আমার সমকালের মানুষের জীবনে একটি অপূর্ব আলো ছিল। পবিত্র সে আলো তাদের যৌবনকে উজ্জ্বল করেছিলো।
তলস্তয়ের রচনা সম্পর্কে যখন প্রথম জানতে পারি, আমার সে সময়কার দিনগুলোর কথা কোনও দিন ভুলতে পারবো না। সেটা ছিলো ১৮৮৬ সাল। সামান্য কয়েক বছরের নিঃশব্দ অঙ্কুরোদগমের পর রুশ শিল্পকলার অপূর্ব সুন্দর পুষ্প ফরাসি দেশের মাটিতে বিকশিত হতে শুরু করেছে তখন। পারীর সব কটা প্রকাশনাভবন থেকে অসম্ভব দ্রুততায় প্রকাশিত হতে থাকে তলস্তয় আর দস্তইয়েফস্কির রচনার অনুবাদ। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৮৮৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় ‘যুদ্ধ ও শান্তি’, ‘আন্না কারেনিনা’, ‘শৈশব ও যৌবন’, ‘পলিকুশকা’, ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’, ককেশাস-সম্পর্কিত উপন্যাসগুলো এবং ‘জনগণের জন্য কাহিনীগুচ্ছ’। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে, বলা যায় সপ্তা কয়েকের মধ্যে, আমাদের উন্মুখ অপেক্ষমাণ চোখের সম্মুখে উন্মুক্ত হলো এক অজানা অপরিচিত বিশাল জীবনের ছবি; সেই ছবিতে প্রতিফলিত নতুন মানুষ, নতুন পৃথিবী।
আমি সবেমাত্র কলেজে ঢুকেছি। আমার সহপাঠীগণ ছিল বিচিত্র মতামতের সব লোকজন। আমাদের ক্ষুদ্র বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল জর্জ দুমার মতো বাস্তববাদী ও পরিহাসপ্রিয় দার্শনিক, স্যারার মতো কবি যারা ইতালিয় রেনেসাঁসের প্রেমে প্রমত্ত, চিরায়ত ঐতিহ্যের বিশ্বস্ত অনুসারীর দল : স্তাঁদালপন্থী, হ্বাগনের অনুসারী, নিরীশ্বরবাদী ও মিস্টক। সে ছিলো এমন এক জগত যেখানে অনুষ্ঠিত হতো অন্তহীন আলোচনা; কারো সাথে কারো মতামতই মিলতো না, কিন্তু কয়েকটা মাসের জন্য আমরা প্রায় সবাই একটি প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলাম, তা হলো : তলস্তয়ের প্রতি আমাদের সাধারণ ভালোবাসা। এটা ঠিক যে প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা কারণে তলস্তয়কে ভালবাসত, কারণ সকলেই তার মধ্যে আবিষ্কার করতো নিজেকে। কিন্তু এই ভালোবাসা ছিল এমন এক ভালোবাসা যা জীবনের মর্মের বাণীর দরজা উন্মুক্ত করে দেয়, আমাদের নিয়ে যায় বিশ্বলোকে। এই শান্তিমন্ত বাণী, য়োরোপের বন্দি আত্মার ক্রন্দনের মতো এই কথকতা আমাদের সর্বলোকে-- আমাদের পরিবারে, আমাদের গ্রামের বাড়িতে,-- সর্বত্র জাগিয়ে তুলেছিলো এক অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য। একই আবেগের উদ্বোধন ঘটে আর আমরা রোমাঞ্চিত হই। আমার মনে পড়েছে আমার নিজের এলাকা নির্ভেন্যার কিছু মধ্যবিত্ত লোক-- যারা কোনওরকম শিল্পকলার প্রতি কস্মিনকালেও আগ্রহ প্রকাশ করেনি, যারা বস্তুতপক্ষে কোনও কিছুই কোনও দিন পড়তো না--‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’ সম্পর্কে কী আপ্লুত আবেগে কথা বলতো!
বহু সম্মানিত সমালোচকের লেখায় আমি পড়েছি-- তলস্তয় নাকি তার দর্শন ও কল্পনামনীষার জন্য ফরাসি রোমান্টিকদের কাছে বিশেষভাবে ঋণী, ঋণী ভিক্তর উগোর কাছে, জর্জ সাঁর কাছে। তলস্তয় যে কখনো জর্জ সাঁর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন এমনটা প্রায় অসম্ভব, তবে জঁ জাক রুশো ও স্তাঁদালের প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তাতে করে তলস্তয়ের মহত্ত্ব ও সম্মোহনী ক্ষমতার অপার ঐশ্বর্য ব্যর্থ হয়ে যায় না। যেসব মতবাদ আর দর্শনের বৃত্তে শিল্পের পরিক্রমা, সে বৃত্তটা খুবই ছোট। এসব মতবাদের মধ্যে তার ক্ষমতার বসবাস নয়, অধিকন্তু এসব মতবাদের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার লেখায়, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং শিল্পীর বিশেষ স্বাক্ষরে, জীবনের রঙে রঞ্জিত হয়ে।
তলস্তয়ের মতবাদ ও দর্শন ধার করা কি ধার করা নয়-- সেটা তো এখনকার বিবেচনার বিষয়; কিন্তু একসময় সমগ্র য়োরোপের নাড়ি ধরে টান দিয়েছিলেন তলস্তয়। সমগ্র য়োরোপে একযোগে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এমন আর একটিও কণ্ঠস্বর নেই। আবেগের উত্তেজনা কী করে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি, সেই আবেগ যা আমরা সবাই অনুভব করতাম মনোবিশ্লেষণের অরুন্তদ আর্তনাদে, নিগূঢ় সঙ্গীতে, সে ঐকতানের জন্য ছিলো আমাদের সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং বস্তুত যা আমাদের জন্য প্রয়োজন ছিল? আমাদের কাছে রচনারীতিটা তখন কোনো ব্যাপারই ছিল না। আমাদের প্রায় সবাই, বিশেষভাবে আমি নিজে, তলস্তয়ের উপন্যাসগুলো পড়ার অনেক পরে পড়েছি মেলশিও দ্য ভগ্যুয়ের রুশ উপন্যাসের উপরে লেখা। আমাদের নায়ক সম্পর্কে তার প্রশংসাবাণী আমাদের কাছে মনে হয়েছে নেহায়েত পানসে। দ্য ভগ্যুয়ে স্বাভাবিকভাবেই একজন জ্ঞানী লোকের মতো কথা বলেছেন। অথচ আমাদের বিবেচনায় জীবনের উপস্থাপনার প্রশংসা করাটাই যথেষ্ট ছিল না; আমরা সে-জীবন যাপন করেছিলাম, তলস্তয়-বর্ণিত জীবনের অস্তিত্ব আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিলাম। আমাদের কাছে তলস্তয়-বর্ণিত জীবন প্রশংসিত হতো অসাধারণ জীবনানুগত্যের কারণে, তার মধ্যে নিহিত তারুণ্যের উচ্ছলতার জন্য। তলস্তয় আমাদের প্রিয় ছিলেন তার রসবোধের জন্য, বাস্তবতার জন্য, বিষয়ের প্রতি দয়ামায়াহীন ঔদাসীন্যের জন্য এবং তার সর্বগ্রাসী নৈতিকতার আদর্শের জন্য। তাকে আমাদের ভালো লাগতো তার ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসার স্বপ্নের জন্য, মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের আদর্শের জন্য, সভ্যতার মিথ্যাচারিতা সম্পর্কে ভয়াবহ অভিযোগ উত্থাপনের জন্য, বাস্তবতার আদর্শের জন্য, মরমীয়া ভাবের জন্য, প্রকৃতির মধ্যে শান্তির বাণী অন্বেষার জন্য, অশরীরী শক্তির অস্তিত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যার জন্য, সর্বোপরি অনির্দিষ্টের মধ্যে বিরাজমান একটি মনোরম দ্বীপ সৃষ্টির জন্য।
আমাদের অনেকের কাছে তলস্তয়ের উপন্যাসগুলো ছিল তেমনি প্রিয়, আমাদের পূর্বপুরুষের কাছে যেমন ছিল হ্বের্টের [গ্যয়টের ‘তরুণ হ্বের্টেরের দুঃখ’(১৭৭৪) উপন্যাসের বিষন্ন ও দুঃখমলিন নায়ক]। এ যেন এক আশ্চর্য আয়না-- প্রতিবিম্বিত আমাদের আবেগ-অনুভূতি, আমাদের সাফল্য ও ব্যর্থতা, শক্তি ও দুর্বলতা, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের ভীতি, আমাদের ভালোবাসা। তলস্তয়ের মধ্যে নিহিত বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সমীকরণ করা আমাদের দায়িত্ব ছিল না। আমরা মোটেই উদ্বিগ্ন ছিলাম না এই জটিল, বহুকৌণিক মানসকে বন্দি করতে। এই মানসে প্রতিধ্বনিত হয় সমগ্র বিস্তৃত বিশ্ব-- একে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক গোত্রের সংক্ষিপ্ত পরিসরে বন্দি করা যায় না। পরবর্তীকালের অনেকেই যারা তলস্তয় সম্পর্কে লিখেছেন তারা এই কাজটি করেছেন-- তারা গোত্রীয় সংকীর্ণতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি, নিজেদের আবেগের পরিধির মধ্যে টেনে এনেছেন তারা এই মহান লেখককে, পরিণামে নিজেদের সমাজতান্ত্রিক বা কেরানীসুলভ কোটারির অবস্থান থেকে তলস্তয়কে বিচার করেছেন তারা। ভাব দেখে মনে হয়, যেন আমাদের সংকীর্ণ গোত্রীয় মনোভাবই একজন প্রতিভাবানকে বিচারের মানদ- হওয়া উচিত! তলস্তয় যদি আমাদের দলের লোক না হন তাহলে আমার কি কিছু যায় আসে? আমি কি জিজ্ঞেস করবো-- শেক্সপিয়র বা দান্তে কোন দলের লোক ছিলেন?
আজকের দিনের সমালোচকদের মতো আমরা বলি না : দুজন তলস্তয় ছিলেন-- সঙ্কটের আগের তলস্তয় এবং সঙ্কটপরবর্তী তলস্তয়, একজন ছিলেন মহান শিল্পী, অন্যজন মোটেই শিল্পী নন। আমাদের কাছে তলস্তয় একজনই ছিলেন এবং আমরা তার পুরোটাকেই ভালোবেসে ছিলাম। অনুভূতি দিয়ে আমরা বুঝেছিলাম-- এ ধরনের বিশাল হৃদয়ে সবকিছুই একীভূত হয়ে যায়, আবার সবকিছুর জন্যই নির্ধারিত থাকে অবিচ্ছেদ্য স্থান।
১৯১১
[ রঁম্যা রঁল্যা [ ২৯ জানুয়ারি ১৮৬৬-৩০ ডিসেম্বর ১৯৪৪] ফ্রেন্স ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ১৯১৫ সালে লাভ করেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। Henry Gifford সম্পাদিত Leo Tolstoy সমালোচনা-সংকলনে মুদ্রিত হয়েছিল বর্তমান লেখাটি। অনুবাদ- আবু করিম। ]
উৎস : লেভ তলস্তোয় : সার্ধ-জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি, হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত, ১৯৮৫
বাংলাদেশ সময় ২০৫৯, ২৫ নভেম্বর ২০১০