে রেখেছিলে (সূরা তাওবা, আয়াত-৩৪-৩৫) যথাযথভাবে জাকাত আদায় না করলে আল্লাহর গজব নেমে আসে। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সা.) বলেছেন, যদি কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা জাকাত প্রদান না করে তাহলে তারা অনাবৃষ্টি-দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। যদি পশু-পাখি না থাকত তবে তারা বৃষ্টি থেকে একেবারেই বঞ্চিত থাকত।
লেখক: সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লি., গল্লামারী শাখা, খুলনা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০২০
এইচএডি/