০১. ক্রীতদাসের যাত্রাপথ
এটাও সেরকমই এক প্রাক-প্রত্যুষকালের কথা যখন রাত-তাড়ানিয়া সূর্যের আলোরও আগের একটা আলোর আভা মশারির জালের মতো নেমে আসে আকাশ থেকে, যখন কপাটে এসে আলতো বাড়ি খায় বরেন্দির থাক থাক লালমাটির সোপান বেয়ে নেমে আসা শেষরাতের বাতাস আর তারই দোলনা-দোলায় ফাট্ ফাট্ শব্দ তুলে শিমুল ফলগুলো ফেটে ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বুড়ির সুতার মতো মিহি তুলোর দলাগুলো, যখন গাড়া-বাঘডাসের দল ঝোপের আড়ালে চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো দেখে নেয় মুরগির খোয়াড়ে ঢোকার কোনো সুযোগ আছে কি না, যখন পাতলা ঘুমের মধ্যে শিশুরা হাতের আন্দাজে বুঝে নেয় পাশে মায়ের উপস্থিতির নির্ভরতা এখনো নিশ্চিত রয়েছে কিনা এবং তারপরে পাশ ফিরে নিজেকে সমর্পণ করে আবার আরেক চুমুক গাঢ় ঘুমের মধ্যে, যখন বন-কৈতর আর আরো সব পাখালির দল ঘরের পাতাবিছানো চালার ওপর অহেতুক নেচে বেড়ানোর শব্দ তোলে খসর খসর, আর আরো কত রকমের শব্দ ওঠে যেগুলোর নাম রাত পোহানোর শব্দ। সেই রকম এক লগ্নে সেদিন এইসব চেনা শব্দের বদলে পুরো গ্রাম জেগে ওঠে নিদ্রার মধ্যে গা-কাঁপানো দুঃস্বপ্ন বুনে দেওয়ার মতো ভীতিকর ঢ্যাঁড়ার শব্দে।
দ্রিগ্ দ্রিগ্ দ্রিগ্ শব্দ উঠছে বিশাল আকারের ঢাক থেকে। সেই শব্দ বাড়ি খাচ্ছে দূরের বনের গায়ে, দূরের দিগন্তের গায়ে, ভোরের সাথে সাথে অনেকটা নিচে নেমে আসা আকাশের গায়ে। মূল ঢাকের শব্দের চাইতে তাই অনেক বেশি বুক-কাঁপানো শব্দ হচ্ছে প্রতিধ্বনির। শব্দ এবং শব্দের ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসা শব্দ মিলে কাঁপন উঠছে গুচ্ছগ্রামের ছোট ছোট ঝুপড়িগুলোতে।
সূর্যোদয়কে ঠিক পেছনে রেখে গাঁওদেবের পাথর আর গাঁওদেবীর জলের ঘটটিকে দুই পাশে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই রাজপুরুষ (রাজার শান্ত্রী)। যখন আসে, যখনই দাঁড়ায়, এভাবেই দাঁড়ায় রাজপুরুষরা। কৈবর্তদের সব গাঁয়েই ঢোকার মুখে দাঁড় করানো থাকে একটা লম্বা আর একটা চ্যাপ্টা পাথর। গাঁওদেবতা আর গাঁওদেবী। ওরা দিনরাত রক্ষা করে গাঁয়ের মানুষকে। আশীর্বাদ আর অভয় দান করে। কিন্তু যখনই কোনো রাজপুরুষ আসে রাজার আদেশ নিয়ে, তারা সবসময়ই সেই দুই দেব-দেবী পাথরের পাশে সূর্যকে পেছনে রেখে দাঁড়ায়। তখন ওদেরকে মনে হয় দেব-দেবীর চাইতেও উঁচু, আর তাদের ছায়ারা দেব-দেবীর ছায়ার চেয়েও দীর্ঘতর। ওখানে দাঁড়িয়ে একজন শব্দ তোলে ঢ্যাঁড়ায়। কৈবর্তগ্রামে যে যেখানে থাকুক, ছুটে আসতে হয় ঢ্যাঁড়ার শব্দ শোনামাত্র। পলমাত্র দেরি করা চলবে না। যদি প্রদোষে বেজে ওঠে রাজার ঢোল তাহলে ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর কাজটাও অসমাপ্ত ফেলে রেখে ছুটে আসতে হবে। যদি সকালের কাজের সময় বাজে ঢোল তাহলে ছুটে আসতে হবে পুরুষদের ক্ষেতের কর্ম ফেলে আর নারীদের চুলার ওপরে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ি ফেলে। যদি সূর্যাস্তের পরেও বাজে ঢোল, তাহলে এমনকি বাসররাত্রির সঙ্গমানন্দ ফেলেও ছুটে আসতে হবে কৈবর্ত নারী-পুরুষকে। না আসা অপরাধ। রাজার আদেশ নিজ কানে তুলে না নেওয়ার অপরাধ। সেই অপরাধে কেটে নেওয়া হয়েছে কত কৈবর্তের কান! কেটে ফেলা হয়েছে কত কৈবর্তের হাত-পা। যদি রাজার আদেশ নিজ কানে তুলে নিতে না-ই পারিস তাহলে কী হবে তোর কান দিয়ে! যদি রাজার ঢোলের শব্দ কানে প্রবেশমাত্র ছুটে আসতে না-ই পারিস তাহলে কী হবে তোর পা দিয়ে! যদি ঢোলের দ্রিগ্ দ্রিগ্ শোনামাত্র ছুটে এসে দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকাতে না-ই পারিস তাহলে কী দরকার তোর হাতের!
কৈবর্তদের এই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসার দৃশ্য রাজপুরুষদের বড়ই প্রিয়। তাদের চোখ এমন দৃশ্য দেখে চৈত্রমাসের মধ্যাহ্নে হঠাৎ আকাশে মোষরঙা মেঘ দেখার মতো উপশমানন্দ লাভ করে। পিলপিল করে ঝুপড়িঘর থেকে, উঠোন থেকে, পাতার বিছানা থেকে, ঝোপের আড়াল থেকে পড়িমড়ি করে ছুটে আসছে কৈবর্ত নারী-পুরুষ। চোখে-মুখে সাঁটা যেন আতঙ্কের মুখোশ। আর তাদের প্রথম সারি এসে দাঁড়াবে য়খন, তাদের হাঁটুতে হাঁটু এত জোরে বাড়ি খাবে যেমন মাদল বাজে যুদ্ধযাত্রায়। কৈবর্ত পুরুষদের পরনে শুধু নেংটি। কেউ কেউ নেংটি বাঁধবার অবকাশটুকুও না পেয়ে নিম্নাঙ্গে কেবল এক ফালি কাপড় পেঁচিয়ে ছুটে এসেছে। তাদের মাটি এবং রোদমাখা শরীরের রঙ পোড়াকাঠের মতো মলিন-কালো। রুক্ষ কর্কশ ত্বক বোধহয় ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে কোনোদিনও তৈলস্পর্শ পায়নি। রৌদ্র তাদের পোড়াকাঠ-ত্বকে দরদরিয়ে ঘাম ছোটায়, সেই ঘামকে শুকিয়েও দেয়। তখন সেই ঘামের লবণ লেপ্টে থাকে চামড়ায়। তাই তাদের চামড়াকে এতদূর থেকেও, এই প্রাক-প্রত্যুষেও ফাটা-ফাটা দেখায়। নারীরা সহজাতভাবেই কিছুটা শরীরের যত্ন নিতে শিখে ফেলে বলেই বোধকরি তাদের ত্বক কিছুটা মিহি দেখায়। উজ্জ্বলও কখনো কখনো। কারো কারো চুলে করঞ্জের তেলের ছোঁয়া থাকে। কিন্তু এই সময়টাতে তাদেরও আলু-থালু এবং চূড়ান্ত অবিন্যস্ত দেখা যায়। এই সময়টাতে রাজপুরুষরা নিজেদের, ঐ কিংকর্তব্যবিমূঢ় কৈবর্তদের তুলনায় অনেক উন্নততর মানুষ বলে ভাবার অবকাশ পায়। তাদের বিশ্বাস এই মর্মে আরো দৃঢ়তর হয় যে তারা নিজেরা দেবকুলোদ্ভব। বাকি তাদের সামনে দাঁড়ানো যারা, তারা সবাই উৎপন্ন অসুরযোনী থেকে। কাজেই কৈবর্তদের প্রতি সকল যথেচ্ছাচার, তাদের প্রতি জিঘাংসা, তাদের প্রতি অত্যাচার-- সবকিছুই রাজপুরুষদের পক্ষে সিদ্ধ। তবু যে তারা কৈবর্তদের প্রতি তেমন যথেচ্ছাচার করে না, এ তাদের দেবকুলোদ্ভূত জাতিগত শ্রেয়াচারের বৈশিষ্ট্য। এই শ্রেয়াচার আর সভ্যতা শেখানোর জন্যই তো তাদের পূর্বপুরুষ আর্যরা দেবতা ইন্দ্রের নেতৃত্বে এই অসুর-রাস-বয়াংসিদের দেশে এসেছে স্বর্গীয় আলোকশিখা নিয়ে। ইন্দ্রের নাম মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজপুরুষের মনে পড়ে যায় যে আগামী পূর্ণিমাতেই ইন্দ্রের পূজা উপলে রয়েছে মহান ইন্দ্রোৎসব। আহা কী আনন্দ! ইন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধায় তার মন পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আর এখন ইন্দ্রের প্রদত্ত দায়িত্বই তারা পালন করছে এমন অনুভূতিতে গর্বে ও প্রশান্তিতে ভরে ওঠে তার বুক। সে পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করে নিজের কর্তব্যের প্রতি। সে তো এখন এখানে কেবল রাজঅমাত্যের নির্দেশ বয়ে আনেনি! সে বয়ে এনেছে স্বয়ং ইন্দ্রের নির্দেশাবলি। তাই সে যখন কথা বলে তখন স্বয়ং ইন্দ্র যেন ভর করেন তার কণ্ঠে। প্রত্যুষের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে তার গমগমে কণ্ঠস্বরের অভিঘাতে।
এই কৈবর্তরা দেবভাষা বোঝে না। তাদের দেবভাষা শেখানোও যাবে না। শাস্ত্রের নির্দেশ। তাই শাসনকর্ম পরিচালনার জন্য রাজপুরুষদেরই বাধ্য হয়ে কৈবর্তদের কুৎসিত ভাষা, অন্তত কাজ চালানোর মতো করে, শিখতে হয়। ঢ্যাঁড়াবাদক তার বাদন শেষ করার পরে অপরজন উচ্চকণ্ঠে জানতে চায়-- শুন হে গাঁওবাসী! সকলে কি এসে পঁউছেছে এইঠাঁই?
থোকায় থোকায় দাঁড়িয়ে থাকা কৈবর্ত নারী-পুরুষ পরস্পরের দিকে তাকায় অনুসন্ধানী চোখে। সবাই সবাইকে চেনে। সেই চেনামুখ সকল উপস্থিত হতে পেরেছে কি না পরখ করে। তারপর জানায়, হ্যাঁ সকলে এসেছে বটি।
তাহলে শুন হে অসুরের বংশধররা! তোমাদের মাঝে এক জুয়ান মরদ ছিল। নাম তার বট্যপ। ছিল কি না?
হ্যাঁ ছিল।
সে এখন কামরূপে। সেথায় সে এখন দেবর্ষি রামশর্মার দাস। আত্মবিক্রয় করা দাস। মনে আছে?
হ্যাঁ মনে আছে বটি। সাত বছর আগে সে নিজেকে বিক্রি করে চলে গেছে সেথায়। সেই বট্যপ তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ সেই বট্যপই।
একটু গুঞ্জন ওঠে কৈবর্ত সম্মিলনে নিজেদের মধ্যে-- তার কথা এতদিন পরে কেন ওঠে আবার? কী করেছে সে? সে তো চলে গেছে সমুদ্রের মতো সদানীরা নদী পার হয়ে রামশর্মার খামারে নিজের ঋণের বোঝা নিজেই শোধ করার জন্য।
হ্যাঁ হ্যাঁ সেই বট্যপই। সাত বছর আগে সে নিজেকে বিক্রি করে চলে গিয়েছে কামরূপে। কর্মও করছে সেথায়। কিন্তু তার ঋণ তেমন একটা শোধ হচ্ছে না। ধরো প্রতিদিনের পরিশ্রমের জন্য তার নামে যে কয়টা কড়ি যোগ হয় পারিশ্রমিকের নামে, প্রায় সমপরিমাণ যোগ হয় তস্য সুদের খাতায়। পুরো ১০ দ্রম্ম আর ১৯ কার্ষাপণ তো মুখের কথা লয়। সে অনেক কড়ি বটি। একজীবনে গায়ে খেটে তা কী পরিশোধ করা সম্ভব!
সম্ভব লয়?
একেবারেই লয়।
সমবেত জনতার মধ্যে হঠাৎ হাউমাউ কেঁদে ওঠে শীর্ণা এক যুবতী। হাতে ধরা বছর সাতেকের এক ছেলের হাত-- তাহলে কী হবে গো! এ জীবনে মানুষটা কি ঘরে ফিরবে না? আমার এই ছেলেটা কি বাবার মুখ জীবনেও দেখবে না একবারটি?
তৎক্ষণাৎ পুরো ঘটনা মনে পড়ে যায় সবার।
সাত বছর আগে বট্যপের স্ত্রী তখন ভরা পোয়াতি। বিয়োনিব্যথা উঠেছে সেদিন সাঁঝের আগে। কিন্তু মায়ের পেট থেকে সন্তান নেমে আসছে না ধরতির বুকে। মায়ের জঠরে থাকার মেয়াদ তার শেষ হয়েছে বটে। কিন্তু সেই সন্তান নামে না বরিন্দের মাটিতে। সেই ব্যথা নিয়েই কেটে যায় সেই রাত, তার পরের দিন, পরের রাত, এমনকি তার পরের দিনও। কৈবর্তগ্রামের দিনগুলো আর রাতগুলো ভারি হয়ে থাকে বট্যপের স্ত্রী বিবানির যন্ত্রণাকাতর চিৎকারে চিৎকারে। গাঁওবুড়িদের জড়িবুটি, জংলা ঔষধির শিকড় বেঁটে খাওয়ানো, ওলান ঠাকুরের চরণধোয়া জল, কৈবর্ত-পুরুতের তন্ত্র-মন্ত্রকে পর্যন্ত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিবানির জঠরের শিশু বসে থাকে জঠরেই। নেমে আসে না বিবানির কোলে। বউয়ের কষ্ট সইতে না পেরে বট্যপ ছুটে যায় আধাদিনের পথ উজিয়ে সোজা দেবগ্রামে। সেখানে সবচেয়ে সুখ্যাতা অম্বষ্ঠ (প্রসবকারিণী ধাত্রী) বিল্ববালা। তার দরজায় গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে বট্যপ। বিল্ববালার দায় ঠেকেছে বট্যপের কথা শোনার! হোক না বিল্ববালার নিজের বৃত্তি নীচুস্তরের। দেবগ্রামের ব্রাক্ষ্মণ-ক্ষত্রিয়রা তো বটেই, বৈশ্য এবং জলচল শূদ্ররা পর্যন্ত তার ছোঁয়া এড়িয়ে চলে। তার ছায়া গায়ে পড়লে নিজেদের অশুচি ভাবে। আবার বিল্ববালা তাদের ছায়াকে পায়ে মাড়ালেও তাদের স্নান করতে হয়। সঙ্কটমোচনে তার ডাক পড়ে বটে দেবগ্রামের ঘরে ঘরে, কিন্তু সে বিদায় নেবার পরে শুদ্ধিযজ্ঞ না করে কেউ কোলে তোলে না নবজাতককে। দেবগ্রামের নীচু অস্পৃশ্যপ্রায় সেই বিল্ববালার চোখেও কিন্তু কৈবর্তরা কৈবর্তই; মানুষ নয়। তাই বট্যপের কাকুতি-মিনতি তাকে স্পর্শই করে না। কিন্তু বট্যপও তার দরজা ছেড়ে নড়ে না। বউকে তার বাঁচাতে হবেই। বিল্ববালাকে সঙ্গে না নিয়ে সে তার ঘরের পৈঠা থেকে নড়বে না। তখন তাকে এড়ানোর জন্যই বিল্ববালা শর্ত দেয়, সে যেতে রাজি আছে, তবে তার জন্য তাকে পারিশ্রমিক দিতে হবে নগদে ১০ দ্রম্ম। দেবগ্রামের সবচেয়ে ধনীর বাড়ির মেয়েদের প্রসব করিয়ে বিল্ববালা পায় আধা দ্রম্ম। অথচ বট্যপের কাছে দাবি করে তার কুড়ি গুণ। এত দ্রম্ম দাবি করার কারণ কৈবর্তনারীকে স্পর্শ না করার ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিল্ববালা ভেবেছিল ১০ দ্রম্ম পারিশ্রমিকের কথা শুনে পালিয়ে বাঁচবে বট্যপ। কিন্তু বট্যপের তখন অগ্র-পশ্চাৎ ভাবার অবকাশও নেই, সেই হুঁশ-জ্ঞানও নেই। তার দরকার বউকে বাঁচানো। আর যে নবজাতক আসছে সে তো শুধু তার একার সন্তান নয়, সেই নবজাতক তাদের গোত্রের সম্পদ। তাকে তার বাঁচাতেই হবে। ১০ দ্রম্মের কথাতেও সে পেছপা নয়। বরং এককথায়-ই সম্মত। কিন্তু তাতেই কী শেষ হয়! বিল্ববালার ঝুলি থেকে মুখ বের করতে থাকে আরো আরো দাবি। না, সে অস্পৃশ্য ছোটজাতের নারীদের মতো পায়ে হেঁটে যেতে পারবে না এত দূরের পথ। তাকে নিয়ে যেতে হবে ঢল্লরিকায় (বস্ত্র আচ্ছাদিত ডুলি) তুলে। এবং ফিরিয়েও নিয়ে আসতে হবে ঢল্লরিকায়। তার খরচ ১৯ কার্ষাপণ।
এত বিশাল অংকের পারিশ্রমিক প্রদানের সামর্থ তার বা তার মতো কোনো কৈবর্তের আছে কি নেই তা ভেবে দেখার অবকাশটুকু পর্যন্ত গ্রহণ করে না বট্যপ। বিল্ববালা যা-ই দাবি করে, সে একবাক্যে তাতেই সম্মতি জানায়।
ঢল্লরিকাতে দোল খেতে খেতে বিল্ববালা আসে কৈবর্তগ্রামে বট্যপের ঝুপড়িতে।
তার হাতে জাদু আছে। চরক, শুশ্রূতে আর স্বয়ং দুই আয়ুর্বেদ দেবতা অশ্মিনীকুমার যেন তার প্রশিক। এমন নির্বিঘ্নে সে বট্যপ এবং বিবানির সন্তানকে মাতৃজঠর থেকে বরেন্দির মাটিতে নামিয়ে আনে যেন সেই সন্তান শুধু অপেক্ষা করছিল বিল্ববালার হাতের স্পর্শ আর আহ্বান শোনার জন্যই। গোধন যেমন ব্যাগ্র-আগ্রহে মুখ বাড়িয়ে দেয় প্রভুপালকের হাতের জাবনার দিকে, তেমনই দ্রুত এবং মসৃণ গতিতে বিবানির সন্তান নেমে আসে জঠর ছেড়ে বিল্ববালার হাতের মৃদু-আকর্ষণে। সন্তান মাতৃজঠর থেকে নেমে এল মাতৃক্রোড়ে। বিবানির তে-রাত্তিরের যন্ত্রণা মুহূর্তে উধাও।
এবার বিল্ববালাকে প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক দিয়ে প্রণাম জানানোর পালা।
স্ত্রী এবং সন্তানকে সুস্থ ও জীবিত পেয়ে বট্যপ আনন্দে আত্মহারা। বিল্ববালা তার চোখে এখন সাক্ষাৎ দেবী। সে বারবার প্রণিপাত করে বিল্ববালার সামনে। কিন্তু বিল্ববালার তো ভক্তির দরকার নেই, তার দরকার নগদ কড়ির। সে চাঁছাছেলা কণ্ঠে বলে, তাকে এবার নিজ আলয়ে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।
অর্থাৎ তার পারিশ্রমিক দিয়ে দেওয়া হোক।
কিন্তু বট্যপের তো নেই-ই, পুরো কৈবর্তগ্রামের সবগুলো ঘর থেকে এক কড়ি-দুই কড়ি জমা করেও বিল্ববালার দাবিকৃত দক্ষিণা পূরণ করা সম্ভব হয় না। বিল্ববালা ক্রোধে অস্থির। সে চিৎকার করে বলতে থাকে যে এই মুহূর্তে প্রাপ্য দক্ষিণা না পেলে সে রাজপুরুষদের কাছে অভিযোগ করবে। আর রাজপুরুষরা একবার যদি কোনো কৈবর্তকে তুলে নিয়ে যায়, তার আর ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তার চাইতেও বড় কথা বট্যপ তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঐ পরিমাণ দক্ষিণা প্রদানের। এই মাটির সন্তানদের মুখের কথাই সব। মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে কোনোকালেই সরে আসে না কোনো কৈবর্ত। কথা সে রাখবেই।
কিন্তু এখন বট্যপ কী করে?
তখন তাকে যেতে হয় মাধ্যমদের কাছে।
গৌড়-কামরূপ-দেবকোট-কর্ণসুবর্ণের ভূমিপতিরা গড়ে তুলেছে বড় বড় ইক্ষুক্ষেত্র। এক-একটা ইক্ষুক্ষেতের বিস্তার অন্তত ত্রিশ থেকে পঞ্চাশটি গ্রামের সমান। সেখানে তাদের প্রয়োজন শত শত ভূমিদাস। কৈবর্তদের ভূমিদাস হিসাবে পেতে খুবই আগ্রহী এইসব ইক্ষুগ্রামের অধীশ্বররা। কৈবর্তরা মাটিকে চেনে নিজের নিঃশ্বাসের মতো। মাটি তাদের সাথে কথোপকথন করে অহর্নিশি। তারাও প্রতিমুহূর্তে মাটিকে মা ডেকে চলে। তাই মাটিও তাদের কাছে মায়ের রূপ ধরে উজাড় করে নিজের জঠর থেকে ফসল দেয়। ধান, আখ, তিল, রবিশস্য, সবজি ফলানোর কাজে কৈবর্তরা প্রকৃতির মতোই পটু। প্রকৃতি নিজে নিজে যেমন লক্ষ লক্ষ উদ্ভিদের জন্ম দেয়, কৈবর্তদের হাতেও ফসল বেড়ে ওঠে যেন নিজের মতো করেই। আর কাজ এড়িয়ে চলা বা কাজে ফাঁকি দেওয়া কাকে বলে তা এখনো শেখেনি কোনো ভূমিপুত্র।
কিন্তু দাস হতে চায় কে? ভূমিদাস হতে চায় কে? আর্যদের চোখে বুদ্ধি-জ্ঞানহীন কৈবর্তরা পর্যন্ত বোঝে যে আত্মবিক্রয় করার অর্থ আর কোনোদিন মুক্তি না পাওয়া। কিন্তু হাল ছাড়ে না ভূমিপতিরা। তারা কৈবর্ত গ্রামগুলিতে নিয়োগ করেছে একাধিক ব্যক্তিকে মাধ্যম হিসাবে। মাধ্যমদের কাজ হচ্ছে ফুসলে-ফাসলে, কিংবা ক্রান্তিকালে বিপত্তারণের ভূমিকা গ্রহণ করে ব্যাধ যেভাবে হরিণকে ফাঁদে আটকায় সেভাবে ফাঁদে ফেলে কৈবর্তদের আত্মবিক্রয় করানো। বট্যপ এখন সেইরকম পরিস্থিতিতে। কে বাঁচাবে তাকে? হয় এখন মাধ্যমদের কাছে হাত পেতে আত্মবিক্রয় করতে হবে, নইলে বিল্ববালার দক্ষিণা না দেওয়ায় তাকে ধর্মচ্যুত হতে হবে। প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেটা পালন না করাকে কোনোদিন ক্ষমা করে না কোনো ভূমিপুত্র। এমন কাজ করলে তার আর ঠাঁই হবে না কোনো কৈবর্তগোত্রে। প্রাপ্য দক্ষিণা না দেবার অপরাধে বিল্ববালা তাকে রাজপুরুষদের দিয়ে যতই অত্যাচার করাক না কেন, সেটা মেনে নিতে বট্যপের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু নিজেকে এবং নিজের গোত্রের মানুষকে কোনোমতেই ছোট করতে পারবে না বট্যপ। তাই সে চলে যায় গাঁয়ের উপান্তে ঘর বেঁধে বসে থাকা মাধ্যমের কাছে। কামরূপের ভূমিপতি রামশর্মার লোকের কাছ থেকে ঠিক ঠিক ১০ দ্রম্ম ১৯ কার্ষাপণ নিয়ে বিল্ববালার প্রাপ্য দক্ষিণা মিটিয়ে দেয় সে। বিনিময়ে রাজি হয় আত্মবিক্রয় করতে। ভাগ্যে যা থাকে ঘটবে। কিন্তু নিজেকে কিংবা নিজের জাতিকে কোনোমতেই খাটো করবে না বট্যপ। দেখা যায় রামশর্মার লোকের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তার আত্মবিক্রয়পত্রে নিজের হাতের ভূষাকালির ছাপ দেবার সময় একবিন্দুও কাঁপে না বট্যপের হাত।
তারপর মাত্র এক প্রহর আগে ভূমিষ্ঠ শিশুপুত্রের কপালে একটিমাত্র চুম্বনতিলক এঁকে দিয়ে বট্যপ চলে গেল কামরূপে রামশর্মার নীবিক্ষেত্রে ভূমিদাস হিসাবে কাজ করতে। পেছনে পড়ে রইল সদ্যপ্রসূতি বিবানি, যে এখনো পর্যন্ত সুস্থ ও জীবিত পুত্রসন্তানের মা হবার গর্বটুকু পর্যন্ত অনুভব করার সুযোগ করে উঠতে পারেনি। পড়ে রইল সদ্যোজাত পুত্র। পড়ে রইল কৈবর্ত জনপদ। বরেন্দির লালমাটি। শিশুর মুখে তুলে দেবার মতো এক ফোঁটা মধু পর্যন্ত নেই যে ঘরে, প্রসবকান্ত স্ত্রী-র মুখে জাউ তুলে দেবার মতো এক মুঠো খুদ পর্যন্ত নেই যে ঘরে, সেই দুঃখের আঁধারে নিমজ্জিত ঘরটিকে শূন্যতায় আরো অন্ধকার করে দিয়ে বট্যপ চলে গেল কামরূপে রামশর্মার নীবিক্ষেত্রে ভূমিদাসের কাজ করতে।
আর তার স্ত্রী-পুত্র কীভাবে কীভাবে যেন, যেভাবে কৈবর্তরা বেঁচে-বর্তে থাকতে শিখে যায় খেয়ে না খেয়ে, আধা মানুষ আধা জানোয়ারের জীবন টেনে-বয়ে, সেভাবেই বেঁচে রইল।
আজ আবার বট্যপকে স্মরণ করা কেন? না জানি কোন নির্দেশ আসে!
বজ্রপাতের মতো আঘাত ধেয়ে আসে আবার।
বট্যপের একার জীবনভর শ্রমে নাকি শোধ হবে না তার ঋণ। তাই রাজপুরুষরা আজ নিতে এসেছে তার সাত বছরের সন্তানকে।
না!
দয়া করো প্রভু! এই ছেলেকে ছেড়ে মা কীভাবে বাঁচবে! এই কচি ছেলেই বা মাকে ছেড়ে বাঁচবে কীভাবে? আর এতটুকুন এই ছেলে কাজটাই বা কী করতে পারবে? ও যে মরে যাবে প্রভু!
বললেই তো আর হয় না। দুই রাজপুরুষও তো নিতান্ত নির্দেশ পালনকারী বই নয়! কৈবর্ত নারী-পুরুষের আবেদন-নিবেদনে তাদের মন যদি গলেও যায়, তবু তারা পারবে না বট্যপের ছেলেকে না নিয়ে গ্রাম ত্যাগ করতে। অশিতি কৈবর্তের দল তো জানে না যে কত হাত ঘুরে রাজপুরুষদের কাছে এসে পৌঁছেছে এই নির্দেশ। কামরূপের ভূমিপতি দেবর্ষি রামশর্মা এই ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন জানিয়েছেন কামরূপের রাজার কাছে। রাজা তার আবেদনের যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারপরে দূত পাঠিয়েছেন মহারাজাধিরাজ মহীপালের কাছে। মহারাজ মহীপাল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কারণে, দুই রাজ্যের মধ্যে সম্পাদিত মৈত্রীচুক্তির কারণে সম্মতি জানিয়েছেন কামরূপের মহারাজার অনুরোধে। তিনি নির্দেশ পাঠিয়েছেন বরেন্দ্রীতে অমাত্যের কাছে। অমাত্যের নির্দেশ এসেছে দণ্ডিকের (স্বরাষ্ট্র বিভাগ) কাছে। দণ্ডিক থেকে প্রেরিত এই দুই রাজপুরুষ। তারা তো চাইলেও সেই আদেশের কোনো অন্যথা করতে পারে না। আর তারা অন্যথা করতে চাইবেই বা কেন? এই কৈবর্তরা তাদের চোখেও তো অর্ধেক পশু বৈ কিছু নয়। অর্ধপশুদের আবার পুত্রশোকই বা কী মাতৃশোকই বা কী আর সন্তানশোকই বা কী!
কাজেই ছেলেকে আগলে রাখা মায়ের বাহুডোর শিথিল হতেই হয় একসময়।
সাত বছরের বাচ্চা ছেলে, মা আদর করে যার নাম রেখেছে পপীপ, এত কিছু বুঝতে পারে না। মাকে মাঝেমাঝেই বুক থাপড়ে কাঁদতে দেখেছে সে। বিশেষ করে তার বাবা নামের একটা অচেনা লোকের নাম মুখে নিয়ে মা বেশ ঘন ঘন কাঁদে। তার খিদের সময় খাবার দিতে না পারলেও কাঁদে। তাদের ধানের তে বুনো শুয়োর এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলেও এভাবেই কাঁদে। কিন্তু আগের দিনগুলোর কান্নার চেয়ে আজকের এই কান্না যে অনেক বেশি আর্তনাদময়, অনেক বেশি ভেতর থেকে উঠে আসা, তা অবশ্য বুঝতে পারে না পপীপ। রাজপুরুষদের একজন যখন তার হাতকে মায়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিজের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে, তখনো সে বিমূঢ়ের মতো একবার রাজপুরুষটির দিকে, একবার ক্রন্দনরতা মায়ের দিকে তাকায় বটে, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তার ঠিক কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারে না। মা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বারবার স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা নিজগ্রামবাসীদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা করার আকুল আবেদন জানিয়েও তাদের স্থানুবৎ-ই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আেেপ বারংবার মাটিতে নিজের হাত আছড়ায়, বসন সরে যাওয়া নিজের পলিরঙা বুকে বার বার চাপড় দেয়, তখনো এমনকি গাঁয়ের কোনো মেয়েমানুষও সান্ত্বনা দিতে কাছে আসছে না দেখে পপীপ নিজেই তার মাকে শান্ত করার জন্য এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাজপুরুষের গেরো দেওয়া দড়ির মতো শক্ত মুষ্টি তাকে ছাড়ে না। বরং তীব্র বিরক্তির সাথে রাজপুরুষ তাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায় গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পথের দিকে। মুখে বলেÑ চল্। পপীপ তারপরেও ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে থাকা মায়ের মুখের দিকে তাকাতে চায়। তার মায়ের এত কান্নার কারণ সে বুঝতে পারে না। কিন্তু এটুকু বোঝে যে মায়ের বড় কষ্ট হচ্ছে। তাদের উঠোনে একবার বেজিতে ধরা একটা কমবয়সী মুরগির দেহের আছড়াআছড়ি আর ডানার এলোপাতাড়ি ঝাপটানি দেখেছিল পপীপ। আজ মনে হচ্ছে মা সেই মুরগির মতো মাটিতে ঝাপটে পড়ে আছড়াআছড়ি করছে। মুরগি বাঁচাতে তেড়ে গিয়েছিল মা। পাশের উঠোন থেকে ছুটে এসেছিল আরেক কাকিমা, আরেক জেঠিমাও। কিন্তু আজ গোটা গাঁয়ের সবগুলো নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কেউ তার মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য হাত বাড়াচ্ছে না, দাঁড়াচ্ছে না মায়ের পাশে গিয়ে, এই রকম ব্যাপার তো তাদের কৈবর্ত গাঁয়ে কোনোদিন দেখেনি পপীপ। তাই সে বরেন্দির সরলতা নিয়েই আবার মায়ের দিকে এগুতে চায়। মা উঠোন থেকে ডাকলেই যেমন সে বনের কিনারে খেলতে খেলতেও সাড়া দিয়ে ছুটে আসে, সেই রকমই সহজাত সাড়া দিতে যায় মায়ের কান্নায়। কিন্তু রাজপুরুষের মুঠি তার লিকলিকে বাহুকে এত জোরে চেপে ধরে রেখেছে যে মায়ের দিকে তার বিন্দুমাত্রও এগুনো সম্ভব হয় না। রাজপুরুষ তাকে মায়ের দিক থেকে ফের ফিরিয়ে নেয় গ্রামত্যাগী পথরেখার দিকে। তারপরেই তাকে হিড়হিড় করে এত দ্রুত টেনে নিয়ে হাঁটতে থাকে যে পপীপ নামের সাত বছরের কালোকেষ্ট, হাড় জিরজিরে, নিম্নাঙ্গে নেংটি পরা, উর্ধ্বাঙ্গ খালি বালকটিকে, যে কিনা সকালেরও আগে আচমকা ঢ্যাঁড়ার শব্দে ঘুম ভাঙার পর থেকে এতণ পর্যন্ত রয়েছে খালিপেটে, দাঁতে সুতাটি পর্যন্ত কাটার সুযোগ পায়নি, এদিকে কিনা মা তার জন্যে ঘরে মাটির হাড়িতে পান্তাভাত রেখে দিয়েছে, সেই পান্তাভাত কিংবা মায়ের কথাও বিন্দুমাত্র ভাবার সুযোগ না পেয়ে রাজপুরুষের হাতের টানে নিজের পা মেলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। রাজপরুষদের হাতের টানে আর তাদের দুলকি চালের চলনের সাথে তাল মেলাতে তাকেও এত জোরে হাঁটতে হয় যে মাত্র যখন সে তীব্র হাঁপিয়ে উঠে হাপড়টানা বুক নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে রাজপুরুষদেরও থামতে বাধ্য করে ফেলে, তখন বুকে বাতাসের জন্য খাবি খেতে খেতেও সে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে যে চেনা জগতটিকে সে এরই মধ্যে ফেলে এসেছে অনেকখানি পেছনে। তার এখনকার সঙ্গীরা, তার পায়ের তলার প্রতি পদেেপ পিছু হটে যাওয়া মাটি, তার চারপাশের বুনো অড়হর-বাবলাকাঁটা-জারুল-শিমুল গাছ, ধারালো নালিঘাসের ঝোপের মধ্য থেকে মাথা তুলে উঁকি দেওয়া খয়ের গাছ, এমনকি তার মাথার ওপরের তেতে ওঠা আকাশÑ সবকিছুই তার অচেনা মনে হয়। আর এই বয়সের বালকের কাছে অচেনা সবকিছুই ভীতিকর এবং নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক। তাই ভয় পেয়ে পপীপ একবার হয়তো কেঁদে ওঠারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু রাজপুরুষদের রু কর্কশ ধমক, কড়াপরা হাতের তালু দিয়ে ঘাড়ের চামড়া ঘষ্টে দেয়ার কষ্টদায়ক স্পর্শ অবিলম্বেই তাকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছিল যে তাদের কাছে তার কান্নার কোনো মূল্য নেই। ফলে এই অনুভূতি তার কান্না থামিয়ে দিয়েছিল প্রায় তাৎণিকভাবে। এবং ফলে সেই কান্না অনেকদিন তার বুকে অচেনা এক পাথর হয়ে চেপে বসে থেকে গিয়েছিল। অনেকদিন।
০২. অচেনা মাটির গন্ধ
দেবগ্রামে পৌঁছুতে পৌঁছুতে দেখা গেল সূর্য প্রায় পাটে বসেছে। দুই রাজপুরুষ ভীষণ বিরক্ত। এত দেরি হওয়ার কথা নয় তাদের। তাদের রাগ পপীপের ওপর। তার জন্যেই জোরে হাঁটতে পারেনি তারা। পথে দুজনে পপীপকে তাড়া দিয়ে গেছে অবিরাম। কিন্তু তাদের শত টানা-হ্যাঁচড়া, ধমক-ধামক, তাদের মুগুরভাঁজা কড়াপরা হাতের চড়-চাপাটি খেয়েও সাত বছরের পপীপ তার হাঁটার গতি এর চেয়ে দ্রুত করতে পারেনি। একসময় ওরাও বাধ্য হয়েই বুঝে গিয়েছিল যে এরচেয়ে বেশি গতি পাওয়া তাদের পে আর সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, তাদের মাঝে মাঝে বিরতিও দিতে হবে ছেলেটিকে জিরিয়ে নেবার সুযোগ দেবার জন্যে। মুশকিল হচ্ছে একে ফেলে রেখে চলে যাওয়াও যেমন সম্ভব নয়, তেমনই সম্ভব নয় মেরে ফেলাও। আবার একই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে বালক যেন কোনোরকম পঙ্গুত্বেও আক্রান্ত না হয়। কেননা পঙ্গুকে দিয়ে তো আর প্রভুর কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া পপীপ এখন পালসম্রাট মহীপালের সন্ধিবান্ধব কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার পুরোহিত দেবর্ষি রামশর্মার সম্পত্তি। তারা দুজন বাহকমাত্র। তাদের দায়িত্ব এই বালককে জীবিত, সুস্থ ও কর্মম অবস্থায় নির্দিষ্ট একটা গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। কাজেই পপীপের ধীরগতির হাঁটার কারণে তাদের বিরক্তি বারংবার ক্রোধের পর্যায়ে উপনীত হলেও মুখের অশ্রাব্য গালাগালি ছাড়া আর কোনো উপায়ে সেই ক্রোধ প্রকাশ করার সুযোগ তাদের ছিল না। বালকের পিঠে বেত্রাঘাত কিংবা মুখে মুষ্ট্যাঘাত করার তীব্র ইচ্ছা তাদের নিজেদেরই দমন করতে হয়েছে। তারাও বাধ্য হয়েছে ঘন ঘন পথবিরতি নিতে। খইনি খেয়ে শীতল করেছে ক্রোধান্বিত মস্তিষ্ক, পথে রাজার দিঘী থেকে জল খাইয়েছে বালককে। নিজেদের থলি থেকে গুড়-মুড়ির অংশও দিয়েছে তাকে। তারা অবশ্য শেষ পর্যন্ত অবাকই হয়েছে বালকের সহ্যশক্তি দেখে। ছোট্ট পেটে তার আর কতটুকুই বা খাদ্যবস্তু আঁটে। তার ওপরে একটানা পথশ্রম। তার শুকনো মুখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় পেটের ক্ষুধার তীব্রতা। কিন্তু সে মুখ ফুটে কখনো খাবার চায় না। এমনকি তৃষ্ণার জল পর্যন্ত নিজে থেকে চেয়ে খায় না। তার ছোট্ট হৃদয়ও ইতোমধ্যেই বুঝে নিয়েছে যে যারা তাকে টেনে নিয়ে চলেছে, তাদের অন্তরে তার জন্য ভালোবাসা তো দূরের কথা, দয়া-মায়া-করুণারও চিহ্নমাত্র নেই। তার জন্ম থেকে চেনা মানুষদের সাথে এই মানুষগুলোর কোনো মিল নেই। আর একথা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে শামুকের মতো। হাজার হাজার ঝিনুক-গুগলি-জলকেন্নোর মধ্যে একলা একটা শামুক সে। সে নিজে যে এইসব মানুষদের থেকে আলাদা তা তাকে ভেতর থেকে জানিয়ে দিয়েছে তার কৈবর্ত রক্ত। মুখ ফুটে নিজের কোনো কষ্টের কথা বলছে তো না-ই, আচরণেও কোনো করুণাপ্রত্যাশার চিহ্নমাত্র দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে। কৈবর্তগ্রাম ছাড়ার পরপরই কিছুণ কান্নাকাটি করেছিল সে। প্রথমে কান্না ছিল চিৎকারে ভরা। রাজপুরুষদের ধমক এবং চড়-চাপাটি খাওয়ার পরে সেটি পরিণত হয়েছে নিঃশব্দ কান্নায়। কিছুণ পরে পুরোপুরি শুকিয়ে গেছে তার কান্না। বরং একধরনের নির্বিকারত্ব এসে গেছে তার অবয়বে এবং আচরণে। এই বয়সের পে এমনটি হওয়া প্রায় নিতান্তই অসম্ভব। সেই নির্বিকারত্বের সামনে দুই রাজপুরুষও মাঝে মাঝে অস্বস্তি বোধ করেছে। জিড়িয়ে নেবার সময় ওরাই আগবাড়িয়ে কথা বলতে গেছে বালকের সঙ্গে।
তোর নাম কী রে?
পপীপ।
তোর ভাগ্য বড় ভালো রে বুঝলি! যেথায় যাচ্ছিস সেথায় তিন বেলা খেতে পাওয়া যায়। ওরা তোকেও তিন বেলাতেই খেতে দিবে। তোরা কি কোনোদিন তিন বেলাতে খেতে পাস?
বালক কোনো উত্তর করে না।
॥কথা বলিস না কেনে?
অপর রাজপুরুষ যোগ দেয়- তোমার যেমন কথা! ওরা তিন বেলা খেতে পাবে কুত্থেকে? ওরা কৈবর্ত লয়?
তিন বেলা খেতে পাবে এমন ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আর যে-ই হোক কৈবর্ত জন্মাতে পারে না।
তাহলেই বুঝে দ্যাখ। কত ভাগ্য তোর । সেথায় তিন-তিন বেলা খাওয়া। আর শুনেছি কামরূপ দেশটা ভারি সুন্দর! সেখানে সক্কলেই জাদু-টোনা জানে। জাদু দিয়ে ভাত-মাছ, মণ্ডা-মেঠাই বানায়। যত খুশি খাও।
আর তাছাড়া তোর ভয় কিসের। তোর বাপই তো সেথায় রয়েছে, লয়?
দেবগ্রামে পৌঁছুতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে দুই রাজপুরুষ। ছেলেটিকে ভালোয় ভালোয় এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরেছে তারা। দণ্ডিকের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের ছুটি।
দণ্ডিক কার্যালয়ের করণীক নাম-ধাম লিখে নেয় পপীপের।
সেই প্রথম কাউকে লিখতে দেখল পপীপ। খাগের ছোট ডালের মতো একটা দণ্ডের মাথা কালো আরকের মধ্যে চুবিয়ে চুবিয়ে সাদাটে একটা কাপড়ের মতো জিনিসের ওপর দাগ দিয়ে চলল অবিরাম। ছবি আঁকতে দেখেছে পপীপ। তাদের গাঁয়ের ওঝাই তো কত জীবজন্তুর ছবি আঁকে। ভূত তাড়াতে এসে উঠোনের মাটিতে গাছের ডাল দিয়ে কত ভয় পাওয়া চেহারার ভূতের ছবিও আঁকে। কিন্তু এই লোকের আঁকার সাথে সেগুলোর কোনো মিল নেই। মনে হচ্ছে ইচ্ছেমতো হিজিবিজি আঁকছে লোকটা, কিন্তু সেই আঁকার একটা সুন্দর ছাঁদ ফুটে উঠছে ঠিকই। দুই রাজপুরুষের বজ্রমুঠির হ্যাঁচকা টানে জন্মগ্রাম ছাড়ার সময়ের প্রথম কান্না ছাড়া এতণ পপীপের স্বরযন্ত্রে নিজ থেকে কোনোই ধ্বনি ফোটেনি। কিন্তু এবার এই অদ্ভুত কাজটি দেখে সে আর নিজেকে সম্বরণ করতে পারে না- কী আঁকা করছ তুমি?
পপীপের প্রশ্ন আর আঁকার কথা শুনে হেসে ফেলে করণীক। তারপর বোধহয় তার মনে পড়ে এ তো অর্ধপশু এক কৈবর্তবালক। সে কীভাবে জানবে লেখাপড়ার কথা। তবে খুব রূঢ় হয় না তার উত্তর। বলেÑ লেখা আঁকছি।
লেখা আঁকা!
অর আঁকছি। মানুষের মুখের কথা অর দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা যায় বুঝলি! তাহলে আর কথারা হারিয়ে যেতে পারে না।
তারপরেই মুখঝামটা আসে- এসব তুই বুঝবি না। বুঝে কাজও নেই। তোর মতো কৈবর্তসন্তানের কাজ তো মাটির সাথে হামাগুড়ি দিয়ে কেঁচোর মতো খালি চাষবাস করা।
কাগজ-লেখনি গুছিয়ে নিয়ে উঠে গেল করণীক।
আর পপীপকে সেখানেই রেখে দেওয়া হলো তিন দিন।
তিন বেলা খাবার পায় পপীপ। তাকে শুতে দেওয়া হয় মেঝেতে খড় বিছিয়ে কার্যালয়ের এক কোণে। কিন্তু কারো সাথে কোনো কথা বলতে পারে না পপীপ। এখানে যারা আসে-যায়, তাদের ভাষা ভিন্ন। সে ভাষার বিন্দুবিসর্গ বোঝে না পপীপ।
তিনদিন পরে তাকে তুলে দেওয়া হলো গো-শকটে। এবার তার সঙ্গী রাজপুরুষ ছাড়াও আরো তিনজন কৈবর্ত। অন্য কোনো গ্রামের কৈবর্ত। তাদের আগে কোনোদিন দেখেনি পপীপ। ঐ তিনজন লোকও বোধহয় পরস্পরের কাছে অচেনা। তবু তো তারা কৈবর্তই। পুরো তিনটি দিন অন্য ভাষার কারাগারে বিদেশবাসের পর এই প্রথম যেন সে নিজেদের ভিটে-গাঁয়ের এক ঝলক সুবাস পায়। লোক তিনজন নিজেরাও খুব বিমর্ষ, ম্রিয়মান। ওরাও নিজেদের বিক্রি করেছে কামরূপের ভূস্বামীদের কাছে। নিজের দেশ-গ্রাম পরিজন-আত্মীয় ছেড়ে হয়তো চিরদিনের জন্য চলে যেতে হচ্ছে অন্য ভূখণ্ডে। নিজেদের কষ্টে বিভোর থেকেও ছোট্ট পপীপকে দেখে তাদের দৃষ্টিতে মায়া ফুটে উঠতে বিলম্ব হয় না।
তুই কেনে বাপ? তুই কেনে বিক্রি হলি?
পপীপ উত্তর দিতে পারে না। সে আসলে এখনো বুঝে উঠতে পারেনি কেন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর কোথায়-ই বা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত তিনদিন দণ্ডিক কার্যালয়ে বন্দি থেকে দিনমান ভয়তরাসে চোখ নিয়ে অচেনা জাতির মানুষের আনাগোণা দেখেছে। আর রাতে ঘুমের ঘোরে বারবার অভ্যাসমতো মায়ের বুকের ওম খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে জেগে উঠে কেঁদেছে অসহায়ভাবে। কখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে, কখনো হাউমাউ করে। চিৎকার করেছে মা মা বলে। কিন্তু মা আসেনি। বরং অচেনা অন্ধকার আরো বেশি করে চেপে বসেছে ওর চারপাশে এবং বুকের মধ্যে। কান্নার কান্তিতে একসময় নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে আবার।
তিন বয়স্ক কৈবর্ত নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কেউ বেশি দূর যেতে পারে না চিন্তায়। বোধহয় বেশিদূর ভাবার মতো চিন্তাশক্তিও নেই। একটু পর পর কেঁদে ফেলে অনুচ্চ শব্দে। কিন্তু কাঁদার সময়েও তারা সচেতন। নিজেদের মধ্যে কাঁদবে ঠিক আছে। কিন্তু কোনো রাজপুরুষ তাদের কান্না দেখতে পাওয়ার আগেই চোখ মুছে ফেলে। কেউ যেন কৈবর্তদের দুর্বল আর করুণাভিখারি না ভাবতে পারে সে ব্যাপারে শতভাগ সচেতন তারা। তবে সবসময়ই ওরা কেউ না কেউ নিজের গায়ের সাথে লেপ্টে রাখে পপীপকে। সংস্পর্শের সংবেদনা বোঝাতে চায়। কাছের মানুষটির গাল গড়িয়ে নেমে আসা চোখের জল দু-এক ফোঁটা পড়ে পপীপের মাথাতেও।
গো-শকট এগিয়ে চলে দিনভর। মাঝদুপুরে কিছুণের জন্য দাঁড়িয়েছিল একটা বিথীর (বাজারের) সামনে। খুবই ছোট্ট বিথী। অল্প কয়েকজন দোকানি। এক দোকানে শুটকি আর সোরা মাছ। কয়েক দোকানে শস্য। যব, দেধান, শামা ধান, কঙ্গু, মুগ, মসুর।
এখানেও দণ্ডিকের একটা কার্যালয় রয়েছে। সেখান থেকে বদলে নেয়া হলো শকটের বলদ। খেয়ে নিল শকটচালক এবং প্রহরারত রাজপুরুষরা। পপীপদেরও খেতে দেওয়া হলো। যবের মণ্ড আর ভাদুস (পোড়ানো ভুট্টা)।
রাজপুরুষ ও চালকরা খইনি খেতে খেতে বিশ্রাম সেরে নেয়। তারপর আবারও চলার শুরু।
এখনো ওরা বরেন্দিতেই রয়েছে। মাটির বর্ণ দেখে বোঝা যায়। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মতো কালচে হয়ে ওঠা লাল মাটি। ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মতো থাকে-থাকে উঁচু হতে হতে দূরে চলে গিয়ে ফের থাকে-থাকে নিচু হতে থাকা মাটি। এখানে-ওখানে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা ঝোপ-জঙ্গল। সূর্যের রোষ থেকে মাটিকে রার জন্য ওলান ঠাকুর জন্ম দিলেন গাছ-পাতার। সেই গাছ-পাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি কৈবর্তদের ঝুপড়ি। সারাদিন কড়া রোদের রোষে পুড়লেও ঝুপড়ির মধ্যে আধা-অন্ধকার শীতল ছায়া। পথের পাশে সমতল ভূমি থাকলেই সেখানে চাষবাসের চিহ্ন। কৈবর্তদের ধানতে, আখতে। বলদের টানে তাদের নিচ দিয়ে পেছনদিকে সরে যেতে থাকে বরেন্দির মাটি। আর তারা সতৃষ্ণ নয়নে দ্রুত পেছনের দিকে অতীতের মতো অপসৃয়মান বরেন্দিকে দেখে। বরেন্দিকে দেখে তার রূপ-রস-রুতাসহ।
শবর কিংবা পুলিন্দদের মতো যাযাবর নয় কৈবর্তরা। নিজেদের গ্রাম, হাট-বাট-গোবাট, বনঝোপ-খাল-নদী নিয়ে তাদের জীবন। তাদের জীবনের চৌহদ্দি বড় বেশি সীমায়িত। তাদের তো বড় চৌহদ্দির কোনো প্রয়োজনও নেই। ওলান ঠাকুর তাদের জন্য দিয়েছে এই বরেন্দি। দিয়েছে শস্যবিয়ানো চাষের জমি, খাল-নদীর মাছ, দিয়েছে গাঁওদেবী আর গ্রামঠাকুরের থান, দিয়েছে পার্বনের নাচগান, তাদের গীতের সুর আকাশের কাছে বয়ে নেবার মতো বাতাস, মাটি আর বৃষ্টির আলিঙ্গনের মতো নারী-পুরুষের মিলনের সঙ্গমানন্দ, ময়ূর-গোসাপ-বনমোরগের সাথে হুটাপুটি খেলার আনন্দ। দিয়েছে কার্পাসের বস্ত্র। দিয়েছে পাখিদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গীত গাওয়ার উচ্ছ্বাস। তাদের তাই বরেন্দির বাইরে পা রাখার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। বরেন্দির বাইরের পৃথিবীতে পা ফেলার কথা তাদের মনেই আসে না। কেন পড়বে? তাদের তো সব আছে। বরেন্দি তাদের সব দিয়েছে। যাদের নিজেদের মাটি তাদের সবটা প্রয়োজন মেটাতে পারে না, তারাই তো অন্য ভূমির সন্ধানে আকাশ-মাটি-নদী-সাগর চষে ফেলে। সেই রকম মানুষদের জন্য তাচ্ছিল্যের পাশাপাশি করুণাতেও ভিজে থাকে কৈবর্তদের মন। সেই কারণেই ভিন্ন জাতির কেউ এসে হাত পাতলে তাকে কোনোদিনই খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি বরেন্দির ভূমিপুত্ররা। তাছাড়া ভগবান যখন সব প্রাণীকেই থাকার জায়গা দিয়েছেন, খুঁটে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সেখানে কোনো মানুষ থাকার জায়গা পাবে না, নিজের অন্নের সংস্থান করতে পারবে না, এমন ভাবনা কৈবর্তদের বড় বিচলিত করে ফেলে। তারা তাই কাউকে কোনোদিন জোর করে তাড়িয়ে দেয়নি নিজেদের ভূমিখণ্ড থেকে। চাষের ত্রে দিয়েছে, পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে তার জন্য ঘর তুলে দিয়েছে গ্রামের প্রান্তসীমায়। ভিনদেশ থেকে আসা মানুষের কাছে শুনেছে অচেনা পৃথিবীর কথা। কিন্তু তাদের কোনো ইচ্ছা হয়নি কোনোদিন বরেন্দি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে। এই তিন কৈবর্তেরও একই রকম জীবনধারা। নিজেদের জীবন আর নিজেদের গাঁও-বরেন্দির চৌহদ্দি নিয়েই তাদের জীবনের বিচরণ। তাই এখন এই অজানা যাত্রায় তারা অস্বস্তি বোধ করতেই থাকে। নিজের জীবনের চৌহদ্দির বাইরে পা দিতে বাধ্য হয়ে এখন চলার পথে যা-ই চোখে পড়ে, তাদের কাছে নতুন মনে হয়, অচেনা মনে হয়, ভীতিকরও মনে হয় একটু একটু। আবার চলতে চলতে ওদের মনের কোণে বোধহয় পর্যটকের কৌতূহলও জন্ম নেয় কিছুটা। তাই তারা তাদের চারপাশকে দেখতে থাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। মনে মনে তুলনা করতে থাকে নিজেদের গ্রাম-জনপদের সাথে এইসব জনপদের মিল আর অমিলগুলি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ে ওঠে আগামী জীবনের অনিশ্চয়তা এবং অচেনা কষ্টকর জীবনের ভীতি। সেই ভীতিই একসময় মনের মধ্যে নিয়তির মতো চেপে বসে ভোঁতা করে দেয় তাদের অন্য অনুভূতিগুলো। তখন তাদের থাকে শুধু কৌতূহলবিহীন পথচলা। তারা রাজপুরুষ ও শকটচালকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার হাতে নিজেদের পরিপূর্ণভাবে সঁপে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে অন্তহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
সূর্যাস্তের লগ্নে রাজপুরুষদের মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা দেয়। পরবর্তী দণ্ডিকের কার্যালয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বোধকরি অন্ধকার হয়ে যাবে। বরেন্দি অঞ্চলে সূর্যাস্তের পরে সুরতি আশ্রয়স্থলের বাইরে থাকতে তাদের বড় ভয়। কেননা বন-জঙ্গলে ছাওয়া পথে রাত্রিকালে রাসদের বড় উৎপাত। রাসরা কিন্তু ভিন্ন ধরনের কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণী নয়। মানুষই। কিন্তু বিদ্রোহী মানুষ। আদি ভূমিপুত্র। সভ্য আর্যরা এদেশে এসেছে সেই কত হাজার বছর আগে। অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত করেছে তাদের। তাদের ভূমি কেড়ে নিয়েছে। তাদের নাম দিয়েছে অসুর বয়াংসি রাস অনাস। কিন্তু ভূমিসন্তানদের কয়েকটি গোষ্ঠী কোনোদিনই পরাজয় মেনে নেয়নি। তারা আর্যসভ্যতার আহ্বান ও প্রলোভনকে উপো করে শতাব্দীর পর শতাব্দী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে দেবকুলের মানুষ ও তাদের অনুগতজনদের ওপর। এই অঞ্চলের ভিল, শবর, পুলিন্দারা বরাবরই এই যুদ্ধে লিপ্ত। বেশ কিছুদিন থেকে শোনা যাচ্ছে বরেন্দির বিভিন্ন গ্রামের কৈবর্তরাও হাত মিলিয়েছে তাদের সাথে। অনেক আত্মবিক্রিত কৈবর্ত দাস পালিয়ে এসেছে ভূস্বামীর কৃষিত্রে থেকে। আশ্রয় নিয়েছে বনে-জঙ্গলে-গুপ্তস্থানে। তারা সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে মহাবলী পালসম্রাটের রাজপুরুষদের ওপর। জঙ্গলাকীর্ণ পথের মধ্যে আক্রমণ তো হচ্ছেই, মাঝে মাঝে আক্রান্ত হচ্ছে এমনকি দণ্ডিক কার্যালয় এবং বিথীসমূহও। রাজপুরুষদের অন্তরের শংকা পরস্পরের প্রতি বিরক্তির দ্বারা প্রকাশিত হতে থাকে। তারা পরস্পরকে দোষারোপ করতে থাকে পথের মধ্যে বেশিণ বিশ্রাম নেবার জন্য, খইনির নেশায় পথচলাতে বার বার বিরাম দেবার জন্য। শেষে তাদের সম্মিলিত ক্রোধ বর্ষিত হয় শকটচালকদের ওপর- সব শ্যালক অসুরদের বংশধর। ওরা বলদ তো খেদাচ্ছে না, এমন গতিতে শকট চালিয়েছে যেন বায়ুসেবনে বেরিয়েছেন মহাঅমাত্য!
আতঙ্ক নিয়েই পথ চলতে হয় তাদের। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কোনো বিপত্তি ছাড়াই পরবর্তী দণ্ডিকের কার্যালয়ে পৌঁছুতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তারা। আজ রাতের মতো নিশ্চিন্ত বিশ্রাম।
পরের সারাদিনও পথচলা একই নিয়মে। এইভাবে একনাগাড়ে শকটে বসে থাকতে অভ্যস্ত নয় কৈবর্তরা। তারা তো চিরকাল পথচলা বলতে বোঝে হাঁটা। শুধু বিবাহ-উৎসবকালে বর-কনের জন্য তৈরি করা হয় বাঁশের ঢল্লরিকা। জীবনে ঐ একদিনই তারা নিজেদের পা-ভিন্ন অন্য কোনো বাহনে উঠতে পারে। তাই মন্থর গো-শকটে প্রহরের পর প্রহর বসে থাকা তাদের জন্য নিরন্তর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা রাজপুরুষদের কাছে শকটে চলার বদলে হাঁটার অনুমতি চায়। রাজপুরুষরা একটু দ্বিধা করে। তারপরে মেনে নেয় তাদের অনুরোধ। শকটের ওজন কম হলে বলদগুলো জোরে হাঁটতে পারবে। তারা কৈবর্তদের হাঁটার অনুমতি দেয় বটে। তবে হাঁটতে দেয় একজন-একজন করে। পালাক্রমে। একজন কিছুণ হাঁটে। সে এসে শকটে বসে। তারপর আরেকজন হাঁটার সুযোগ পায়। তবে যতণ একজন কৈবর্ত হাঁটে, তার কোমরে ও হাতে বাঁধা থাকে দড়ি। দড়ির একপ্রান্ত কোনো এক রাজপুরুষের সতর্ক হাতে। যাতে কৈবর্ত পালাতে না পারে।
রাজপুরুষদের এই আচরণের কোনো অর্থ খুঁজে পায় না কৈবর্তরা। তারা পালাবে কেন! আর তাদের প্রহরা দিয়ে নিয়ে যেতে হবেই বা কেন! তারা তো আত্মবিক্রয় করেছে। সুতরাং তাদের ক্রেতা ভূস্বামীর কাছে তারা তো যাবেই। কাজও করবে। কেননা কাজ না করলে ঋণ শোধ হবে কী করে! আর ঋণ শোধ না করে মরলেও তো ওলান ঠাকুর তাদের মা করবে না। ক্রেতার লোক আবার তাদের হাতের ভূষাকালির ছাপ নিয়েছে ফলকে। এই হাতের ছাপ নেওয়া ফলকেরই বা কী প্রয়োজন তা বুঝে উঠতে পারে না কৈবর্তরা। মুখের কথার চেয়ে মূল্য বেশি ঐ ভূষাকালির ছাপের! মানুষ মুখ দিয়ে খায়, মাকে মা বলে ডাকে, সন্তানকে আদর করে। সেই মুখের কথাই তো সব। তারা যখন মুখে একবার বলেছে ভূস্বামীর েেত কাজ করতে যাবে, তখন যাবেই।
তুই কেনে বিক্রি হলি ভাই?
তিনজনেরই উত্তর প্রায় কাছাকাছি। সেই নিজস্ব কৃষিত্রে হারানো, জঙ্গলে শিকার করতে গেলে বনরীদের তাড়া খেয়ে ফিরে আসা, অনাহার। অত্মবিক্রয়ের অর্থ স্ত্রী-সন্তানদের হাতে দিয়ে এলে তারা রাজকর পরিশোধ করে কৃষিত্রে ফেরত পাবে। অন্নদায়িনী বরেন্দি মা হয়তো অন্তত পরিজনদের বাঁচিয়ে রাখবে অন্ন যুগিয়ে।
তারা এইসব ভাবে আর দিনের পর দিন পথ চলে।
একদিন রাজপুরুষদের বেশ নির্ভার দেখা যায়। সেদিন পথিমধ্যে সূর্যাস্ত ঘটে গেলেও রাজপুরুষদের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর দেখা যায় না। কারণ রাস্তায় তখনো অনেক মানুষের চলাচল চোখে পড়ে। আর একটু পরেই তিন কৈবর্ত ও বালক পপীপ যা দেখতে পায়, তাতে তারা বিহ্বল হয়ে পড়ে। বিরাট দরজা পেরিয়ে তাদের শকট প্রবেশ করে প্রাচীরঘেরা এক গ্রামে। কিন্তু এ কেমন গ্রাম! রাত নেমে গেছে অনেকণ আগে। কিন্তু এই গ্রামে তা বোঝার উপায় নেই। সমস্ত গ্রাম আলোতে ভেসে যাচ্ছে যেন। বিশাল বিশাল বাড়ি। সেসব বাড়ি তাদের কৈবর্ত-ঝুপড়ির মতো মাটি বা পাতার তৈরি নয়। সেগুলো ইষ্টকের অট্টালিকা। কী তাদের শোভা! বড় বড় মশাল জ্বলছে চারপাশে। কয়েকটা বাড়ির চূড়া আবার মশালের আলো পড়ে এমন ঠিকরানো রূপ নিয়ে চকচক করছে! ওগুলো কি সোনা? চূড়াগুলো কি সোনা দিয়ে মোড়ানো? আবার পথের দিকে তাকিয়ে তারা আরো অবাক। তাদের কাছে পথ মানে তো ভূমিরই একটা অংশ। উঠোনের মতো, কৃষিক্ষেত্রের মতো, পথও তো মাটিরই আরেক রূপ ছাড়া কিছু নয়। লোকের অব্যাহত চলাচলে একটা রেখা পড়ে গেছে শুধু। অথচ এই গ্রামের পথ মাটির পথ নয়। ইটবাঁধানো পথ। বিহ্বল পপীপ প্রশ্ন করে তিন স্বজাতিকেÑ জ্যাঠা, ইটো কি স্বরগ?
তারাই বা কী উত্তর দেবে বালককে! নিজেরা জানলে তো!
শকটচালক হাসে তাদের দিকে তাকিয়ে। একজন রাজপুরুষ বলে- স্বর্গই বটে। এটি হচ্ছে পৃথিবীর স্বর্গভূমি। মহারাজাধিরাজ মহীপালের রাজধানী। গৌড়।
এ কেমন জায়গা! রাত নামলে নিঝুম হয়ে যায় সব কৈবর্তগ্রাম। পুরো বরেন্দি। কোনো ঘরে অত করঞ্জের তেল নেই যে আলো জ্বলবে। সাঁঝের পরপরই অন্ধকার এতই চেপে বসে যে অনেক সময় বনবিহারি পশুরা ভুল করে বন থেকে এসে নির্ভয়ে ঢুকে পড়ে কৈবর্তপল্লীতে। আর এখানে! আলোয় আলোয় দিন-রাত সমান হয়ে গেছে। রাতের বেলাতেও এত আলো যে মাটিতে সুঁই পড়লেও খুঁজে পাওয়া যাবে।
মানুষগুলোর চেহারাও সব অন্যরকম। মনে হয় মাটির ওপর হাঁটলেও তারা যেন মাটির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। মাটি যেন তাদের ছুঁতে পারে না। তাদের গায়ে-পায়ে-কাপড়ে কোথাও মাটির মিহি কণাটি পর্যন্ত লেগে নেই। তাদের পরনের ধুতি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বড় সুন্দর ঢঙে পরা। গায়ে উড়নি। এখানে পুরুষদেরও উর্ধাঙ্গে কাপড়। তাদের বরেন্দিতে কৈবর্ত-মেয়েরাই শুধু কাপড় পরে উর্ধ্বাঙ্গে। সেই কাপড়ও তো আর এদের মতো সুন্দর নয়। খালি কোনোরকমে গা ঢেকে রাখার মতো কাপড়। তে থেকে কার্পাস তুলে এনে নিজেদের হাতে আর নিজেদের তাঁতে বোনা কাপড়। নিজেদের গাঁয়ে কোনোদিন বিপণী দেখেনি কোনো কৈবর্ত। কারণ বিক্রির জিনিসের জন্য হাট রয়েছে। দূরে দূরে হাট বসে সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে। গ্রামের মধ্যে তাই কোনো দোকানের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না কৈবর্তরা। গাঁয়ের মধ্যে এক মানুষ পণ্য বিক্রি করবে আরেক মানুষের কাছে! এতো নীচ কর্মের কথা কোনো কৈবর্তের চিন্তাতেই আসবে না কোনোদিন। কিন্তু এখানে পথের দুই ধারে থরে থরে পণ্য সাজানো পণ্যবিথী। সবার কুলুঙ্গিতে নিজস্ব আলো। মানুষ অকেশে ক্রয়-বিক্রয়ে মত্ত। নিজেদের এই দুরবস্থার মধ্যেও তা দেখে ঘৃণা হয় বন্দি তিন কৈবর্তের। নগরীর পথগুলো অসম্ভব চওড়া। এর নামই বোধহয় রাজপথ। এই রাত্রিকালেও দেখা যাচ্ছে পথ কাঁপিয়ে ছুটছে ঘোড়ায় টানা সুদৃশ্য রথ। সে যেন স্বর্গের বাহন।
কৈবর্তদের অভিভূত দশা দেখে রাজপুরুষরা হাসে। হয়। এরকমই হয়। পৃথিবীর স্বর্গ, নগরকুলশিরোমণি গৌড় নগরীতে পা দিলে কত ভিনদেশী সভ্য পর্যটক পর্যন্ত অভিভূত হয়ে পড়ে। আর এরা তো বর্বর কৈবর্ত। এরা কীভাবে বর্ণনা করতে পারবে বরেন্দ্রী-রাজধানীর সৌন্দর্য! যে রাজধানীকে কবিশ্রেষ্ঠ সন্ধ্যাকর নন্দী বর্ণনা করেছেন- ‘হেত্বাশ্বর, ক্ষেমেশ্বের, লোকেশ্বর প্রভৃতি দেবমূর্তি দ্বারা পবিত্রীকৃত, অবিরত শাস্ত্রপাঠমন্দ্রিত নানা মন্দির-বিহার ভূষিত, গঙ্গা করতোয়া অপূর্ণভবাবিধৌত “অরবিন্দেন্দীবরময় সলিল সুরভি শীতল” এই পুণ্যভূমি সাঙ্গবেদে বিচণ ভগবদ্ভব্ত বিপ্রবর ও সজ্জন অধিবাসীতে পূর্ণ নগরী’ বলে, তার মর্মসৌন্দর্য কীভাবে অনুভব করবে পাষণ্ড কৈবর্তরা। তারা শুধুমাত্র অভিভূতই হতে পারে।
এরপর তাদের চারজনকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি বড় প্রকোষ্ঠে। এটি প্রথম সার্থবাহর (প্রধান বহির্বাণিজ্য কর্মকর্তা) কার্যালয়। রাতে তাদের খেতে দেওয়া হলো পিষ্টক(পিঠা), ভাত, অলাবুর(লাউ) তরকারি, আর সবশেষে কূর্চিকা(ক্ষীর)। এত স্বাদের খাদ্য আগে কোনোদিন খায়নি পপীপ। সম্ভবত বয়স্ক তিন কৈবর্তও।
সকালে এলেন কায়স্থ (প্রধান করণিক) এবং কামরূপের ভূস্বামীর প্রতিনিধি। তারা মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে পাল সাম্রাজ্য থেকে। তাই শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। জনপ্রতি শুল্ক দুই দ্রম্ম। কামরূপের প্রতিনিধি অর্থ পরিশোধ করে ছাড়পত্র নিল কায়স্থের কাছ থেকে। তারপরে আবার যাত্রা শুরু।
এবার সঙ্গে কোনো রাজপুরুষ নেই। চারটি ঘোড়ার পিঠে চারজনকে তুলে নিল কামরূপের লোকেরা। নগরপ্রাকারে আবার দেখাতে হলো ছাড়পত্র।
তারপর বাতাসের বেগে ছুটল অশ্ব। পপীপ আতঙ্কে বিমূঢ়। এমন গতির সঙ্গে সে পরিচিত নয়। তার ভয়, কখন পড়ে যায় ঘোড়ার পিঠ থেকে। কিন্তু তাদের সঙ্গী অশ্বচালকরা অসাধারণ দ। কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বায়ুবেগে ছুটে চলল অশ্ব। সারাদিন ঘোড়া ছুটিয়ে পুণ্ড্রনগর। নগরে প্রবেশ করল না তারা। নগর উপকণ্ঠের অতিথিশালায় রাত্রিযাপন করে প্রত্যুষে আবার যাত্রা শুরু। মধ্যাহ্নে তারা এসে পৌঁছাল কূল না দেখতে পাওয়া একটা নদীর সামনে। লোকেরা বলাবলি করছে এই নদীর নাম ত্রিস্রোতা। এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। তাই এদেশের মানুষের কাছে পৃথিবীর শেষ সীমা এই নদী। বরেন্দির কৈবর্তরা এই নদীর নাম শুনেছে। কিন্তু চোখে দেখেছে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তারা জানে এই নদী তাদের কাছে এক নিষেধের প্রতীক। নদীর ঐ পারে ওলান ঠাকুরের রাজ্য নয়। তাই নদী পার হওয়া মানে কৈবর্তজীবন থেকে বিদায় নেওয়া। কিন্তু এখন এই নদী পেরিয়েই কামরূপে যেতে হয় আত্মবিক্রিত মানুষগুলোকে। রাজপুরুষদের কাছে এই নদী কেবল একটা নদীই। এটাই দুই রাজ্যের সীমান্তরেখা।
ঘোড়া থেকে নেমে নৌকায় ওঠার সময় আরো বেশি কুঁকড়ে যায় পপীপসহ চার কৈবর্ত। তারা শেষবারের মতো ফিরে ফিরে তাকায় নিজেদের লালমাটির দিকে, নিজেদের জাতির মানুষদের দিকে, নিজেদের সত্তার অংশগুলোর দিকে। যেন চলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো চোখ দিয়ে ছেঁকে আত্মায় গেঁথে নিচ্ছে নিজের জল-ভূমি-আকাশকে।
নদীর ছলাচ্ছল জল এসে বাড়ি খাচ্ছে নৌকার খোলে। বৈঠা ঝপাৎ করে নামছে-উঠছে একই ছন্দে নদীর জলে। সেই ছন্দোবদ্ধ শব্দ, নিয়মিত দুলুনি এবং নদীর বুক থেকে উঠে আসা বাতাসের স্পর্শে মুদে আসে কান্ত পপীপের চোখ।
যখন চোখ মেলে, নিজেকে সে দেখতে পায় তাদের গাঁয়ের ঝুপড়ির মতোই এক ঝুপড়িতে। এক কৃশ কৈবর্তপুরুষের কোলে তার মাথা। তার চোখ থেকে ঝরছে অবিরল জল। প্রথমে পপীপের মনে হয়েছিল সে নিজেদের গ্রামে নিজেদের ঝুপড়িতেই শুয়ে আছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে সে আকুল হয়ে ডাকে- মা!
কৈবর্তপুরুষের কান্না আরো বেড়ে যায়। সে আরো কোমল হাতে বুকে টানে পপীপকে। তার মুখটিকে কিছুণ নিরীণ করে পপীপÑ তুমি কে বটি?
পুরুষের নিঃশব্দ কান্না এবার বুকফাটা আর্তনাদে পরিণত হয়। সেই আর্তনাদের মধ্যেই সেই কণ্ঠে জমা হয়ে যায় পৃথিবীর সকল সুধা, সকল মমতা এবং সকল বেদনা। সেই কণ্ঠ বলে- বাপরে, আমি তোর বাবা! [চলবে]
আরও পড়ুন : ‘পিতৃগণ’ উপন্যাসের সন্ধানে
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮৩০, নভেম্বর ২০, ২০১০