শামীম ভাই হঠাৎ বলে বসলেন খুলনা যাবেন। ব্যাপক গরম পড়েছে।
গাড়ি চলতে শুরু করলো রাতের আঁধার কেটে। এক ঘুমে সকাল ছটা। যশোরের সবুজ সমতল দিয়ে বাস ছুটছে। অবাক হয়ে দেখলাম চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। অথচ কোনো ঠাণ্ডা নেই। এ অঞ্চলে এটিই আমার প্রথম আসা। জানালা গলে চারপাশ ঘুরতে লাগলো আমার কৌতূহলী দৃষ্টি। শিল্পপ্রধান এ অঞ্চল। এখনকার অবস্থা নাকি ভালো না। যাইহোক এমন সব ভাবনার মাঝেই খুলনা পৌঁছে গেলাম।
খাদিজা আপুর ছোট ভাই আমাদের নিতে এসেছে। প্রথম দেখাতেই খুলনার প্রেমে পড়েছি। ছুটির দিন বলেই কিনা রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। খুব কাছেই সুন্দরবন। এমন ভাবনাই শহরটিকে বোধহয় মনে ধরিয়ে দিয়েছিল। খাদিজা আপুর বাড়িতে তার মায়ের উষ্ণ অভ্যর্থনা। নাস্তায় হরেক আয়োজন দেখে হাত-মুখ ধোওয়ার আগেই টেবিলে বসে যাওয়ার যোগাড়। দুর্জনেরা বলে আমি নাকি সেদিন দাঁত ব্রাশই করিনি!
হরেক রকমের পিঠা আর খুলনার স্পেশাল মিষ্টি। পেট পুরে যতটুকু খাওয়ার প্রয়োজন তারচেয়েও বেশি খেলাম। সেখানে বসেই জানা গেলো এর পরের পরিকল্পনা। আমরা এখন যাবো বাগেরহাট। ষাট গম্বুজ মসজিদ আর হজরত খান জাহান আলীর মাজার। তারপর মোংলা হয়ে সুন্দরবনের করমজল। আমার এ অঞ্চল সম্পর্কে ভালো ধারণা নেই। তখনও মনে সন্দেহ একদিনে এতগুলো জায়গা ঘোরা আদৌ সম্ভব? সঙ্গীরা অভয় দিলো সব দেখেই তবে রাতে ঢাকার বাসে ওঠা হবে।
আমরা বাগেরহাটের বাসে উঠে বসলাম। বেশ ভালো রাস্তা। রাস্তার পাশে এক একটা গাছপালা ঢাকা নিঝুম গ্রাম। প্রায় সব বাড়ির সামনে পুকুর। সঙ্গে প্রচুর সুপারি আর বাঁশঝাড়ের আধিক্য। জীবনানন্দ এসে ভর করলেন। তার মাত্র কয়েকদিন আগে প্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবু পড়ে শেষ করেছি। ফলে জীবনানন্দ মশাই ভূত তখনও মাথায় গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন। শ্যামল বাংলার প্রতিচ্ছবি চারপাশে। এরপর যতবার এ অঞ্চলে গিয়েছি সুপারি বাগান বাঁশের ঝাঁড় আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আমাকে আচ্ছন্ন করেছে। খুলনা বাগেরহাট আঞ্চলিক সড়কের পাশেই ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ। এ স্থাপত্যের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন করে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ঘষে মেজে একে নতুন করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। কমপ্লেক্সে নানা আধুনিক সুযোগ সৃষ্টি করে একে পর্যটনবান্ধব করার প্রচেষ্টা। কিন্তু আমার মনে হলো এতে কেন যেন এর প্রাচীনত্বের গাম্ভীর্য আর ইতিহাসের সৌকর্যেরা পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে।
বিশেষ করে এর ভেতরে আন্ডা বাচ্চা ছেলে বুড়ো দলে দলে যেভাবে হৈ হল্লা করে প্রবেশ করছে তাতে অন্তত এর মর্যাদা রক্ষা হয় না। তারপরও বিরাট দীঘির পটভূমিতে তার স্থাপত্যকলা আমাকে মুগ্ধ করলো। মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে চললাম খান জাহান আলীর মাজার প্রাঙ্গণে। মাজার দেখার চেয়ে আমার লোভের সম্মুখের দীঘিতে বিচরণরত কুমিরের প্রতি। অটো করে চলে এলাম মাজারে। বেশ মানুষের ভিড়। কিছুদিন পরেই নাকি মেলা বসবে। তখন জমজমাট হয়ে উঠবে পুরো এলাকা। চললাম কুমির দেখতে। দীঘির এক পাশে কুমির বিশ্রাম নিচ্ছে। তাদের দেখতে কৌতূহলী মানুষের ভিড়। আর খাদেম শ্রেণীর কয়েকজন কুমির দর্শন করাচ্ছেন টাকার বিনিময়ে। অনেকের ছুঁয়ে দেখার কৌতূহল। খুবই বিপজ্জনক কাজ। এতে নাকি পূণ্য হয়। এই কুমির নিয়ে অনেককাল ধরে জড়িয়ে আছে নানা মিথ। কে বলে বিশ্বাস নিরাকার! নানা আকার আর উপাচারের গণ্ডিতে আবদ্ধ বিশ্বাস মহাশয় আসলে মানুষের পছন্দ অপছন্দের উপরই বেঁচে থাকেন। উৎসাহ মিলিয়ে গেলো। আমার এভাবে স্পট কাভারিংয়ের হুটহাট ব্যাপার-স্যাপারে বিশ্বাস নেই। কিন্তু আজ এসে যখন পড়েছি জোয়ারে গা ভাসাতেই হবে।
সেখান থেকে আরেকটি অটোতে রামপালের ফয়লা বাজারে চললাম। একেবারে গ্রামের ভেতর দিয়ে সরু পাকা রাস্তা চলে গেছে। এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালো। চারপাশে প্রচুর ছোট-বড় পুকুর। সেখানে মাছচাষের প্রস্তুতি চলছে। গ্রীষ্মের উষ্ণ দুপুরে অলস গ্রাম ঝিম মেরে পড়ে আছে। চারপাশে মানুষ খুব কম। সুপারি বাগানের মিষ্টি ছায়ায় মাদুর পেতে একটু শুতে পারলে দারুণ হতো। এই বাংলা ছেড়ে কত দূরে কি নিদারুণ এক নিষ্ঠুরতায় বাস করি। ভাবতে মনোকষ্ট বাড়লো শুধু।
আমরা ফয়লা বাজারে এসে দুপুরের খাবার খেতে বসে গেলাম হোটেলে। প্রথম বারের মতো আবিষ্কার করলাম ঢাকায় অন্তত মাছ প্রাপ্তির বেলায় কি দুর্ভাগা আমরা। টাটকা স্বাদের সব মাছের পদ। সব নামও মনে নেই। কিন্তু স্বাদ মুখে লেগে আছে। তড়িঘড়ি খাবার সেরে উঠে বসলাম মোংলার বাসে। চারপাশে সব বড় বড় চিংড়ির ঘের এ অঞ্চলে। পানিবহুল অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও চারপাশ জুড়ে কেমন যেন মরুভূমির মতো। বড় গাছ নেই বলেই চলে। আবার লবণাক্ততার কারণেও হতে পারে। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আমরা চলে এলাম মোংলা। চারপাশে শিল্প কারখানার তোড়জোড় চলছে। বন্দর জেগে উঠছে নতুন করে। আমরা যাবো করমজল পর্যটন কেন্দ্রে। কিছুক্ষণ দরাদরি করে সম্ভবত দেড় হাজার টাকায় ট্রলার ঠিক করা হলো। এটি আমাদের নিয়ে যাবে আবার ফেরত আনবে। পশুর নদীর বাঁকে জীবনের ঢেউ লেগেছে। দূরে আবছা কালো রেখা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করলো। আমার ভেতরে উত্তেজনার পারদ চরছে। চলে এসেছি দুনিয়ার বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন আর সবচেয়ে রাজকীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আঙিনায়। এপথ দিয়ে ঢুকলে করমজল আসলে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার। প্রথম দেখায় আমাকে হতাশ করলো করমজল। সেই সকালে ষাটগম্বুজ মসজিদ আঙিনায় দেখা ভিড় এখানেও। রীতিমতো পিকপিক পার্টি এসছে ট্রলারে মাইক বাজিয়ে। একটি নয়, দলে দলে। এখানে বেষ্টনীতে আবদ্ধ চিত্রা হরিণ আর কুমির প্রজনন কেন্দ্রই মূল আকর্ষণ। নির্দিষ্ট কাঠের পাটাতনওয়ালা ট্রেইল ধরে কিছুদূর যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। প্রকৃতিপিপাসু মনের তৃষ্ণা এতে মিটবে না। কিন্তু ক্ষণিকের এ দেখাই বাদাবনের আকর্ষণ আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে ধরে রাখবে।
আরো গভীরে যাওয়ার ইচ্ছেটাকে উসকে দেবে। সুন্দরবনের একটা অদেখা সত্তা আছে। একে অনুভব করতে হয়। এক সময় তা মনের গভীরে ঢুকে যায়। আর যার সঙ্গে এমনটা ঘটে সে ঘোরগ্রস্তের মতো বাদাবনের কাছে বারবার ফিরে আসে। নিশ্চিত সেই ভূত আমার ভেতরে ভালোভাবেই বিরাজ করছে। সূর্য পাটে যাওয়ার বেশি দেরি নেই। সেই ব্রাহ্ম মুহূর্তের কথা কখনো ভুলবো না। লাল টকটকে আভা ধীরে ধীরে মিশছে পশুরের লোনা জলে। সন্ধ্যা নামছে সুন্দরবনে। তারপর আসবে রহস্যময় রাত। কতশত লক্ষ-কোটি গল্প মিশে আছে বাদাবনের সেই সব অন্ধকারে কে জানে।
শেষ ভালো যার সব ভালো তার তত্ত্বটি একেবারে ফলে গেলো আন্টির হাতের ভয়াবহ মজাদার রান্নার আয়োজনে। গলদা চিংড়ি, পারশেসহ অন্তত চার পাঁচ পদের মাছ এবং সব শেষে খুলনা অঞ্চলের একেবারে নিজস্ব চুইঝাল সহযোগে গরুর মাংস। এতো খেয়েছিলাম যে পেটুক শামীম ভাইও রীতিমতো লজ্জা পেলেন পরাজয়ে!
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৯
এএ