ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সৌদি আরব

আমির হোসেনের নির্বাসনের জীবনই যেন ফুরোয় না!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৭
আমির হোসেনের নির্বাসনের জীবনই যেন ফুরোয় না! আমির হোসেন, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর,কম

কিং আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জেদ্দা (সৌদি আরব থেকে): আরবের আকাশে তখন সন্ধ্যা তারা। জেদ্দার আকাশ থেকে টুপ করে নিজ দেশের মাটিতে নামলো সৌদি এ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এসভি ৮০৩। যেটি ছুঁয়ে এসেছে ঢাকার মাটি। দীর্ঘ আকাশ যাত্রায় ক্লান্ত যাত্রীদের অনেকেই পড়ি-মরি করে ছুটছেন ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে। কেউ বা আবার ট্রানজিট লাউঞ্জে।

এদেরই একজন আমির হোসেন (৩৫)। উড়োজাহাজের খোল থেকে নামলেন ধীরে-ধীরে।

অনেকটা জোর করেই দেহটাকে যেন টেনে নামালেন জেদ্দার ভূমিতে। বিষণ্ণ আর অশ্রুভেজা নয়নে। ঢাকা জেলার দোহার থানার গাজীরটেক গ্রামের আব্দুল হান্নানের ছেলে আমির হোসেন।

সৌদি আরবে দীর্ঘ ৮ বছর ২৫ দিনের ‘নির্বাসন’ শেষে মাত্র ছয় মাসের ছুটিতে এবার দেশে গিয়েছিলেন। তবে ছুটির ১০দিন বাকি থাকতেই ফিরে এসেছেন আগের সেই ‘নির্বাসিত’ জীবনে। ধূসর এই মরুভূমির দেশে। এর মধ্যে স্ত্রী, মা, বাবা, ভাই-বোনদের টানেই মনটা যেন পড়ে রয়েছে ঢাকার দোহারের মাটিতে।

প্রবাস জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর কষ্টের ঝাঁপি নিজেই খুলে দেন বাংলানিউজের কাছে। এইচএসসি পরীক্ষার পিঁড়িতে বসার আগেই ২০০৮ সালের ৮ জুলাই ভাগ্য পরিবর্তনে আশায় পাড়ি জামান এই মরুর দেশে। এসেই পড়েন বিপত্তিতে।

আমির হোসেন বলেন, ‘যে নিয়োগকর্তার (কফিল) ওয়ার্ক পারমিট (আকামা) নিয়ে এ দেশে এসেছিলাম। কাজে যোগ দিতে গিয়ে দেখি তাদেরই লাইসেন্স বাতিল। যে কারণে হয়ে গেলাম অবৈধ শ্রমিক। এর মধ্যে নানা প্রবঞ্চণা আর প্রতারণার শিকার হয়ে একরকম ‘নির্বাসিত’ জীবনেই যেতে হয় আমাকে। পরে নানা ঘটনাচক্রে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। আবার সেই কমপ্লেক্সে ফিরে এলাম। সেখানে এক অবরুদ্ধ পরিবেশেই কাজ করতে হতো আমাকে। যদি ধরা পড়ি- জেল নইলে দেশে ফেরত। এই ভয়ে কখনও কর্মস্থলের নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যাবার সুযোগও ছিলো না আমার। ’

প্রথমে বেশ অনিশ্চয়তা। পরে উপায় না পেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশাতেই নিয়োজিত করতে হয় নিজেকে। শুরুতেই একটি অ্যালুমিনিয়ামের দরজা তৈরির ওয়ার্কশপে কাজ নেন তিনি। মাস খানেক পর কাজ নেন একটি তেল মজুতকারী প্রতিষ্ঠানে। সেখানে বিশাল-বিশাল তেলের ট্যাঙ্কারে ওয়েল্ডার হিসেবে কাজ জোটে তার।

তপ্ত মরুভূমিতে তীব্র উষ্ণতা আর তাপমাত্রায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঝালাই করে একটি ট্যাঙ্কারের সঙ্গে আরেকটির জোড়া লাগানোর কাজই করতে হয় তাকে। লেবার ভিসার চার লাখ টাকা ব্যয়ে এ দেশে এসে অভিবাসী ব্যয় তুলতেই আমার ব্যয় হয় এক বছরের বেশি সময়। এভাবে কেটে গেছে তিনটি বছর। অনেক সময় কাজ করেও মজুরি পাননি তিনি।

 সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশি আমির হোসেন, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আমির হোসেন বলেন, “জিজান এলাকায় আমাকে ১৫ দিন খাটিয়ে মজুরি দূরের কথা, খাবার টাকাটাও না দিয়ে কেটে পড়েছিলো নিয়োগকর্তা। আমার সঙ্গেই কাজ করে ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের শ্রমিকরা। আমি ৪ লাখ টাকা খরচ করে সাড়ে আট বছর আগে এ দেশে এসেছি। শুনে তারা অবাক হয়। বলে, ‘এত্তো টাকা লাগে। আমরা তো ভারত থেকে আসি মাত্র ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে’। ”

এমন কথা শুনে আমিও অবাক হই, কী করে সম্ভব! ওদের চেয়ে সাত-আটগুণ বেশি টাকা খরচ করে এলেও বেতন তো আমার সমানই। কখনও-সখনও আমার চাইতেও তাদের বেশি। সৌদিতে মন্দা। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম দিন-দিন পড়ছে। আর কপাল পুড়ছে আমাদেরও। ঘণ্টা প্রতি আগে মজুরি ১৮ থেকে ২৫ রিয়েল পেলেও সেটা এখন নেমেছে ১৪ থেকে ১৫ রিয়েলে। এখানে এক রিয়েল সমান বাংলাদেশের ২০ টাকা। এক অর্থে পরিশ্রম বাড়িয়েও আগের চাইতে আয় বরং কমছে বলে জানান তিনি।

‘সৌদি সরকার ২০১৩ সালে অবৈধ শ্রমিকদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলো। তিন মাসের সময় দিয়ে বৈধকরণের সুযোগ দিলো। আমি পাসপোর্ট জমা দিলাম। নিয়োগকর্তার এক প্রতিনিধি ১৫শ’ রিয়েল নিয়েও মেরে দিলো। যাই হোক ভাগ্যক্রমে অপর এক নিয়োগকর্তা (কফিল) ধরে বৈধ হলাম’- যোগ করেন আমির হোসেন।

তিনি বলেন, ‘এভাবেই এই মরুর দেশে টানা ৮ বছর ২৫ দিন থাকার পর ছয় মাসের ছুটিতে গত বছরের ৩১ জুলাই দেশে গেলাম। বলতেও বুকটা ভেঙ্গে আসে। ময়-মুরুব্বি যাদের রেখে এসেছিলাম। তাদের অধিকাংশের এবার দেখা পাইনি। দাদা-দাদি, নানা, কেউই আর জীবিত নেই। ’

আমিরের বাবা দেশে জনতা ব্যাংকে চাকরি করেন। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় এবং ভাইদের মধ্যে বড়। এতদিন পর দেশে ফিরে দেখেন তার বিয়ের আয়োজন। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর একই থানার রায়পাড়া মনসুর আলীর মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস তানহার (১৯) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এখন তিনি বাবা হতে চলেছেন।

‘এতদিনের প্রবাস জীবনের প্রাপ্তি বলতে, নারায়নগঞ্জে ফতুল্লায় পৌনে দুই কাঠা জমি। ছোট ভাই আরিফকে দুই লাখ টাকা দিয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠানো এবং ছোটভাই ও বাবার সহায়তায় গ্রামে তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ৩২শ’ বর্গফুটের বাড়ির একতলা বাড়ি। ’ এ পর্যন্ত বলেই দম নেন আমির হোসেন।

আবার ছলছলে নয়নে বলতে থাকেন, ‘সৌদি আরবের জেদ্দার কিং আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন তামানিন আখের এলাকায় আমার বাস‍া। আগে সপ্তাহিক ছুটিতে এখানে ছুটে আসতাম। দূর থেকে উড়োহাজাজের ওঠা-নামা দেখতাম। আর ভাবতাম, কবে যে উড়াল দিয়ে দেশে যাবো। এবার নববধূ আর অনাগত সন্তানের মায়ায় মনটা ভীষণ ছটফট করবে। সময় পেলেই ওড়াল দিতে চাইবে মন। ’

তিনি বলেন, ‘এবার ভাবছি, ভালো একটি কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে নেবো। বছর খানেক কাজ করেই দেশে ফিরবো। প্রবাস জীবন যে কত কষ্টের, বলে বোঝাতে পারবো না। দেশ থেকে সদ্য ফিরে এমনটা মনে হচ্ছে ঠিকই। তবে রুঢ় বাস্তবতায় এই চেতনাও যে একটা সময় থিতু হয়ে আসবে, সেটাও জানি। আসলে আমাদের জীবনটাই যে এমন।

‘নির্বাসনের জীবনই যেন ফুরোয় না’ গভীর আক্ষেপে এমন কথা বলেই ল্যাগেজ নিয়ে গন্তব্যে হাঁটতে থাকলেন আমির হোসেন।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৭
টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad