ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

তলস্তয়ের রচনা

হোমার ও শেক্সপিয়র

লিও তলস্তয় | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১০
হোমার ও শেক্সপিয়র

লোকে যাই বলুক, শেক্সপিয়রের লেখা পড়ে যেমনই অভিভূত হোক, এবং যে গুণেই ওগুলোকে বিভূষিত করুক, এ-কথা ধ্রুব সত্য যে, শেক্সপিয়র শিল্পী নন এবং তার সাহিত্যকর্ম শিল্পপদবাচ্য নয়। পরিমিতিবোধ ছাড়া শিল্পী ছিলও না কোনও কালে, হবেও না কখনও, ঠিক যেমন তাল-মাত্রার জ্ঞান ব্যতীত কেউ সঙ্গীতকার হতে পারে না।

এবং শেক্সপিয়রও আর যাই হোন শিল্পী নন।

‘কিন্তু শেক্সপিয়রের কালের পরিপ্রেক্ষিতকে বিবেচনা করতে হবে’ দাবি করেছেন তার নান্দীকাররা, ‘তখন সময়টা ছিল নির্মম ও অসংস্কৃত আচারবিধির যুগ, কেতাদুরস্ত বাগ-বিলাসিতা বা মেপে-জুকে কথা বলার যুগ,-- তখনকার জীবন ছিল আমাদের অচেনা-অজানা; কাজেই শেক্সপিয়রকে বিচার করতে গেলে তার কালকেও আমাদের চোখের সামনে রাখতে হবে। হোমারেও এমন অনেক কিছু আছে যা আমাদের চেনবার কথা নয়, তাই বলে তো হোমারের সৌন্দর্য মূল্যায়নে কোনও অসুবিধা হয় না আমাদের। ’

কিন্তু শেক্সপিয়রকে যখন কেউ হোমারের সঙ্গে তুলনা করে-- যেমন গের্ভিনুস* করেছেন-- তখন সত্যিকারের কবিতা ও তার অনুকরণ-- এই দুয়ের মধ্যকার সীমাহীন দূরত্বটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আমাদের থেকে হোমারের দূরত্ব যতই হোক না কেন, আমরা তো ঠিকই অকেশ-আয়েশে নিজেদেরকে সঞ্চার করে দিই তার বর্ণিত জীবনের ভিতরে। আর এমনটি সম্ভব মূলত এ কারণেই যে, হোমারের কাহিনী আমাদের কাছে যত অচেনাই হোক না কেন, তিনি যা বলেন তা বিশ্বাস করেন, এবং যা বর্ণনা করেন তার কথা গুরুত্ব সহকারেই বলেন, এবং সেহেতু তার লেখায় অতিরঞ্জন নেই, পরিমিতিজ্ঞানের অভাব ঘটে না তার। আর এই কারণেই একিলেস, হেক্টর, প্রায়াম, ওদিসিউস প্রমুখ পরমদীপ্র জীবন্ত চরিত্র এবং হেক্টরের শেষকৃত্য, প্রায়ামের দৌত্য, ওদিসিউসের প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি চির আবেদনময় দৃশ্যাবলির কথা বাদ দিলেও-- সমগ্র ‘ইলিয়দ’, এবং তার চেয়েও বেশি ‘ঈনিদ’, আমাদের এত বেশি ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় মনে হয় যে দেবতা ও বীরবাহুদের মাঝেই যেন আমাদের বাস, অতীতেও, এখনও। অথচ শেক্সপিয়রের বেলায় এমনটি ঘটে না। প্রথম বাক্য থেকেই শুরু হয় তার অতিরঞ্জন : ঘটনার বাড়াবাড়ি, অনুভূতির টানাহেঁচড়া এবং প্রকাশের অস্বাভাবিকতা। চোখ বুলালেই বোঝা যায়, লেখক যা বলছেন তাতে তার নিজেরই বিশ্বাস নেই, এতসব বলারও তার প্রয়োজন নেই, বর্ণিত ঘটনাসমূহ তার বেধড়ক আবিষ্কার; চরিত্রগুলোর প্রতি তার যথাযথ নজর নেই-- নেহায়েত মঞ্চের জন্যই যেন তৈরি তারা, দর্শককে চমকে দেয়ার উদ্দেশ্যে যা-খুশি করানো হচ্ছে, যা খুশি বলানো হচ্ছে; কাজেই আমরা না ঘটনার ঘনঘটায় না তাদের কর্মচ্ছটায় কিংবা তাদের দুঃখদুর্দশায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি।

হোমারের পাশে শেক্সপিয়রকে দাঁড় করালেই বোঝা যায় শেক্সপিয়রে নান্দনিক অনুভূতির নিষ্করুণ অনুপস্থিতি। আমরা যেগুলোকে হোমারের সাহিত্যকর্ম বলি, শৈল্পিক, কাব্যিক ও মৌলিক ইত্যাদি অভিধাসমূহ তাদেরই প্রাপ্য; তারা বেঁচে থাকে তাদের স্র্রষ্টার ভিতরে।

কিন্তু শেক্সপিয়রের সাহিত্যকর্ম বিশেষ উদ্দেশ্যে রচিত রচনামাত্র, শিল্প কিংবা কবিতার সাথে বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও তার নেই।

* গেঅর্গ গটফ্রিড গের্ভিনুস [১৮০৫-১৮৭১] : জর্মন সাহিত্য-ইতিহাসবেত্তা। গ্রিম ভাইদের সমসাময়িক ও বন্ধু। কলাকৈবল্যবাদের বিপরীতে সমাজ ও রাজনীতি আক্রান্ত সাহিত্যদর্শনের প্রবক্তা। উদারপন্থী রাজনৈতিক মহাদর্শের জন্য গাটনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-পদ থেকে এক সময়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তার অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শেক্সপিয়র’  প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪৯ সালে।

[লিও তলস্তয়ের নির্বাচিত প্রবন্ধমালার Aylmer Maude-কৃত অনুবাদ Recollections and Essays গ্রন্থ থেকে। ভাষান্তর : ফারুক মেহদী ]

উৎস : লেভ তলস্তোয় : সার্ধ-জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি, হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত, ১৯৮৫

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১১৫, নভেম্বর ২৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।