বর্ষার নাগরিক দুর্ভোগের সময় নগর কর্তৃপক্ষ সঙ্গীতকে দারুণ ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। বিনোদনের একঘেয়েমি কাটাতে এবার বর্ষায় রবীন্দ্র সরোবরে বাজবে শুধুই বর্ষার গান।
দমদম বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছিল দীপক। কিশোরগঞ্জের এই ছেলেটি এখন নিউটাউনের বড় ব্যবসায়ী। আমার ব্যাগ-পত্র নিয়ে সে চলে গেলে বৃষ্টি মাথায়, আমি টার্মিনালের গা-ঘেঁষা এসি বাসের কাউন্টারে এসে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে দক্ষিণের গড়িয়া যাওয়ার বাসে চেপে বসি।
পথে সাইন্সসিটিকে কিছুক্ষণ কাটিয়ে গড়িয়ার মোড়ে। পথেই পড়ল মুকুন্দপুর-সন্তোষপুর। কলকাতার চিকিৎসার আধুনিক আয়োজনগুলো মূলত এদিকেই।
এখান থেকে যাদবপুরের দিকেও যাওয়া যেত। কিন্তু আমি চললাম গড়িয়ার দিকে। ওখানে সাবেক চাকরিজীবী হালের ব্যবসায়ী প্রিয়তোষ অপেক্ষা করছেন। তিরিশ বছর আগে ঢাকায় পরিচিত প্রিয়তোষ এখন কলকাতায় বাড়ি-গাড়ি করে জমিয়ে বসেছেন। আরও কয়েক জনের সঙ্গে দেখা করে দক্ষিণ থেকে সেন্ট্রাল কলকাতার পথে এলাম। পথে থেমেছি টালিগঞ্জ এবং খালের মতো সরু আদিগঙ্গার পাশে ‘দিদির পাড়া’ কালীঘাটে। এদিক দিয়ে বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে নদীর পশ্চিম দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের মেইন পয়েন্টের আশপাশটাও খানিক ঘুরে দেখলাম।
আরও সামনে এগিয়ে আলিপুরের সরকারি অফিসগুলো, চিড়িয়াখানা ইত্যাদিতে ঢুঁ মেরে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। পথে পড়ল প্রেসিডেন্সি জেল, পুলিশ সদর দপ্তর ‘ভরাণী ভবন’। গাড়িতেই রেড রোড, ট্যান্ড রোড ইত্যাদিতে ঘুরে ময়দান, ভিক্টোরিয়া, ফোর্ট উইলিয়ামে চক্কর দিয়ে গঙ্গাতীরের বাবুঘাটে এলাম। এখান থেকে গঙ্গা হয়ে নানা জায়গায় যাওয়ার লঞ্চ, স্টিমার সার্ভিস রয়েছে। এ রকম একাধিক জেটি সামনের চাঁদপাল ঘাটেও দেখলাম। কেউ নদীর অপর পাড়ের হাওড়া থেকে বাসে শহরের জ্যাম এড়িয়ে নদী পথেও চলে আসতে পারেন। সামনেই হাইকোর্ট। পুরনো ব্রিটিশ ভবনের পাশে নতুন ভবন হয়েছে। চলন্ত সিঁড়ির ফুটব্রিজ দিয়ে দুই ভবনের সংযোগ সাধিত হয়েছে।
এখানে কয়েক জনের সঙ্গে দেখা করার কাজটি সারতে হলো। আমার হাতে অল্প সময় আছে । বিশেষভাবে অনেকের বাসায় যাওয়ার সুযোগ না হওয়ায় চলতে চলতেই দেখা-সাক্ষাৎ-আলাপের কাজটি সেরে নিতে হলো। এখান থেকে যেতে হবে পার্ক সার্কাস, পুরনো বন্ধু মাহমুদের সাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার আমন্ত্রণ রক্ষার্থে।
হাতে কিছুটা সময় থাকায় নগরের বাস সার্ভিস দেখার ইচ্ছা হলো। ৩৯ নম্বরের বাস ধরে চলে এলাম তিলজলায়। পিকনিক গার্ডেন এলাকাও দেখে এলাম। বাইপাসের দিকে না গিয়ে ব্যান্ডেল রোড ধরে বালিগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির মোড় হয়ে চিত্তরঞ্জনে নেমে পার্ক সার্কাস। সামনেই সার্কাস মাঠ। মুসলিম এরিয়ার আমেজ পেলাম। তবে অধিকাংশই উর্দূ ভাষি। গোবরা কবরস্থানের পাশে মাহমুদের সঙ্গে দুপুরের কিছু সময় কাটিয়ে মৌলালী আর এন্টালি হয়ে শিয়ালদহ এলাম। এগুলোও মুসলিম এলাকা। তবে দিনে দিনে এলাকাগুলোর বাসিন্দা আর নাম বদলে গেছে। মওলা আলী নামের জায়গাটি বলতে বলতে হয়ে গেছে মৌলালী। ইনায়েত আলির নামের এলাকাটি সন্ধি করে লোকজন এন্টালি বানিয়ে ফেলেছে। পথে পড়ল রামলীলা ময়দান। মাইকে কীর্তনের আওয়াজ আসছে।
শিয়ালদহের নতুন-পুরাতন স্টেশনের পাশ দিয়ে কলেজ স্ট্রিট চলে এলাম। আনন্দ প্রকাশনীর সামনে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে বিধান সরণীতে নেমেছি। এ পথটি ধর্মতলার দিক থেকে শ্যামবাজারের পাঁচ মাথায় গেছে। শিয়ালদহ থেকে শ্যামবাজারের আসার অন্য পথও আছে শ্যামবাজারের মোড় থেকে। কলেজ স্ট্রিটে কয়েক জন অপেক্ষা করায় এ পথেই এলাম।
কলেজ স্ট্রিটে অনেকক্ষণ হেঁটে এবার মজার অভিজ্ঞতা হলো। যেসব আলাদাভাবে লিখতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে স্টার থিয়েটার। পথে পড়ল স্কটিশ চার্চ কলেজ, বেথুন, মেডিক্যালের একটা অংশ, হেঁদুয়া। হাতিবাগান থেকে শ্যামবাজার না এসে উল্টো দিকে গিরিশ পার্ক হয়ে বড়বাজার, জোড়াসাঁকো ছুঁয়ে এলাম। পথে বাগ বাজার পড়ল। রাত আটটার দিকে আবার হাতিবাগানের মোড়ে। নান, ডাল আর ফিস কবিরাজি ক্যাটলেট খেয়ে কিছুটা সময় এখানেও কাটাতে হলো। উত্তর কলকাতার কয়েকজন দেখা করতে এসেছে এখানে। এক ফাঁকে হেঁটে মোহনবাগান ক্লাসের বিখ্যাত খেলোয়াড়দের মূর্তি দিয়ে সাজানো সম্মান স্মারক দেখে এলাম। রাস্তার দু’পাশ দোকানময়। মার্কেটিং-এর এন্তার আয়োজন নিউমার্কেট, চৌরঙ্গি, ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত রাস্তায়। কিছু দোকান দেখলাম স্মৃতিময়: খুলনা স্টোর, বিক্রমপুর ট্রেডার্স ইত্যাদি নাম। তিলজলায় কুষ্টিয়া রোডও দেখেছি দুপুরের দিকে। ওখানে অবশ্য কুষ্ঠিয়া লেখা দেখলাম। এই নামে একটি হল বা কমিউনিনিটি সেন্টারের দেখা পেয়েছিলাম।
হাতিবাগান চৌমাথায় একটি মদের দোকানের সামনে ভিড়। লোকজন ঠেলাঠেলি করে ছোট-বড় বোতল কিনে বাড়ি চলেছে। দেশবন্ধু পার্কে সাবেকি লেখকরা সুরার আসর বসাতেন। এখন পাবলিকলি সেটা হয় কি না কে জানে! সামনের রাস্তাটি বাম দিকে চলে গেছে সোনাগাছির কুখ্যাত পতিতালয়ে। ঔপনিবেশিক অন্ধকার মেখে কলকাতার অন্তঃস্থলে এখনো সেই প্রচ্ছায়া। কত নারী যে এখানে কেনা-বেচা হয়েছে! পূর্ববঙ্গের লুটেরা জমিদার বাবুরা কোঠা ভাড়া করে এখানে নিজস্ব বারবণিতা ও রক্ষিতা পোষণ করত। কৃষকের রক্ত ভেজা টাকায় কলকাতার কমলালয়ে উছলে পড়ত অপচয় ও বেপরোয়া জীবনের ভোগের পেয়ালা! বৃষ্টি আমাকে অভিশপ্ত অতীতের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল। দৌঁড়ে ২৪০ নম্বর বাসে এসে উঠলাম। ডানলপ হয়ে বাস যাবে ব্যারাকপুর কিংবা কামারহাটি। আমাকে নামতে হবে পথেই।
কালকের আধা দিন হাতে নিয়ে দমদম, বিরাটি , নিমতা, যশোর রোড হয়ে এগুবো। নাগের বাজারে কিছু কাজও আছে। গার্ডেন রিচের দিকে একবার না গেলেই নয়। মেটিয়া বুরুজের ওখানেও কথা বলতে হবে কয়েকজনের সাথে। সুরাইয়া এক সময় ওখানে থাকতো। ওর কিছু আত্মীয়-স্বজন এখনো ওদিকটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আসার আগে আমাকে বলেছিল দেখা করতে। এসব ভাবতে ভাবতে মধ্য রাতের অপেক্ষাকৃত ফ্রি বি.টি. রোড ধরে বাস আমার গন্তব্যে চলে এলো। ঝির ঝির বৃষ্টি এখনো ঝরছেই। বাস থেকে বড় রাস্তায় নেমে পেছনের দিকে তাকাই। পেছনে রইল স্মৃতি ও নস্টালজিয়ার আদি কলকাতা।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, জুলাই ৮, ২০১৭
জেডএম/