ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

গল্পের নাম প্রেম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
গল্পের নাম প্রেম গল্পের নাম প্রেম: রাজীব মীর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সেলফোন আসেনি তখনও। ভোলায় যোগাযোগ করার জন্য টিঅ্যান্ডটি ফোন ভরসা। বাড়ির পাশেই অনুপম সিনেমা হলের লোকদের বললে ওরা বাড়ির লোকদের খবর দিতো। দুই বা তিন ঘণ্টা পর আবার ফোন দিলে প্রথমেই আম্মা, পরে আব্বা আর নিপা-জান্নাত ফোন ধরতো। কথা শেষ হয় না। ঘণ্টা পার হয়। শুধু একজন কোনো কথাই বলে না, কিন্তু ফোন ধরে রাখে। মিনিটের পর মিনিট গড়ায়, কথা বলে না। কোনো আবদার বা ঝগড়া- তাও নয়। কোনো কথা বলে না, অথচ শব্দ পাই, আশ্চর্য! সবচেয়ে ছোট বোন আমার সে, জান্নাত। তখন স্কুলে পড়ে। ওর নিঃশব্দ শোনার জন্য কঠিন নিয়মের বেড়ি পাড়ি দিয়ে বাড়িতে সরকারি ফোনের ব্যবস্থা করা হয়। 

একদিন আমি ফোন দিয়ে আম্মাকে বলি- জান্নাতকে দাও। খবরদার আর জান্নাত বলবি না।

ভয় পেয়ে গেলাম। খালপাড়ে লুকিয়ে কোনো প্রেমিক তরুণের সঙ্গে দেখা করায় আব্বার হাতে মার খেয়েছে। আম্মাকে বললাম- ওগুলো কোনো ব্যাপার নয়। আম্মা চিৎকার করে কাঁদছেন। বাবা, তোর মামা ঢাকা থেকে পীর নিয়ে এসেছে, সে নাম বদলে দিছে। এখন থেকে মুনিয়া বলে ডাকবি, তার অসুখটি তাহলে ভালো হয়ে যাবে।  

রোমান্টিক চিন্তায় সমর্থন দিয়ে বোনের পাশে থাকব কী, বিষয়টা দুশ্চিন্তায় রূপ নিলো। ১৯৯৫ সাল। তখন বিকেল হলেই শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে আমাদের জমজমাট চিন্তা-আড্ডা বসে নিয়মিত। বিজ্ঞান চেতনা করি। জুয়েল আইচ, হুমায়ুন আজাদ, ফরহাদ মজহার, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শওকত ওসমান, আহাদুজ্জামান স্যার- এদের আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এসবের মধ্যে দিন কাটাই।  

বন্ধু রাজীব হাসানকে বোনের বিষয়টা বলি। সে বলে এক্ষুণি ঢাকায় নিয়ে আসো। ততদিনে আমার ছোট বোন নিপা মৈত্রী হলে সিট না পেয়ে বন্ধু পুতুলের সহযোগিতায় তার বড় বোন দোলা আপার কক্ষে রোকেয়া হলে থাকে, আমি সলিমুল্লাহ হলে। ঢাকায় বড় চাচার সঙ্গে বৈষয়িক ঝামেলা। আম্মা আর জান্নাত এক আত্মীয়ের বাসায় উঠলো, মোহাম্মদপুরের শংকরে। ভোলার ফরিদ ডাক্তারের রেফারেন্সে অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদের শরণাপন্ন হলাম। তিনি সিটি স্ক্যান করতে দিলেন। মেডিনোভায় গেলাম। যা ডিমান্ড করলো, আমাদের হাতে নেই। জানিই না যে এতো টাকা লাগবে। নিপা, রোকেয়া হলের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি জয়ন্তী দিদির কাছে ফোন করলো। তিনি বললেন- এক্ষুণি এসে নিয়ে যাও।  

আমাদের অনেক সুহৃদ, অনেক প্রেম। এদিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি কাউন্টারের সামনে। হঠাৎ আমাদের দিকে এক ভদ্র মহিলা এগিয়ে এসেই বললেন- কত টাকা লাগবে? অবাক হয়ে বললাম, আপনাকে তো ঠিক...। বললেন, আমি বিদেশে থাকি। সমস্যা নেই, যা লাগে দিচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেডিনোভার মালিক হঠাৎ ভিজিটে আসলেন। তিনিও বিদেশ থেকে নেমেই সোজা এখানে। কাউন্টারের সামনে কেন ভিড়, কড়া ধমক। এরা কেন দাঁড়িয়ে। শুনেই বললেন- ওদের ৫০ শতাংশ কম করে দাও। ভয় ও আতংক ধরে গেল। এখনও টেস্ট করিনি। বোন টাকা নিয়ে এলো। কারও সহায়তা নিলাম না। সিটিস্ক্যান করা হলো।  

সেদিন বড় দিন। টেস্ট এর রিপোর্ট দেবে সন্ধ্যায়। বড় দিন যেন আরও বড় লাগলো। তখন প্রথম আলোতে আজকের ঢাকা ছাপা হতো। সকালে দেখেছি শেরাটনে বড় দিনের বড় অনুষ্ঠান। দুই বোনকে নিয়ে সেখানে গেলাম। ঢুকে পড়লাম । সজ্জিত নারী-পুরুষ-শিশু আর শত রকমের অদ্ভুত সব রঙিন খাবার। বোনদের বললাম- একদিক থেকে খাওয়া ধরো। তারা খেয়ে চলেছে ফুলেল খাবার, একটু পেছন থেকে আমিও।  

হঠাৎ সিকিউরিটির কয়েকজন এসে আমাকে ঘিরে ধরলো। স্যার- আপনি কি টিকেট করেছেন? স্যার বলাতেই বেশি ভয় পেলাম। কারণ পায়ে তখন সু-ও ছিল না। একদিকে সোনালী দুই বোন, অন্যদিকে নিজের প্রেস্টিজ। সাহস করেই বললাম- না , করিনি। সব দরজায় সিকিউরিটি, কেউ তাহলে আমাদের আটকায়নি কেন? বললেন, স্যার প্লিজ চিফ সিকিউরিটি স্যারের কাছে চলেন। ইচ্ছে করেই সময়ক্ষেপণ করছি, বোনরা একটু দেখুক, খাক। কবে আবার শেরাটনে আসতে পারি, কে জানে! বোনদের ইশারা করলাম, বেরিয়ে যাও দ্রুত। প্রধানকে বললাম, পূজায় বা ঈদে আমাদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নেই, এখানে কেন? তারা হতচকিত হয়। স্যরি স্যার! এখানে প্রতি জন ১৫ হাজার টাকা করে বুকিং দিয়েছেন। তাহলে পত্রিকায় দেওয়ার মানে কী! বলতে বলতে গেটের সীমানা পার হয়ে ভাই-বোন মিলে, দে দৌড়! 

সন্ধ্যায় আবার মেডিনোভা। রিপোর্ট নিয়ে ডা. দীন মোহাম্মদ। তিনি বললেন ডা. আহসান উল্লাহর কথা। আবার সিটিস্ক্যান। এবার অপারেশন। ফার্মগেটের আল রাজী হাসপাতাল। কিসের অপারেশন! ব্রেনে ছোট্ট একটা টিউমার, কেটে ফেলতে হবে। জান্নাত পাশেই, বন্ধু রাজীব হাসান আমাদের ভাইবোনের হাত একসঙ্গে ধরে রেখেছে। আমি চোখ মুছি, জান্নাত চুপ। যেন কিছুই হয়নি।  

বাসায় আম্মা আর নিপা অপেক্ষায়। শামছুদ্দিন কাকুর ছোট ভাড়া বাসা। সবাই বসে আছি। হুমায়ূন আহমেদের ‘এই সব দিন রাত্রি’র মতো। টুনির কথা মনে পড়তেই অপারেশনের চিন্তা বাদ। আবার ডাক্তার। ডা. আফজাল। পিজিতে ভর্তি করতে হবে। সিট নাই। মামা-খালু নাই। তবে বন্ধু তানিমের বাবা-মা ডাক্তার। পারলেন না। কামরুলের চাচা, নিউক্লিয়ার মেডিসিনের হেড, পারলেন না। আরেফিন স্যার, ঢাবি শিক্ষক নেতা। হলো না। সিট আর হয়ই না। এবার বিখ্যাত নিউরোসার্জন ডা. রশিদ উদ্দিন। তার কোনো ফোন নেই। রাত ১২টার পর থেকে রোগী দেখেন। সে এক মহাঝামেলা। কথা বলেন না, শুধু ওষুধ লেখেন। ছয় মাস পরে আসতে বলেন। এবার এমআরআই। আবার ওষুধ। বছর গড়ায়। গোটা ফ্যামিলি সম্পদ আর শক্তিতে নিঃস্ব হই।  

বাবা স্কুলশিক্ষক। দুই ভাই-বোনের ঢাকায় পড়া থাকার খরচ চালান। আত্মীয়রা সব কিছুটা সামনে বেশিটা দূরে সরেন। শুধু রোগীটাকে নিয়ে কী করবো সেটা জানার জন্য এক মাস ভোলার এক পীরের পেছনে আমি পড়ে থাকি। সেই পীর তখন যুগ্ম-সচিব আর ডা. রশীদ উদ্দিন তার মুরীদ। এক গভীর রাতে একজন বিখ্যাত নিউরোসার্জনকে বললাম, স্যার একটু কথা বলতে পারি। জ্বি , বলুন। একবার সিটিতে দেখলাম, দাগ ডান দিকে। আবার দেখছি - বাম দিকে। এটা কেন? তিনি আমাকে বললেন, কী করেন? বললাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়ি। কতো বছর পড়েন? তিন বছর। যান, বেরিয়ে যান। বিশ বছর ডাক্তারি করি, হারামজাদা আসছে তিন বছরের জ্ঞান ঝাড়তে।  

মনের মধ্যে ভয় ধরে যায়! বাংলাদেশে আ্যপেন্ডিক্স কাটতে কিডনি কেটে ফেলে, জোর খবর চালু তখন সংবাদপত্রে। আর রশিদ নয়। ভারত যাবো। আত্মীয়রা বাধ সাধলেন। আব্বাকে বললেন, একটার জন্য দু’টোই বাদ যাবে। মানে আমি আর নিপা। আমাদের পড়াশোনা হবে কীভাবে? আমি তখন টিউটোরিয়াল ক্লাশ করার জন্য মিশুক মুনীর স্যারের পেছনে দৌড়াচ্ছি । পাচ্ছি না। আমি আর আমার বন্ধু নভেরা দীপিতা একদিন স্যারকে পেলাম রাস্তায়। স্যার খুব দ্রুত হাঁটতেন। বললেন, ও তোমরা। ঠিক আছে মার্শাল ম্যাকলুহানের ‘মিডিয়াম ইজ দ্য মেসেজ’ বইটিতে কতোভাবে এ লাইনটি এসেছে সেটা লিখে আবার দেখা করো। মিশুক স্যারকে আর না পেয়ে সেলিম আহমেদ স্যারের কাছে ট্রান্সফার হলাম। স্যার তখন রিডার্স ডাইজেস্ট দেন। আমরা পড়ি আর বিশ্লেষণ করি। স্যারের সঙ্গে প্রেম হয়। সব শেয়ার করি। বোনের বিষয়টি বললাম। ভারত যেতে চাই। অথচ সামনেই পরীক্ষা। মিস হবে তো। ফার্স্ট হওয়ার স্বপ্ন আমার। স্যারের কথা শুনে আমি অবাক। বললেন , রাজীব ফার্স্ট হয়ে কী করবেন! বললাম- বড় চাকরি করবো। আপনার মতো হবো। বললো- চাকরি পেয়ে কী করবেন? বললাম- টাকা পাবো, সম্মান পাবো। টাকা দিয়ে কী করবেন- বললাম , বাপ-মা-বোনদের দেখবো। বললো- যদি বোন না থাকে! পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টে চাকরির চিন্তা ফালতু মনে হলো।  

বিশাল এক কর্মযজ্ঞ আর বন্ধু শাকিল, রবীন, সঞ্জীব, ইমরুলের সার্বিক কলিজা পোড়া ভালোবাসার কল্যাণে আব্বার আর্থিক যোগান আর কিছু আত্মীয়ের সহায়তায় বোনকে নিয়ে ইন্ডিয়ার ভেলোর গেলাম। সিএমসিএইচ হাসপাতাল। সে এক অন্য গল্প, গল্পের গল্প। আমাদের জান্নাত অনার্স, মাস্টার্স, সিইনএড, বিএড ইত্যাদি শেষ করে এখন ঢাকা থেকে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা দূরের লৌহজংয়ের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি করে বাচ্চা-স্বামী পরিজন ঘিরে সুখের জীবন কাটায়।  

আমার জীবনে ওর বেঁচে ওঠা জীবনের চেয়ে বড় আর কোনো অর্জন নেই। সেদিনও ওকে ফোন দিয়েছিলাম। এখন তো সেলফোন। আগের মতোই আবেগ এলে কথা বলতে পারে না সে, কিন্তু আমি শব্দ পাই। জল গড়ানো নিঃশব্দ শুনতে আজও আমার অসাধারণ লাগে, অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ভালোবাসি, বোন!

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।