ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ডিসেম্বর অন যশোর রোড

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৭
ডিসেম্বর অন যশোর রোড যশোর রোড

দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় পর বেনাপোল গেলাম। পুরনো হাতে-লেখা পার্সপোর্ট হাতে নিয়ে ফিরে যাই তের বছর আগের সেই বেনাপোল। দুইপাশে সবুজ-শ্যামল প্রাচীন বৃক্ষরাজি। তারই ছায়া মাড়িয়ে বেনাপোল, পেট্রাপোল হয়ে গাড়ি চলছিল কলকাতার পথে। কিন্তু সেই সবুজ-শ্যামল গাছগুলো আজ প্রায় বিলীন।   

যশোর থেকে বেনাপোল। সবুজের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে একটি সড়ক।

দু’পাশে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন গাছগুলো। আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে যশোর রোডের রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আমরা হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যশোর রোডের একটা সম্পর্কের কথাই জানি। কিন্তু যশোর রোডের ইতিহাস আরও প্রাচীন।

যশোর রোড
ইতিহাসবিদ সতীষচন্দ্র মিত্রের বর্ণনা থেকে যশোর শহরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস জানা যায়। তার মতে, বর্তমান যেখানে সুন্দরবন, সেখান থেকেই যশোর শহরের গোড়াপত্তন। সময়ের ব্যবধানে তা সরে আজকের ভৈরব নদীর তীরে এসে ঠেকেছে। বলে রাখা ভালো, এ অঞলে বৃটিশ ভারতের প্রথম শহর যশোর।  
যশোরের ইতিহাসের সঙ্গে যে নামটি অমর হয়ে রয়েছে তিনি রাজা প্রতাপাদিত্য। মুঘল শাসনামলে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে ঈসা খাঁর পরেই রাজা প্রতাপাদিত্যর নামটি চলে আসে। প্রতাপাদিত্যের রাজধানী নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও অধিকাংশের বর্ণনাতেই ধূমঘাট ও ঈশ্বরীপুরের নাম পাওয়া যায়। সেই ধূমঘাট আজকের সাতক্ষীরার অন্তর্ভুক্ত। শ্যামনগর থেকে মুন্সীগঞ্জে যাওয়ার পথেই ধূমঘাটের অবস্থান।
যশোর রোডের ইতিহাসও যশোরের মতোই প্রাচীন। প্রাচীন যশোর (ধূমঘাট) থেকে শুরু করে কালীঘাট পর্যন্ত এ সড়কটি আজ আর যশোর রোড বলে পরিচিত নয়। বর্তমানে শুধু কালীগঞ্জ থেকে বেনাপোল (বাংলাদেশ অংশ) ও পেট্রাপোল থেকে কালীঘাট (ভারত অংশ) পর্যন্ত সড়কটিকেই যশোর রোড বলা হয়। বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য (কালীগঞ্জ থেকে বেনাপোল) প্রায় ৭০ কি.মি. আর ভারতে  এর দৈর্ঘ্যও একই।

যশোর রোড
আজ যে যশোর রোড দেখি তা জমিদার কালীপোদ্দারের যশোর রোড। কালীগঞ্জের জমিদার ছিলেন তিনি। মা তার যশোদাদেবী। মায়ের ইচ্ছা গঙ্গাস্নানে যাবেন। কিন্তু কীভাবে? পথ নেই, নেই যোগাযোগের  ব্যবস্থা। জলপথে গেলে বহুদিন লেগে যায়, তার ওপর ঝক্কিও কম নয়।
মায়ের ইচ্ছা জলপথ নয়, সড়ক পথেই যাবেন গঙ্গাস্নানে। মাতৃভক্তির কথা উঠলে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম। কিন্তু জমিদার কালীপোদ্দারও কি কম ছিলেন? মায়ের ইচ্ছাপূরণে মাত্র দু’বছরের মধ্যে কালীগঞ্জ থেকে কলকাতার গঙ্গাতীরের কালীঘাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেন। আজকের দিনে দুই লেনের পাশে দুই লেন সড়ক নির্মাণ করতে আমাদের পাঁচ থেকে সাত বছরও লাগে। আর আমাদের সড়ক নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই মাত্র দু’বছরে এরকম একটি সড়ক নির্মাণ করা মোটেই সহজসাধ্য ছিলো না। কিন্তু কালীপোদ্দারতো থামার পাত্র নন। রাজমাতার ইচ্ছাই তার জন্য আদেশ। রাস্তা বানিয়ে দিলেন।  
কিন্তু রাজমাতা আবারও বিগড়ে বসলেন। মা বললে, ‘রাস্তাতো দিলে বাছা, কিন্তু এতো রোদ্দুর কীভাবে যাই বলো তো’? জমিদারমশায় তাই শাহী লস্কর, পাইক-পেয়াদাকে মায়ের সঙ্গে পাঠাবেন বলে হুকুম দিলেন। কিন্তু মা তাতে রাজী নয়। গো ধরলেন, আমি না হয় শাহী লস্কর নিয়ে গঙ্গাস্নানে যাবো, কিন্তু প্রজাদের কী হবে বাছা?
মায়ের ইচ্ছার কথা রাজা ঠিকই বুঝলেন। তাই তিনি আর দেরি না করে রাস্তার দু’ ধারে গাছ লাগিয়ে দিলেন। এতে প্রজাদেরও উপকার হবে আর রাস্তার সৌন্দর্য-শোভা বাড়বে। হাজার-হাজার শিশু গাছ (রেইন ট্রি)-কড়ই গাছ লাগিয়ে দিলেন রাজা মশায়। কথিত রয়েছে, এই রেইন ট্রি-কড়ইর শীতল ছায়া ধরেই জীবন সায়াহ্নে রাজমাতা যশোদাদেবী গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। ধন্য রাজমাতা, সাধু রাজা প্রতাপাদিত্য! সেই শীতল-ছায়া আমরা আজও পাচ্ছি।
ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে যশোর রোডের শত-শত বছরের প্রাচীন বৃক্ষরাজি। তারা দেখেছে অনেক কিছুই। দেখেছ জমিদার কালীপোদ্দার, রাজমাতা যশোদাদেবী, রাজা প্রতাপাদিত্য, শেরশাহ সূরীকে- যাদের আমরা কেউ দেখিনি। এই সড়ক ও বৃক্ষগুলো দেখেছে মুঘল আমল, দেখেছে বারো-ভূইয়াদের আমল। এরা দেখেছে, বৃটিশ শাসন ও তাদের প্রস্থান। দেখেছে দাঙ্গা ও ভারত-বিভক্তির ফলে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম। প্রত্যক্ষ করেছে, দাঙ্গার ফলে কোটি মানুষের মানচিত্র পরিবর্তন ও রক্তপাত। সবকিছুরই নীরব সাক্ষী এই যশোর রোড ও প্রাচীন গাছগুলো।
যশোর রোড বিশ্ব-ইতিহাসের আরেকটি বিশেষ ঘটনারও সাক্ষী। একটি জাতির জন্মযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এই সড়ক। একাত্তরের পাক-হানাদারদের আক্রমণের ফলে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি বাংলাদেশ থেকে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকাগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারত আশ্রয় নেওয়া বাঙালিদের বেশিরভাগই যশোর রোড ধরে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।
সেদিন এ পথ ধরেই হেঁটে গিয়েছিল লাখো-কোটি বাংলাদেশি শরণার্থী। এই ডিসেম্বরেই বেনাপোল গেলাম। সড়ক ধরে গাড়ি চলতেই মনে পড়লো তাদের কথা, যারা চিরদিনের ভিটে-মাটি ছেড়ে, বাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছ অথবা শান বাঁধানো পুকুর ঘাটটি পেছনে ফেলে কিংবা মাত্র উড়তে শেখা পায়রা জোড়াকে মুক্ত করে দিয়ে মুক্তির সন্ধানে শরণার্থী জীবন বরণ করেছিলেন, হেঁটেছিলেন এই পথ ধরে অজানা গন্তব্যে।
এসবকিছুরই সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই বৃক্ষগুলো। যশোদাদেবীর বৃক্ষগুলো যুগযুগ পর ছায়া দিয়েছিল আমাদের শরণার্থীদের।
পথ চলতে চলতে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম একটি বেশি বয়সী বৃক্ষকে। ভাবলাম, হয়তো এরই তলে ক্ষণিকের তরে ছায়া খুঁজেছিলেন আমারই আপনজন। হয়তো ক্লান্তি দূর করেছিলেন আরও অনেকটা পথ যেতে হবে বলে। শ্রদ্ধাবনত হই ওই বৃক্ষের কাছে।
মনে পড়ে গেলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অ্যালেন গিনসবার্গের সেই বিখ্যাত কবিতাটি:

Millions of souls nineteenseventyone
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan

আসলে আমরা কথা কথায় ইতিহাস আওড়াই। কিন্তু আমাদের পথ চলা ইতিহাসের পথ ধরে নয়। ঐতিহ্যকে লালন না করে ইতিহাসকে কি ধারণ করা যায়?  

যশোর রোড

সে যাই হোক। ইতিহাসের সাক্ষী এই গাছগুলোকে রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু এগুলোকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেই। প্রায় ১২ বছর আগে এই পথে যতো গাছ ছিলো আজ তার অধিকাংশই বিলীন, বড় গাছগুলো একটিও নেই। মাঝারিগোছের কয়েকটি গাছ রয়েছে মাত্র। বনখেকো, গাছখেকোদের থাবায় সবই প্রায় নিশ্চিহ্ন। কিন্তু তারা যে মূলত ইতিহাসখেকো, এর হিসেব কে করবে?

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৬
এনটি/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।