ঊনবিংশ শতকের ছাঁচে গড়ে উঠেছিলেন তিনি--একজন টিটান [গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত মহাশক্তিধর আদি দেবতা- সম্পাদক] যার স্কন্ধে মহাকাব্যোপম দায়িত্ব, অথচ এই গুরুভারে অবনত হননি তিনি, যা সহজেই আমাদের বর্তমান নিরক্ত হাঁপানিগ্রস্ত বংশধরদের একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলতো। নিরানন্দ আর নগ্ন বস্তুবাদ-আবিষ্ট সেই যুগ, তাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার আড়ম্বর আর সংযমী কৃচ্ছতা সত্ত্বেও কী মহত্ত্বই না বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেই যুগ থেকে।
তলস্তয় তাঁর প্রথম দিকের রচনা ‘শৈশব, কৈশোর ও যৌবন’ গ্রন্থে বলেছিলেন একদা : ‘কোনওরূপ মিথ্যা বিনয় না করে আমি বলতে চাই, এ সৃষ্টি ইলিয়দের মতো। ’ ওটা অতিশয়োক্তি নয়। যদি এই তুলনা আরো অধিকতর যুক্তিসঙ্গতভাবে তাঁর পরিণত জীবনের বিরাট সৃষ্টি ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ গ্রন্থ সম্পর্কে প্রয়োগ করা হয়, তবে তা শুধু তাঁর বাহ্য বৈশিষ্ট্যের নিমিত্ত। সম্ভবত পৃথিবীতে আর কোনও শিল্পী নেই যার মধ্যে শাশ্বত মহাকাব্য, হোমারীয় ঐতিহ্য তলস্তয়ের মতো এত প্রবল ও গভীর। তাঁর গ্রন্থরাজি মহাকাব্যের অপরিহার্য উপাদানের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর-- তার মহিমান্বিত একবাহিতা আর বীচিবিক্ষুব্ধ সাগরের মতো তার সতত স্পন্দন, তার মদিরোচ্ছলিত তারুণ্য, তার উগ্র মসলাদার ঝাঁঝ, তার অবিনাশী স্বাস্থ্য আর তার অবিনাশী বাস্তবতা নিয়ে। কারণ এটা স্বাভাবিক যে, আমাদের মনে নীরোগতা ও বাস্তবতা চিরন্তনভাবে অবিচ্ছেদ্য, সর্বদা এক নিটোল পূর্ণতা নিয়ে ধ্যেয়, এর মধ্যে বিধৃত সৌন্দর্যের প্রকৃতিজগৎ এবং আধ্যাত্মিক অপাপবিদ্ধ বিশ্ব আর অন্তর্লীন মহানুভবতা, ‘স্বাভাবিক মানুষের’ আবাসভূমি; এর বিপরীতে একদা যেমন আমি প্রয়াস পেয়েছিলাম ব্যাপক পরিসরে দেখাতে নন্দিত ব্যাধিগ্রস্ত ও আধ্যাত্মিক আভিজাত্যধর্মী বিশ্ব, শিলারের আদর্শ প্রচ্ছায়-বিশ্ব এবং দস্তয়েভস্কির দিব্যদর্শন। গ্যয়টে আর তলস্তয়! যখন সমালোচকগণ এ-দুটো নাম একসাথে প্রথম যুক্ত করেছিলেন তখন এ-দুটো নামকে একত্র করে দেখা অদ্ভুত আর অপ্রত্যাশিত মনে হয়েছিল; অবশ্য মনস্তাত্ত্বিক গবেষণার সাম্প্রতিক উন্নতির বিচারে এ ধরনের তুলনা এখন সাধারণ হয়ে গেছে এবং এটা এখন এক স্বীকৃত পদ্ধতি। তা সত্ত্বেও, একমাত্র গোঁড়া পণ্ডিতগণই মৌল সাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলি--যা প্রত্যেকের মূলগত প্রতিনিধিস্থানীয়, তা পরীক্ষা ব্যতিত এ-ধরনের তুল্যমূল্যতা গ্রহণ করে থাকেন। এই দুটি ক্ষেত্রে ভাবাদর্শের আবহাওয়া, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পরিবেশের অতুলনীয়তা এমনই বৈসাদৃশ্যধর্মী যে এটা প্রমাণের জন্য কোনওরূপ সাক্ষ্যপ্রমাণ উদ্ধৃতির প্রয়োজন পড়ে না;-- পার্থক্য এত বিরাট যে সহজেই তা আমাদের চোখে পড়ে। এই দুই শিল্পীর মধ্যে আপাতবিরাট সাদৃশ্য আমাদের অনেকটা কল্পনা জুড়ে অবস্থান করে। যে মুহূর্তে আমরা সংস্কৃতি ধ্যানধারণা সামনে এনে উপস্থিত করি, তৎক্ষণাৎ তাদের মধ্যে শর্তাধীন প্রকৃতির সমান্তরাল ধর্ম সহসাই আমাদের চোখে পড়ে-- সংস্কৃতির ধারণার এই সূত্রে আত্মার জন্য প্রকৃতির প্রেমাকর্ষণ এবং তদনুরূপ প্রকৃতির জন্য আত্মার আবেগধর্মী আকুতি বিধৃত। কারণ, আমাদের এ-কথা স্বীকার করার মতো সৎসাহস থাকা দরকার যে, আত্মার সন্ধানী সেই ‘স্বাভাবিক মানুষ’ তলস্তয়, যিনি আদিম চিন্তা এবং আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির মধ্যপথে উদ্ভটতার হাতে ধরা পড়েছেন, আমাদের কাছে মনে হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে গ্যয়টের সরল নিরাবরণ বর্বরতা, সত্য আর মানবতার সন্ধানে তা দুঃখের দীপ জ্বেলে সন্ধানের পথে মর্মস্পর্শীরূপে অসহায়। কী মহান আর সাথে সাথে কী করুণ দৃশ্য!
তবু, শৈল্পিক বিভাবনায় এই টিটানের কার্যত অসহায়তা যা তলস্তয়ের সৃষ্টিকে দিয়েছে বিরাট নৈতিক শক্তি-- যার মধ্যে বিধৃত হয়েছে একজন এটলাসের [এটলাস : গ্রীক দেবতা, বিশালদেহী এবং মহাশক্তিমান ও সাহসী- স.] শক্তি আর ঐকান্তিকতা নিয়ে তাদের নৈতিক বিষয় আর তা মনে করিয়ে দেয় যন্ত্রণাকিষ্ট মাইকেলাঞ্জেলো সৃষ্ট বিশ্বের অন্যতম ভাবমূর্তিসমূহ। তাঁর শৈল্পিক বর্ণনাকুশলতার হৃদয়গ্রাহী শক্তি তুলনা বিরহিত। প্রতি পদে এর সাথে মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তে দু-কূলপ্লাবী প্রাণদায়ী জীবনীশক্তি, তারুণ্যের সাথে চিত্রহরণকারী প্রতিভায় [আর এছাড়া অন্য কোনও প্রতিভা নেই] আর সৃষ্টি ও স্বাস্থ্যের আদিম উল্লাসে আত্মা পূর্ণ হয়, এমন কি যখন তলস্তয় নিজে শৈল্পিক ধর্মের জন্য কোনওরূপ সচেষ্ট থাকেন না, যখন তিনি শিল্পের বিরুদ্ধে সশস্ত্র রুখে দাঁড়ান আর প্রত্যাখ্যান করেন শিল্পকে, শুধু অভ্যাসের বশে শিল্প-আঙ্গিক ব্যবহার করেন তাঁর নিজস্ব দ্বিধাগ্রস্ত ও শ্রমলব্ধ নৈতিক মতবাদ প্রচারের উপায় হিসেবে, তখনও সেই আকাঙ্ক্ষিত ও আপাতবর্জিত শিল্পও আত্মাকে মুগ্ধ রাখে। এটা অনুকরণের প্রশ্ন নয়। কারণ সে যাই হোক, শক্তির কি কোনও অনুকরণ সম্ভবপর? সম্ভবত এ কথা কখনও বলা সম্ভব হবে না যে, সাহিত্যরীতি বলতে সাধারণত যা বুঝিয়ে থাকে সে-অর্থে তলস্তয় কোনও সাহিত্যরীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আঙ্গিক ও ভাবধারা উভয় ক্ষেত্রে সে-সাহিত্যকর্ম একান্তভাবেই একে অন্যের সমগোত্রীয় নয়, এবং সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তলস্তয়ের নিজের লেখা থেকে পুরোপুরি আলাদা ধরনের লেখাও তার প্রভাবে হয়তো রচিত হতে পারে। কিন্তু ঠিক যেন তিনি স্বয়ং আন্তেউস [আন্তেউস : গ্রীক দেবতা। সমুদ্রদেব পোসেইদোন ও দেবী বসুন্ধরার পুত্র। কথিত আছে, ইনি অপরিচিত ভিনদেশীদের মল্লযুদ্ধে আহ্বান করে লড়তে বাধ্য করাতেন এবং প্রতিপক্ষকে অনিবার্যভাবে পরাজিত করে হত্যা করতেন। একে কেউ পরাজিত করতে পারতো না, কারণ কান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া মাত্রই এর মা বসুন্ধরা পুত্রের দেহে পুনরায় শৌর্যবীর্য ও শক্তি দিয়ে দিতেন। -স.], যখনই তাঁর জননী এই ধরিত্রীকে স্পর্শ করেছেন, অলৌকিকভাবে তাঁর সৃজনশীল ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই তাঁর শক্তিশালী রচনাবলি আমাদের কাছে মাটি-মায়ের মতো, স্বয়ং প্রকৃতির মতো, তাঁর অস্তিত্বের শাশ্বত অন্যতম আঙ্গিকের মতো। বারবার তাঁর রচনাবলি পাঠ করে তাঁর প্রাণীসুলভ দৃষ্টির মতো ধারণাশক্তিতে, তাঁর শব্দের কারুকার্যে যা স্ফটিকস্বচ্ছ বাস্তবতাখচিত আর রহস্যের কুজ্ঝটিকামুক্ত [এক্ষেত্রে গ্যয়টের কথা স্মরণ না করে পারা যায় না] তাতে বিস্মিত হতে হয়। তলস্তয়ের সৃষ্টির পুনঃপঠনপাঠন অতি সূক্ষ্ম-পরিশীলনের প্রলোভন থেকে আর শিল্পে অস্বাস্থ্যকর ভান থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে আদিম স্বাস্থ্যোজ্জ্বল জগতে প্রত্যাবর্তন করে নিজের মধ্যে স্বাস্থ্যদর্পিত আদিম অন্তর্লোকের সন্ধান মেলে।
দস্তয়ভস্কির সাথে তুলনায় এক বিপরীত মেরুতে তাঁকে রক্তমাংসের দেহের মহান দ্রষ্টা বলে অভিহিত করেছেন মেরেঝকোভস্কি। [দমিত্রি মেরেঝকোভস্কি : রুশ কবি ও কাব্যতত্ত্ববিদ, রুশ কবিতায় প্রতীকী আন্দোলনের অন্যতম পুরোহিত। তার বিখ্যাত সমালোচনাগ্রন্থ ‘তলস্তয় ও দস্তয়ভস্কি’ (১৯০১)। প্রগতিদ্রোহী হিসেবে নির্বাসনে মৃত্যু। -স.] দস্তয়ভস্কিকে তিনি আত্মার দ্রষ্টা বলেছেন। আর বাস্তবিক পক্ষে, তলস্তয়ের শিল্পকর্ম থেকে যে-স্বাস্থ্যের উজ্জ্বলতা বিচ্ছুরিত হতো তা দৈহিকভাবে বেঁচে থাকার প্রসন্নতা থেকে উৎসারিত। মনস্তত্ত্ব নিদানশাস্ত্রের সূচনা করেছে। আত্মার জগৎ হলো পীড়িতের জগৎ। স্বাস্থ্য হলো দেহের আধার। এটা খুবই স্বাভাবিক যে তলস্তয় কখনো দস্তয়ভস্কিকে বুঝতে পারেননি। এ সেই একই দস্তয়ভস্কি যিনি ‘আন্না কারেনিনা’র আশ্চর্যজনকভাবে গভীর এক বিশ্লেষণের লেখক। সেই বিশ্লেষণ অন্তর্ভেদী, প্রেমাত্মক ভাষ্যসম্পদ যা শিলারকৃত ‘হ্বিলহেলম মেইস্টে’র [গ্যয়টের উপন্যাস] অনুভূতিশীল উদগ্র পর্যালোচনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘কারামজভ ভ্রাতৃবৃন্দ’র লেখক যখন মারা গেলেন তখন তলস্তয় সহসা উপলব্ধি করলেন যে, তিনি তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ, প্রিয়তম বন্ধু’ ছিলেন। অথচ জীবিতকালে দস্তয়ভস্কি তাঁর মনে কোনওরূপ আগ্রহ সঞ্চার করতে পারেননি, আর আলাপ-আলোচনাকালে তলস্তয় তাঁর সম্পর্কে যে সমালোচনামূলক মন্তব্য করতেন কালেভদ্রে সম্ভবত একজন সংকীর্ণমনা ব্যক্তির পক্ষেই তা সম্ভবপর। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলতেন যে, দস্তয়ভস্কির রচনাবলিতে সকল পৃথিবীই অসুস্থ, কারণ দস্তয়ভস্কি নিজেই অসুস্থ ছিলেন। যদি এ-ধারণার মধ্যে আদৌ কোনও সত্য নিহিত থাকে, তবে এটি তাঁদের মতোই ভাসাভাসা মতামত যেমন নিটশের সম্পর্কে যে ধরনের মতামত তাঁরা দিতেন : ‘না, কোনও অসুস্থ লোক কখনোই বলিষ্ঠ অরুগ্ন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। ’-- এই কটাক্ষ যে শুধু ভাসাভাসা তাই নয়, এর মধ্যে কোনও সত্য নেই। বহু মহৎ ব্যক্তিদের মূল্যায়নের মতোই তলস্তয়ের মূল্যায়ন সুনির্দিষ্ট আর বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখতে গেলে সম্পূর্ণভাবে একপেশে। এ ব্যাপারে স্থিরনিশ্চয় হওয়ার জন্য সেই যুগের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই যখন তিনি শেক্সপিয়রের রচনার সাথে তুলনায়--যাকে তিনি নৈতিকতাবর্জিত বলে বিবেচনা করতেন--‘টম কাকার কুটির’ [মার্কিন লেখিকা হ্যারিয়েট এলিজাবেথ বিচার স্টো [১৮১১-৯৬] রচিত ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ উপন্যাস] গ্রন্থের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। সর্বোপরি তিনি কি নিজের প্রতি ‘সুবিচার’ করেছেন? তিনি যখন তাঁর নিজের সমগ্র জীবনের শক্তিধর সাহিত্যিক সাফল্যকে অলস আর পাপপূর্ণ আমোদ-আহাদ বলে প্রত্যাখ্যান করলেন? এই প্রশ্নকে আমরা শুধু তার সাথে সম্পর্কিত করেই দেখছি না, এমন কি তার চেয়েও বহু আগে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সামাজিক উপন্যাস ‘আন্না করেনিনা’ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, তিনি দশ দশবার তাঁর পাণ্ডুলিপি পরিত্যাগ করেছিলেন, কারণ তাঁর কাছে মনে হয়েছিল তিনি যা লিখেছেন তা ‘তুচ্ছ আর গুরুত্বহীন’। এমন কি পরবর্তী সময়ে যখন বইটি লেখা সমাপ্ত হলো তলস্তয়ের অভিমত এর চেয়ে উন্নত কিছু ছিল না। এ ধরনের আত্মমূল্যায়নকে আত্মিক হতাশার মুহূর্ত এবং নিজের শক্তির প্রতি বিশ্বাসের অভাব বলে ব্যাখ্যা করে উড়িয়ে দেওয়া ভুল হবে। এ ধরনের কঠোর বিচার বিশ্লেষণের জন্য তিনি অন্য কাউকে ক্ষমা করতেন না : আমরা যদি স্বয়ং লেখককে বুঝতে পারি তখনই তাঁর বিচারের মানদ- আমাদের বোধগম্য হবে। আসল কথা হলো, সর্বোপরি মহান মানুষ হিসেবে এই শিল্পী তাঁর নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে এমন অধৈর্যভাবে ঘৃণা পোষণ করতেন-- তাঁর সচেতনতার এই প্রকাশ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি তখনই সম্ভব যখন নিজের শক্তি ও সম্ভাবনা স্বকীয় সৃষ্টির চেয়েও মহত্ত্বর বলে তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছেন। সম্ভবত এটা সত্য যে, একজন স্রষ্টা তার সৃষ্টির চেয়ে অবশ্যই অনেক বড় এবং এই মহত্ত্বের উৎস আরো মহৎ কিছুর মধ্যে নিহিত। সে যা হোক, এ ধরনের উদাহরণ-- যেমন লিওনার্দো, গ্যয়টে আর তলস্তয়-- এই প্রতিপাদ্য সঠিক বলে ধারণার সৃষ্টি করে। যখন তিনি তাঁর ধর্মীয় শিক্ষা আর সঙ্কীর্ণ শাস্ত্রবাক্য সম্পর্কে, নৈতিক আত্মপরিপূর্ণতা সম্পর্কে তাঁর ধারণার কথা বলেন, তখন কেন তিনি তাঁর উপাখ্যানরাজি সম্পর্কে ঘৃণা-তাচ্ছিল্যের সাথে যে-যে কথা বলতেন, সেই ধরনের কথা বলতেন না? কেন তিনি একবারও ওসব নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেননি? এর জবাব খুঁজতে গেলে দেখা যাবে-- তাঁর মধ্যের মানুষটি শিল্পীর চেয়ে শক্তিশালী ছিল এবং চিন্তাবিদ অপেক্ষা অবিসংবাদিতভাবে শক্তিমান ছিল।
হায়, তলস্তয়ের বিচারবুদ্ধি! ঐশীবাণীর মতোই এসব কথা অভিনিবেশ সহকারে শোনা হতো সন্দেহ নেই, কারণ ওগুলো ছিল ঐশীবাণীর প্রকাশ-- শক্তিশালী আত্ম-উন্মোচক যাকে আমরা বলতে পারি ‘বিচিত্র ব্যক্তিত্ব’। এই আত্ম-উন্মোচনা যার অবিসংবাদী ন্যায্যতার সমর্থন পাওয়া যায় আর প্রকৃতির রহস্যজনক নির্দেশে যার দ্যুতিময় প্রকাশের জন্য তুলা জেলার জমিদারি তীর্থস্থানে পরিণত হলো অধ্যাত্ম-পিপাসুদের কাছে, তার জীবনসঞ্চারী রশ্মি সমগ্র বিশ্বের পথপ্রদর্শক আলোকবর্তিকায় রূপ নিলো। জীবন আর মহত্ত্বের পরিপূর্ণতা, মহত্ত্ব আর শক্তি-- এক আর অভিন্ন নয় কি? এখানেই ‘মহৎ মানবে’র সমস্যার সারমর্ম। এই সমস্যা যেমন অশান্ত তেমনি অস্পষ্ট যা বিশ্বের জনগণকে কিছুটা বিভ্রান্ত করেছে, আর চীনারা তার সমাধান করেছে যাদের শান্ত গণতান্ত্রিক সহজাত বুদ্ধি এই প্রবাদের জন্ম দিয়েছে যা আমাদের কানে তীব্রতায় বাজছে-- ‘মহামানব এক সামাজিক বিপর্যয়’। পূর্ববৎ বর্তমানে ইয়োরোপীয় চিন্তাধারা এই ব্যতিক্রমধর্মী লক্ষণ ‘মহামানব’য়ের ক্ষেত্রে এক সৌন্দর্যময় ন্যায়সঙ্গত যুক্তির সন্ধানে আগ্রহী। তথাপি, যখন নেতৃত্ব, মানবজাতিকে আলোকিত করা ও পূর্ণতাদানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ওঠে, তখন বিনীতভাবে বললেও বলতে হয়-- সত্য হিসেবে মিথ্যের ছদ্মাবরণ গ্রহণ না করেও এসবের ও মহামানবের ভূমিকার মধ্যে অথবা অন্ততঃপক্ষে তার ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে কোনও সম্পর্কস্থাপন সম্ভব কি না, এ সন্দেহ দেখা দেয়। আমরা নিজেদের কাছেই এ প্রশ্ন রাখতে বাধ্য হই-- মহামানব কি কিছু একটা বিশুদ্ধ গতিশীল লক্ষণ, এ কি শক্তির কোনও আকস্মিক বিস্ফোরণ যা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভয়ানকভাবে উদাসীন, তথাপি নৈতিক পরিমণ্ডলে স্বীয় স্থান করে নেওয়ার প্রচেষ্টায় এক অনির্দেশ্য স্পর্শ রাখে, যে-প্রচেষ্টায় ‘ইয়াস্নায়া পলিয়ানা থেকে আগত ঈশ্বর-প্রেরিত পুরুষ’ উদার অযৌক্তিকতার সাথে জড়িত হয়ে ভক্তদের হাস্যকর নগণ্যতার ফলে প্রায়শ এমন বিপজ্জনক অবস্থায় পড়েন। কারণ, তার সকল বিয়োগান্ত অবস্থার জন্য, সকল পবিত্র করুণ-মিলনাত্মক অবস্থার জন্য তলস্তয়ের জীবন আশীর্বাদপুষ্ট ছিল, ছিল শক্তির আশীর্বাদে ধন্য, এমন কি নৈতিক যন্ত্রণাপীড়ন এবং এই অসাধারণ মানুষটির আবগধর্মী প্রেরণাশক্তির প্রকাশের আতিশয্য দ্বারা আক্রান্ত ছিল। তাহলে, এসবের ভিত্তি কী ছিল? এক আধিভৌতিক মৃত্যুর ভীতি যা তার শক্তিকেন্দ্রে আঘাত হানে, এই প্রাণশক্তি তার ছদ্মবেশী আধ্যাত্মিক লক্ষ্য সত্ত্বেও জীবনকে আলোকদীপ্ত করতে সমর্থ ছিল। একজন মহৎকে অবমাননা করার আশঙ্কা থেকে আমরা যেন সত্যকে গোপন না করি। এমন কি তলস্তয়ের জীবনের অন্তিমলগ্ন, সংসার ও পরিবার থেকে একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষের অগৌরবময় বিদায়গ্রহণের মূলে ছিল আসন্ন মৃত্যু থেকে পলায়নের জন্য প্রাণীসুলভ সহজাত বুদ্ধির মতোই মুক্তির জন্য সামাজিক-ধর্মীয় তৃষ্ণা।
তা সত্ত্বেও, সেই চমৎকার পঙক্তি, উচ্ছ্বসিত অনুভূতিতে পূর্ণ, যা গ্যয়টে মানুষ সম্পর্কে লিখেছেন, তা আমি কেন ভুলতে পারছি না?
সত্যের তরে শাশ্বত সন্ধান
করেই মানুষ সুন্দর ও মহান।
কী আত্ম-অস্বীকৃতি, সৃজনশীল প্রতিভার শ্রেষ্ঠ সম্পদে প্রকৃতি দ্বারা ভূষিত সেই মানুষটি কী মহৎ উদাহরণ রেখে গেছেন যিনি এই সম্পদ অপ্রয়োজনীয় বলে প্রত্যাখ্যান করলেন এবং ‘সত্যের জন্য শাশ্বত সন্ধানে’র স্বার্থে, জনগণের কাছে সত্য প্রকাশের স্বার্থে তাঁর সমগ্র আন্দোলিত এবং মহিমান্বিত জীবন এক আদর্শের পাদপদ্মে মানবজাতির আধ্যাত্মিক প্রয়োজনের সেবায় উৎসর্গ করলেন। ধরে নেওয়া গেল, তলস্তয়ের রচনাবলি এই পথের সন্ধানে অসংখ্য বিচ্যুতির শিকার হয়েছে, ধরে নেওয়া গেল তাঁর যাযাবর চিন্তা তাঁকে ঋষিতুল্য বিদূষকে পরিণত করেছে, সংস্কৃতির এক অর্থহীন অস্বীকৃতিতে নিমজ্জিত করেছে; তবু, তাঁর আবেগময় সন্ধান এসবের জন্যই ‘মহৎ আর সুন্দর’। বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁর তীক্ষ্ণ সচেতনতার জন্য বিকশিত হয়েছে এই সৌন্দর্য আর মহত্ত্ব। তলস্তয়ের ভবিষ্যৎ-দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল যে : সময় আসছে যখন জীবনের মহত্ত্বের গীতিকার শিল্পকলা মনে হবে তার সত্যনিষ্ঠা হারিয়ে ফেলছে এবং যখন প্রধান, নিশ্চয়াত্মক আর আলোকিত শক্তি হয়ে দাঁড়াবে আত্মা যা নিজেকে সমাজের স্বার্থের সাথে যুক্ত করবে, সমাজের সেবায় উৎসর্গ করবে নিজেকে এবং যেভাবে নৈতিকতা এবং যুক্তির ডাক পড়ে অযৌক্তিক সৌন্দর্যকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য তেমনিভাবে সৃজনশীল প্রতিভাকে পথ দেখানোর জন্য তার ডাক পড়বে। তিনি কখনো এরূপ চিন্তা মনের কোণে লালন করেননি যে, জনগণের মধ্যে অন্ধ, আদিম, প্রেতসাধনা আর অশুভবুদ্ধি জাগ্রত করার জন্য প্রতিভাবান হিসেবে তাঁর অধিকারকে তিনি কখনো ‘মহামানব’ হিসেবে ব্যবহার করবেন। বরং অত্যন্ত বিনয়াবতভাবে সর্বদাই তিনি তাই সাধনা করতেন যা তাঁর ধারণায় যুক্তি আর ঈশ্বর হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল।
এটাকেই আমি মহৎ দৃষ্টান্ত বলি। আমরা সমসাময়িক লেখকরা ইয়োরোপীয় সেই বংশধরের অন্তর্গত যারা তাৎপর্যহীন কিংবা বড় জোর মাঝারি ধরনের, যখন নিজেদের আমরা তলস্তয়ের যুগের সাথে তুলনা করি। সততার সাথে শেষ পর্যন্ত সত্যের সন্ধান এবং জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তাদের কল্যাণসাধনের অঙ্গ হিসেবে আমরা যদি আমাদের যুগের নির্দেশ না শুনি, যদি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে পরান্মুখ হই তবে অখ্যাতি ও অবমানিত হওয়ার আশঙ্কা এবং নির্বোধের ঘৃণা কুড়োনোর বিরুদ্ধে আমাদের কোনও যুক্তি অবশিষ্ট থাকবে না।
১৯২৮
[টমাস মান [৬ জুন ১৮৭৫-১২আগস্ট ১৯৫৫] জার্মান ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার। ১৯২৯ সালে লাভ করেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। তলস্তয়-জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে রচিত টমাস মান এ লেখাটি জর্মন ভাষায় লিখেছিলেন। পরে এটির ইংরেজি ভাষান্তর ছাপা হয় সোভিয়েত সাহিত্য-মাসিক ‘সোভিয়েত লিটেরাচার’-এ। সেখান থেকে অনুবাদ সন্তোষ গুপ্ত। ]
উৎস : লেভ তলস্তোয় : সার্ধ-জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি, হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত, ১৯৮৫
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১০৫, নভেম্বর ২৫, ২০১০