০৩. রাজার বাড়ির ভিতরবাড়ি
মহা অমাত্য ভট্টবামনের দীর্ঘ দীঘল শরীরটা আরো উঁচু হতে হতে এতই উঁচুতে উঠে যায় যে তখন সম্রাটের প্রাসাদের আকাশস্পর্শী চূড়াকেও তার কাছে নিতান্তই অপর্যাপ্ত মনে হতে থাকে। এমনটি ঘটে মাঝেমাঝেই।
সেই বংশানুক্রমিক মেধার গুণেই এখন পাল সাম্রাজ্যে কথা যা বলার, বলেন ভট্টবামন। রাজা কেবল সায় দেবার কর্তা।
ভট্টবামনের সব কথায় সায় না দিয়ে মহারাজ মহীপালেরও উপায় নেই। তার পিতা সম্রাট বিগ্রহ পাল বেঁচে থাকতেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল সিংহাসন নিয়ে। তার বিন্দু-বিসর্গও জানতেন না মহীপাল। তার ধারণা ছিল বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে তিনিই হতে যাচ্ছেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। চিরকাল সেটাই হয়ে এসেছে পাল বংশে। যদি কোনো সম্রাট অপুত্রক অবস্থায় মারা যান, তাহলে সেক্ষেত্রে রাজা হবেন সম্রাটের ভ্রাতা। তিনি হবেন কুমার রাজা। আর্যনীতি এটাই। কিন্তু বিগ্রহ পালের ওপর তার ছোট পত্নী রাষ্ট্রকূটবংশীয়া শঙ্খদেবীর প্রভাব ছিল খুব বেশি। এতই বেশি, যে মহারাজ বিগ্রহ পাল তার কনিষ্ঠা মহিষী শঙ্খদেবীর কথায় উত্তরাধিকারী হিসাবে মহীপালের পরিবর্তে শূরপালের নাম ঘোষণা করতে পর্যন্ত প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। শঙ্খদেবীকে কুমন্ত্রণা দিয়ে চলছিলেন তার ভাই মথন দেব। সেই সময় তৎপর হয়ে উঠলেন ভট্টবামন। রাজার অন্তিম ইচ্ছাপত্র চুরি করে ধ্বংস করতে না পারলে আজ মহীপাল রাজা হতে পারতেন না। সময়মতো ভট্টবামনের চাণক্যবুদ্ধি না পেলে মহীপালকে আজ সিংহাসনের পরিবর্তে হয়তো শৃঙ্খলিত অবস্থায় প্রহর গুণতে হতো অন্ধকার কারাগারে, কিংবা কপর্দকশূন্য অবস্থায় নির্বাসিত হতে হতো পাল সাম্রাজ্য থেকে। তাই ভট্টবামনের প্রতি কৃতজ্ঞতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই মহীপালের। সেই কৃতজ্ঞতা এবং তাঁর তীè বুদ্ধির প্রতি আস্থার কারণে ভট্টবামনের পরামর্শ ছাড়া একধাপও ফেলতে রাজি নন মহীপাল। ভট্টবামনের পরামর্শেই মহাসান্ধিবিগ্রহিক (পররাষ্ট্র ও অন্তঃরাষ্ট্রীয় শান্তি প্রতিষ্ঠাবিষয়ক মন্ত্রী) হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে পদ্মনাভকে। মহাপ্রতিহার (প্রধান সেনাপতি) হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন কীর্তিবর্মা। পদ্মনাভ যথার্থই বিদ্বান এবং সজ্জন মানুষ। পার্শ্ববর্তী অন্য দেশ, অন্য রাজ্য এবং গৌড়ের সামন্তরাজ্যগুলির অধিপতিদের কাছে সকল ধরনের আলোচনার জন্য খুবই গ্রহণযোগ্য মানুষ। এমনকি মহীপাল এবং ভট্টবামনের বিরোধীরা পর্যন্ত ব্যক্তি পদ্মনাভকে পছন্দ করে। যথার্থ বিবেচক ব্যক্তি বলে শ্রদ্ধাও করে। কিন্তু অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে শান্তিস্থাপনের ক্ষেত্রে পদ্মনাভকে যতটা কাজ করতে দেওয়া হয়, নিজের দেশের প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ দূর করার কাজে পদ্মনাভকে তেমন কাজ করতে দিতে আগ্রহী নন ভট্টবামন। পাল সাম্রাজ্যে তো শুধু হিন্দু আর বৌদ্ধদের বাস নয়। এই রাজ্যে আছে কত শত জাতির মানুষ। কোল আছে ভীল আছে শবর আছে পুলিন্দ আছে। আছে কৈবর্ত, কোচ, রাজবংশী, মেচ, হাড়িÑ আরো কত বিচিত্র জাতি আর ধর্মের মানুষ। কোনো-না-কোনোভাবে তারাও এখন এই রাজ্যেরই প্রজা। উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং বৌদ্ধদের যেসব অধিকার দেওয়া হয়, সবটুকু না হলেও পদ্মনাভ চান, তাদেরও কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দান করতে। কিন্তু এক্ষেত্রে ছাড় দিতে সম্মত নন ভট্টবামন। তিনি যেটা বোঝেন, পদ্মনাভ তা বোঝেন না। আর্যরা তো এই অঞ্চলে এসেছে এইসব জাতিগোষ্ঠীগুলির ওপর আধিপত্য চালাতেই। এই ভূমির প্রাকৃত অধিবাসীদের দায়িত্বই তো হচ্ছে আর্যদের দ্বারা শাসিত হওয়া আর তাদের সেবা করা। আর্যদের সমৃদ্ধির জন্য নিজেদের সকল দুর্দশা মেনে নেওয়া। কারণ আর্যরা এই দেশে না এলে এখনো ওরা থাকত আদিম জীবনের মধ্যে। জানতেই পারত না সভ্যতা কাকে বলে। ওদের অনেকেই এখনো আদিম জীবনেই রয়ে গেছে। কিন্তু অনেকেই তো আর্যসভ্যতার পবিত্র ছায়াতলে এসে ব্রাক্ষ্মণ-ত্রিয়ের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছে। ধীরে ধীরে একসময় সবাই আর্যসভ্যতার বোধিবৃরে কাছে দীক্ষা গ্রহণ করবে। তাদের শরীর-মন-চিন্তা থেকে মুছে যাবে নিজেদের অনার্য জন্মচিহ্ন। ততদিন পর্যন্ত তাদের নিয়তি হচ্ছে শাসিত হওয়া। যতদিন তারা নিজেদের দেব-দেবী নামক পুত্তলিকাগুলি ছেড়ে, বৃ-পশু-সর্প-সূর্য-কুম্ভীর সবাইকে পূজা করা ছেড়ে আর্য দেবতাদের শরণ না নেবে, ততদিন তাদের কোনো অধিকার প্রদান করা যাবে না।
ভট্টবামনের কথার ওপরে কোনো কথা চলে না। তাই পদ্মনাভকে, তার সকল শুভচিন্তা এবং মানবিকতার ধারণাগুলো নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। কীর্তিবর্মার এধরনের কোনো সমস্যা নেই। তার কাছে ভট্টবামনই শেষ কথা। তার পূর্বপুরুষ আদতে কামরূপ থেকে এদেশে এসেছেন। বিশালদেহী মানুষ। কেউ কেউ বলে তার বুদ্ধি-শুদ্ধিও তার দেহের মতোই মোটা। তবে লোকটার একটা গুণ আছে। কথা কম বলেন। কীর্তিবর্মা মহাপ্রতিহার হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে কোনো বড় যুদ্ধে জড়িত হতে হয়নি পালসৈন্যদের। তাই যুদ্ধেক্ষেত্রে অস্ত্রচালনা এবং সৈন্য পরিচালনায় তার দতা কেমন, সেই বিষয়টি অদ্যাবধি পরীক্ষিত হতে পারেনি। কেউ কেউ তার এই যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। কিন্তু ভট্টবামন তাদের কথায় কান দেন না। কারণ লোকটা সম্রাটের প্রতি কতখানি অনুগত তা জানা না গেলেও ভট্টবামনকেই যে তিনি দেবতা বলে মানেন তা অন্তত ভট্টবামন জানেন। তাছাড়া তার আরেকটি গুণ দৃষ্টি কেড়েছে ভট্টবামনের। তা হচ্ছে লোকটার নিষ্ঠুরতা। শত্রু ও বন্দিদের প্রতি এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারেন কীর্তিবর্মা যে তা দেখে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। এমন লোককে কে কাছছাড়া করতে চায়! তাই কীর্তিবর্মার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ভট্টবামনের আশীর্বাদে কীর্তিবর্মাই এখন পাল সাম্রাজ্যের মহাপ্রতিহার।
মহারাজা মহীপালের সাথে এই তিনজনকে মিলিয়ে সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ পরিষদ। তবে আসল সত্য কেউ কেউ অন্তত জানে। মহীপাল হচ্ছেন সিংহাসনে বসার রাজা। আর দেশ চালানোর আসল রাজা ভট্টবামন। রাষ্ট্রপরিচালনার সবটুকু মতাই মহামাত্য ভট্টবামনের হাতে। মহীপাল সিংহাসনে আরোহণের এক বছরের মধ্যেই কেন্দ্র এবং প্রত্যন্ত প্রদেশের সবগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদে ভট্টবামনের নিজের লোক নিযুক্ত হয়েছে। যেখানে পেরেছেন সেখানে প্রথমে নিয়োগ দিয়েছেন নিজের পরিবারের সদস্যদের। আত্মীয় না পেলে নিজস্ব একান্ত বাধ্যানুগত লোক। ভাণ্ডারিক(রাজকোষাধ্য) তাঁর ভাইপো, পুস্তপাল(প্রধান ভূমি অধিকর্তা) তাঁর আরেক ভাইপো। তাঁর ছোটভাই এখন পালসাম্রাজ্যের মহাধর্মাধিকরণিক(প্রধান বিচারপতি)। এছাড়া ছোট-বড় সকল মণ্ডল(জেলা), ভুক্তি(প্রদেশ)- সব জায়গার প্রধান পদগুলিতে তাঁর নিজের লোক। পাল সম্রাটের সামন্ত রাজ্য এগারোটি। তার মধ্যে কোটাটবী, বালবলভী, অপরমন্দার, কুজবটি, তৈলকম্প, উচ্ছাল- এই ছয়টি অঙ্গরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত রাজা অর্থাৎ করদ রাজা, ভট্টবামনের সঙ্গে আত্মীয়তায় আবদ্ধ। অন্য পাঁচটির শাসক তার সতীর্থ। একই গুরুর কাছে শৈশবে-কৈশোরে এবং যৌবনে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তারা। সেই অর্থে সাম্রাজ্যের সর্বত্রই তার নিজের লোক। অবস্থা এখন এমন যে মহামাত্য একবার শুধু আঙুল নাড়াবেন, সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠবে পালসাম্রাজ্যের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত। আঙুল থামাবেন তো থমকে যাবে সবকিছু।
ভট্টবামনের অশান্তির জায়গা শুধু একটাই। বরেন্দ্রী। কৈবর্তদের সাথে তিনি ঠিক মনের মতো করে এঁটে উঠতে পারেননি। আসলে কৈবর্ত জাতিটিকে তিনি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেন না। এমনকি তাঁর পিতা-পিতামহ, যাদের কূটবুদ্ধির খ্যাতি জগৎজোড়া, তারা কেউ-ই কৈবর্তদের ব্যাপারে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কৈবর্তদের এমনিতে মনে হয় খুবই শান্তিপ্রিয়। নিজেদের জীবন, নিজেদের ধর্ম, নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের আনন্দ-বেদনা নিয়ে নিজেরাই মগ্ন থাকে। বরেন্দি ছেড়ে অন্যত্র কোথাও যেতে চায় না। এমনকি নিজেদের প্রতিবেশী অন্যান্য আদিবাসী কৌম যেমন কোল, ভিল, শবরদের সঙ্গেও ওদের তেমন একটা মাখামাখি নেই। চাষ-বাস করে, মাছ ধরে, বনে বনে শিকার করে, যা জোটে খায়, না জুটলে না খায়। তারা যেমন অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চায় না, তেমনই অন্য কেউ তাদের মধ্যে নাক গলাবে, এটাও সহ্য করে না। সচরাচর রাজার নামে যেসব নির্দেশ পাঠানো হয়, তারা সেগুলি ঠিকমতোই মেনে চলে। কোনো নির্দেশ বা রীতি তাদের মনমতো না হলে সে ব্যাপারে মোড়লদের পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানায়। তাদের যদি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাহলে মেনেও নেয়। আর একবার মেনে নিলে তা পালন করে আমৃত্যু। কিন্তু কী কারণে যে হঠাৎ হঠাৎ তারা ফুঁসে ওঠে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। অতীতের ইতিহাস ঘেঁটে ভট্টবামন দেখেছেন, মহারাজ ধর্মপালের সময় একবার কৈবর্তরা বিদ্রোহ করেছিল। সেই ধর্মপাল, যার শৌর্য-বীর্যের কাছে নতি স্বীকার করেছিল আর্যাবর্তেরও শত শত রাজা। কিন্তু সেই মহাবলী মহারাজ ধর্মপালের দুর্ধর্ষ জগৎজয়ী সৈন্যদলও টিকতে পরেনি কৈবর্তদের সামনে। বরেন্দি থেকে কৈবর্তরা তাড়িয়ে দিয়েছিল রাজ-নিয়োজিত সকল কর্মচারিকে। সোজা জানিয়ে দিয়েছিল, তাদের বরেন্দিতে যদি কোনো রাজকর্মচারি রাখতে হয়, তাহলে তাদের প্রধান হিসাবে রাখতে হবে একজন কৈবর্তকে। অর্থাৎ বরেন্দির প্রাদেশিক প্রধান অমাত্য হবে একজন কৈবর্ত। একমাত্র তার আদেশই মানবে কৈবর্তরা। অনেকদিন ধরে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে কৈবর্তদের শিক্ষা দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পালসম্রাটের জগৎজয়ী সৈন্যদল এই কাজে নেমে নিজেদের লোক হারানো এবং সুনাম হারানো ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি। তাদের বারংবার নাকানিচুবানি খাইয়েছে কৈবর্তরা। যুদ্ধে নেমে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে রাজকীয় সৈন্য আর সেনাপতিরা। কৈবর্ত-যোদ্ধাদের সাহসের কোনো তুলনা নেই। সাহস তো সকল আদিম জাতির মানুষের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু তারা তো বারবার পরাজিত হয়েছে উন্নত অস্ত্র আর প্রশিতি সেনাদলের কাছে। আদিবাসীদের অস্ত্র-শস্ত্র এবং সম্পদ চিরকালই সীমিত। যুদ্ধ চালাতে চালাতে একসময় অস্ত্রের সরবরাহ নিঃশেষ হয়ে যায় তাদের। তখন তারা মেনে নিতে বাধ্য হয় পরাজয়কে। কিন্তু কৈবর্তরা বছরের পর বছর বিদ্রোহ চালিয়ে যেতে পারে। আর তাদের অস্ত্রেরও কোনো শেষ নেই। কোত্থেকে পায় তারা এত অস্ত্রশস্ত্র! গুপ্তচর পাঠিয়ে পরে জানা গেছে যে বরেন্দিতে লৌহখনি আছে বনের মধ্যে। সেসব লৌহখনির সন্ধান কৈবর্তরা জানায় না অন্য কাউকে। তারা খনি থেকে লৌহ নিষ্কাসনের পদ্ধতিও জানে। এবং আকরিক গলিয়ে নিজেদের অস্ত্র নিজেরাই তৈরি করতে পারে। তাই যুদ্ধের সময় তাদের অস্ত্রের কোনো ঘাটতি পড়ে না। রাজার সৈন্যদল আর কতদিন নিজেদের মানুষের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে! নিজেদের রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকলে বাইরের শত্রু র সাথে লড়তে যাবে কে! শেষ পর্যন্ত তাই ধর্মপালের মৃত্যুর পরে মহারাজাধিরাজ দেবপালকে কৈবর্তদের শর্ত মেনেই যুদ্ধবিরতি করতে হয়েছিল। সেই শর্ত অনুসারে তখন থেকে বরেন্দির প্রাদেশিক অমাত্য পদে বসাতে হয় একজন কৈবর্তকে। তাকে আবার গৌড়ের প্রাসাদ থেকে ইচ্ছামতো নিয়োগ দেওয়া যায় না। সেই অমাত্যকে মনোনীত করে কৈবর্তরাই। কৈবর্তদের মোড়ল-মণ্ডলরা দশ বছর পর পর সভা করে যাকে মনোনীত করবে, মহারাজা তাকেই নিয়োগ দেবেন প্রাদেশিক অমাত্য হিসাবে। সেই প্রক্রিয়ায় এখন বরেন্দির প্রাদেশিক অমাত্য দিব্যোক। এই লোকটা আবার আগের সবগুলি কৈবর্ত অমাত্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। শিক্ষাদীক্ষাও বেশি। দেবভাষা সংস্কৃত অবশ্য সে জানে না। ব্রাক্ষ্মণ ছাড়া অন্য কেউ সংস্কৃতভাষা লিখতে-পড়তে শিখে ফেলবে এমন অরাজকতার আশংকা এখনো পালসাম্রাজ্যে দেখা দেয়নি। তবে দিব্যোকের অসাধারণ ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন এক আর্য-ব্রাক্ষ্মণ দেবভাষার সকল নীতি-রীতি ভালোভাবে পাঠ করে জানিয়ে দেয় দিব্যোককে। ফলে যে কোনো রাজকীয় আদেশের মর্মার্থ সে বুঝতে পারে পরিষ্কার। পদ্মনাভ আবার সেই দিব্যোকের গুণমুগ্ধ। শোনা যায় পদ্মনাভের আনুকুল্যে সে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রও নাকি পাঠ করে প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু আয়ত্ত করে ফেলেছে। ভট্টবামন প্রচণ্ড ঘৃণা করেন দিব্যোককে। প্রথম কারণ, দিব্যোককে নিয়োগ করা বা অব্যাহতি দানের মতা তাঁর নিজের হাতে নেই। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, অনেক চেষ্টা করেও লোকটিকে তিনি ক্রয় করতে পারেননি। ভট্টবামন অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছেন, কৈবর্তদের কেউ কোনো পদ লাভ করে রাজঅমাত্যদের সংস্পর্শে এসে আর্যদের জীবনযাপন দেখলে তাদের মতো হয়ে উঠতে চায়। তার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় আর্যসভ্যদের অনুকরণ করা। তারা নিজেদের গোত্রের কথা ভুলে শাসকদের মতো হয়ে উঠতে চায়। তারা কথা বলতে চায় শাসকদের মতো, ভাবতে চায় শাসকদের মতো, এমনকি স্বপ্নও দেখতে চায় শাসকদের অনুকরণে। তারা তাদের গোত্র-জীবনের কথা ভুলে যেতে চায়। এমনকি ঘৃণাও করতে শুরু করে নিজ জাতির অসভ্যদের। তারা সবসময় যেন লজ্জিত হয়ে থাকে নিজেদের জন্মগত কৈবর্ত পরিচয় নিয়ে। আগের প্রায় সবগুলি কৈবর্ত অমাত্যের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটতে দেখা গেছে। সেই সঙ্গে কিছু স্বর্ণমুদ্রার ঝলকানি দেখামাত্র তারা ক্রীতদাস হয়ে যেত আর্যদের। তাদের বিলাসীজীবনে ডুবিয়ে রাখার জন্য গৌড় থেকে সরবরাহ করা হতো উৎকৃষ্ট মদ আর উদ্ভিন্নযৌবনা বারাঙ্গনা। যেসব মদ পাঠানো হয়, সেগুলি ঝোলাগুড়ের তৈরি মদ নয়। এগুলি নৌপথে আসে অনেক দূরের দেশ থেকে। উৎকৃষ্ট দ্রাক্ষার মদ। আর যেসব বারাঙ্গনা তরুণীদের বেছে বেছে পাঠানো হয়, তারা তো উর্বশী-মেনকা-রম্ভার প্রতিযোগিনী। কাঁচা হলুদের সঙ্গে সোনার জল মেশালে যেমন হয়, সেইরকম গাত্রবর্ণ তাদের। সেই বারনারীদের সংস্পর্শে আসামাত্র তাদের পদলেহী কুকুর হয়ে উঠত অসভ্য কৈবর্তদের প্রতিনিধি। সেই মেয়েদের মুখ থেকে শুধু কথা পড়ার অপো। সঙ্গে সঙ্গে কৈবর্ত-অমাত্য নির্দ্বিধায় স্বজাতির স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পালসম্রাটের পে কাজ করে যেত। কিন্তু দিব্যোক! শোনা যায় অন্য কৈবর্তদের মতো সে-ও সোমরসে আসক্ত। কিন্তু দেশী ধেনো ছাড়া সাগরপারের দ্রাক্ষারসসুধা কোনোদিন ছুঁয়েও দেখেনি। আর অপ্সরাদের দূর থেকেই প্রণাম জানিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। রাজকীয় অতিথিভবনে সূর্যাস্তের পরে বসে সঙ্গীত-নৃত্য-দ্রাক্ষা-সুন্দরীদের উৎসব। কিন্তু দিব্যোক একদিনও পা রাখেনি অতিথিভবনের উৎসবে। প্রাদেশিক প্রধান অমাত্য না এলে আর কার জন্য পেতে রাখা হবে এই ব্যয়বহুল কূট-উৎসবের জাল! সুন্দরীরা নিজেদের সৌন্দর্যের অবমাননায় ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ হয়ে এই পাণ্ডববর্জিত বরেন্দি ছেড়ে চলে গেছে আর্য-বসতিগুলিতে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল উৎসব-ঘরে বাতি জ্বালানোর লোক পর্যন্ত নেই। দিব্যোক নিজে তো জালে পা দেয়-ই নি, কোনো কৈবর্ত-মোড়লকেও পা দিতে দেয়নি রাজকীয় ফাঁদে। তার ফলে যা হয়েছে, বরেন্দি এখন নামেমাত্র পালসাম্রাজ্যের অংশ। প্রকৃতপক্ষে সেখানকার শাসনমতার প্রায় পুরোটাই এখন কৈবর্তদের হাতেই। তাই বিভিন্নভাবে জাল বিছিয়ে কৈবর্তদের যে নানাভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করা হচ্ছে, ভট্টবামনের ধারণা, এটিও দিব্যোক বেশ পরিষ্কারই বুঝতে পারছে। যেমন বরেন্দিতে দাদন-ব্যবসায়ী পাঠিয়ে কৈবর্তদের যে ঋণভারে জর্জরিত করা হচ্ছে, তা বেশ পরিষ্কার দিব্যোকের কাছে। সাম্রাজ্যের রীতি অনুযায়ী সে দাদন ব্যবসায়ীদের কাজে বাধা দিতে পারে না। কারণ তারা রাজকীয় অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করতে নেমেছে। তাই দিব্যোক পক্ষেরা পথ ধরেছে। সে কৈবর্তদের সবসময় ঋণগ্রহণে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে। অন্য দেশের ব্যবসায়ী-ভূস্বামীদের কাছে আত্মবিক্রয় করে কৈবর্তদের অনেকেই দেশান্তরী হচ্ছে, এটিও তার ভীষণ অপছন্দের। বিশেষ করে এর ফলে কৈবর্ত জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে বরেন্দিতে। হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারকরা কৈবর্তদের ধর্মান্তর করার চেষ্টা করে থাকে। এই কাজটিও দিব্যোকের পছন্দ নয়। এদের কাজ মহারাজার অনুমোদিত। তাই দিব্যোক সরাসরি তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারে না। কিন্তু অপ্রত্য বাধা সৃষ্টিতে তার চেষ্টার কমতি নেই। কৈবর্তদের মধ্যে নিজের লোক দিয়ে যতদূর সম্ভব, সচেতনামূলক প্রচারণা চালায় দিব্যোক। তাদের নিজেদের ভালো-মন্দ বোঝানোর চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত।
এমন লোককে পছন্দ করার উপায় কোথায় ভট্টবামনের! বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে দিব্যোকের চেষ্টা ধীরে ধীরে হলেও ফলবতী হয়ে উঠছে।
কৈবর্তরা এখন দাদন নেওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আত্মবিক্রয়ের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে আগের তুলনায়। বরং কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, হিংসাত্মক ঘটনার সংখ্যা বেড়ে চলেছে বরেন্দিতে। গো-শকট বোঝাই করে বরেন্দি থেকে ধান আনার সময় বনপথে লুণ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে সেই ধান। বরেন্দিতে যেসব সৈন্য ও রাজকর্মচারি পাঠানো হতো, আগে তারা ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারত কৈবর্তদের সাথে। বিষ্টি(বাধ্যতামূলক শ্রমদান, বেগার) করার জন্য ইচ্ছামতো কৈবর্ত পুরুষ ও বালকদের ধরে আনা যেত। রাজপুরুষদের দৃষ্টির লালসা কোনো কৈবর্তযুবতীর প্রতি একবার নিক্ষিপ্ত হলে তার আর নিজেকে রার কোনো উপায় ছিল না। এইসব কারণে চাকুরিস্থল হিসাবে বরেন্দি রাজকর্মচারিদের কাছে পূর্বে ছিল লোভনীয় স্থান। কিন্তু এখন খবর আসছে, কৈবর্তরমণীর প্রতি কুদৃষ্টি প্রদানের অপরাধে পিটুনি দেওয়া হচ্ছে, কোনো কোনো লোকের চোখ গেলেও দেওয়া হয়েছে, এবং হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে কয়েকজন রাজপুরুষকে। যদিও দিব্যোকের লোকেরা বাইরে বাইরে বলছে যে এগুলো গুপ্তহত্যা। দোষী ব্যক্তি অর্থাৎ খুনী ধৃত হলে তাকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিপ্রদান করা হবে। কিন্তু কেউ ধরা পড়ে না। কাউকে ধরলেও স্যাপ্রমাণের অভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। ফলে এখন বরেন্দিতে নিয়োগ পেতে রাজপুরুষ ও কর্মচারিদের প্রচণ্ড অনীহা। এসবের সঙ্গে দিব্যোক নতুনভাবে আবার কৈবর্তদের আদি পূজা-পার্বন-উৎসবগুলি ধুমধামের সঙ্গে চালু করে দিয়েছে। বিশেষ করে বছরে দুইবার শিকারের উৎসবে এখন সব কৈবর্ত নারী-পুরুষ এমনকি শিশুদেরও যোগ দিতে হয়। প্রত্যেক প্রাদেশিক অমাত্যের জন্য দেহরীরূপে কাজ করার জন্য একশত জন সুদ সৈনিক পাঠানো হয়ে থাকে। দিব্যোকের জন্যও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সে মহাবলী আর্য সৈন্যদের ফেরত পাঠিয়েছে। উল্টো তাদের জন্য যে রাজকীয় অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সেই অর্থ দিয়ে দিব্যোক নিজের জাতির মধ্য থেকে সুদেহী সুঠাম একশত জন যুবককে নিযোগ করেছে। শিকার উৎসবের সময় এরাই কৈবর্তদের নেতৃত্ব দান করে। এ যে আসলে কৈবর্তদের যুদ্ধ-মহড়া আর অস্ত্রগুলিকে শান দিয়ে রাখা, একথা বুঝতে ভট্টবামনের বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। সব মিলিয়ে বরেন্দি এখন মহারাজ, বিশেষ করে মহামাত্যের কাছে, দুশ্চিন্তারই আরেক নাম। বরেন্দি নিয়ে মাসের পর মাস একাধিক মন্ত্রণা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অনেক ভাবনা-চিন্তার পরে গোপনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে কৈবর্তদের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রাখতে হবে সবসময়। এই কাজে প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে ধর্মসহ সকল অস্ত্র।
০৪. রাজার আদেশ এসেছে...
রানীমা স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়েছেন। বরেন্দির দেদ্দাপুরে মন্দির নির্মাণের জন্য স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু তাকে আদেশ করছেন। ভগবান যখন দেখা দেন- তা সেই দেখা স্বপ্নেই হোক আর বাস্তবেই হোক- তখন বুঝতে হবে যে দেখা দিয়েছেন সাক্ষাৎ ভগবানই। কেননা কোনো অসুর ছলনা করে স্বপ্নে বা বাস্তবে- কোনো সময়েই ভগবান বিষ্ণুর রূপ ধারণ করতে পারে না। কাজেই স্বপ্নের আদেশ আর বাস্তবের আদেশ একই কথা। দেদ্দাপুরের কৈবর্তদের আবার একটা প্রত্যুষ শুরু হয় রাজপুরুষের ঢ্যাঁড়া শুনে।
শুন হে কৈবর্ত জাতির মানুষেরা! পরমসুগত গৌড়াধিপতি মহারাজাধিরাজ মহীপালদেবের প্রধানা মহিষী স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন বিষ্ণু-মন্দির নির্মাণের। দেদ্দাপুরে নির্মিত হবে সেই মন্দির। সেই প্রস্তাবিত মন্দিরের সেবায়েত ও পুরোহিত হয়েছেন ব্রাক্ষ্মণকুলশিরোমণি শ্রীবৎসপালস্বামী মহাশয়। সেই মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য তোমাদের এই গ্রাম এবং সন্নিহিত অমুক অমুক গ্রাম প্রদান করা হয়েছে মহান সেবায়েতকে। তিনি এইসব গ্রামের অধিকারী হবেন ‘শাশ্বতকালেলাপভোগ্যয়নীবি সমুদয়বাহ্যাপ্রতিকর’ হিসাবে।
রানীমার স্বপ্নদর্শন আর রাজার পুণ্য অভিপ্রায় শুনে কৈবর্তদের মাথায় হাত। মন্দির হচ্ছে হোক। তা নিয়ে কৈবর্তদের মাথাব্যথা নেই। বিন্তু মন্দিরের সেবায়েতের হাতে গ্রামগুলিকে তুলে দেওয়ার ফলাফল কৈবর্তদের জন্য ভয়ংকর। কেননা অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে যে এই গ্রাম হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গ্রামের মানুষেরও হস্তান্তর। রাজাকে কর দিতে হয় বছরে একবার। যে ফসল তারা পায় তার ছয়ভাগের একভাগ। আর এখন কর দিতে হবে শ্রীবৎসপালস্বামীকে। সেই কর যে কত হবে কেউ জানে না। তাছাড়া জলাধার-অরণ্য-পশুচারণভূমি-গোবাটের জন্য রাজাকে কোনো কর দিতে হয় না। কিন্তু শ্রীবৎসপালস্বামী হয়তো এগুলো ওপরেও কর বসাবে।
তাছাড়া সেবায়েত শুধু কর আদায়ের অধিকারই পাননি, পেয়েছেন দণ্ডদানের অধিকারও। ‘সহ্যদশাপরাধা’। দশটি অপরাধের জন্য দণ্ডদান এবং অর্থদণ্ড করার অধিকার এখন শ্রীবৎসপালস্বামীর হাতে। কী কী সেই অপরাধ? তিনটি অপরাধ কায়িক- চুরি, হত্যা এবং পরস্ত্রীগমন। চারটি অপরাধ বাচনিক- কটুভাষণ, অসত্যভাষণ, অপমানমূলক ভাষণ এবং বস্তুহীন ভাষণ। আর তিনটি মানসিক অপরাধ- পরধনে লোভ, অধর্মচিন্তা এবং অসত্যানুরাগ।
এইসব অপরাধে ইচ্ছামতো যাকে খুশি অপরাধী বানানো যায়। বিশেষ করে বাচনিক এবং মানসিক অপরাধের নামে যাকে-তাকে যখন খুশি অপরাধী সাজানো যায়। এখন থেকে মন্দিরের দোহাই দিয়ে শ্রীবৎসপালস্বামী এই চারটি গ্রামের অধীশ্বর। রাজার শাসন এখানে আর প্রত্য নয়। ফলে সুবিচারের জন্য দিব্যোকের কাছে ধরনা দেওয়ার পথও এখন থেকে বন্ধ এই চারটি গ্রামের কৈবর্তদের জন্য। রানীমা দেখল স্বপ্ন, আর এই চারটি গ্রামের মানুষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে গেল শ্রী বৎসপালস্বামী।
০৫. ভূমি কাহার? রাজ্য কাহার?
সংঘারামে আজকের সন্ধ্যাটি আপাতদৃষ্টিতে অন্য যে কোনো সন্ধ্যার মতোই। কোনো ভিন্নতাই চোখে পড়ে না। ধূপের সুগন্ধি ধোঁয়ায় আকাশের অনেকদূর পর্যন্ত আচ্ছন্ন। তার সাথে ঋতুজাত ফুলের সৌরভের মিশ্রণ।
ঠিক সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তোরণ পেরিয়ে সুশৃঙ্খল সারি তৈরি করে বাহিরে এলেন বিহারের সকল ভিক্ষু। তিনবার সশ্রদ্ধ প্রদক্ষিণ করলেন বুদ্ধস্তূপকে। ধূপের সুগন্ধি বিছিয়ে ফুলের অঞ্জলি অর্পণ করলেন পবিত্র স্তূপে। তারপর সকলে বিহারের চত্বরে বসলেন নতজানু হয়ে। সবচেয়ে সুকণ্ঠি ভিু মহাপ্রভু বুদ্ধের স্তবগান করলেন মধুর সুরে। দশ বা কুড়ি শ্লোকের স্তবগান। গান শেষ হলে আবার সবাই ফিরে যাবেন বিহারের মধ্যে যে যার সাধনপিঠে।
এই বিহারটি বেশ বড়। বিশালই বলা চলে। ঠিক কেন্দ্রস্থলে মহাবোধিসত্ত বুদ্ধের মানবাকার মূর্তি। মূল মন্দিরকে মৌচাকের বিন্যাসে ঘিরে আছে একশত সাতটি ছোট ছোট মন্দির। এগুলোর মধ্যে চুয়ান্নটি মন্দির বৌদ্ধ দেবতাদের পূজার জন্য। আর বাকি তিপ্পান্নটি গুহ্য তান্ত্রিক উপাসনার জন্য। এখানে আছেন একশত আটজন ভিক্ষুপণ্ডিত, যারা সবাই মহাযানপন্থী আচার্য। অন্যেরা বলী-আচার্য, প্রতিষ্ঠান-আচার্য, হোম-আচার্য।
এই বিহারের প্রধান আচার্য হরিভদ্র। আজ এই সূর্যাস্তের স্তবলগ্নে তার কে বসেছে মন্ত্রণাসভা। তবে খুব গোপনে। কারো মনে যাতে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না হয়, সেই কারণে বাহিরে নিয়মিত সান্ধ্যপ্রার্থনা চলছে নিখুঁত নিয়ম মেনে, সুচারুভাবে।
সার বেঁধে ভিুরা ফিরে এলেন বিহারে। তাদের একজন সূত্রপাঠক সিংহাসনে বসে সূত্রপাঠ শুরু করলেন। একটি সূত্রপাঠ শেষ হতেই শ্রোতারা একযোগে বলে উঠছেন- সাধু সাধু! সুভাষিত সুভাষিত!
আচার্য হরিভদ্র তার গবাপথে একবার তাকালেন সূত্রপাঠ ও সূত্রশ্রবণে মগ্ন ভিক্ষুদের দিকে। তারপর বন্ধ করে দিলেন গবারে কপাট। হ্যাঁ-সূচক ইঙ্গিত করলেন ঘরে বসে থাকা বাকি মন্ত্রণাসঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে। অর্থাৎ আলোচনা শুরু করা যেতে পারে এবার। পালসাম্রাজ্যের প্রধান পাঁচ বৌদ্ধবিহারের আচার্য আজ একত্রিত। হরিভদ্র, উপগুপ্ত, প্রিয়রতি, সুভদ্র, বিনয়পালিত। তারা প্রত্যেকেই চিন্তিত, বিষণ্ন এবং ক্রুদ্ধও। হরিভদ্র বিষণ্ন কণ্ঠে বললেন- ভ্রাতৃগণ, আপনাদের কি মনে আছে এই মাটিতে পা পড়েছিল স্বয়ং ভগবান বুদ্ধের? আপনাদের কি মনে আছে অবদানকল্পলতার পৌণ্ড্রবর্ধণ ও সুমাগধা আখ্যান?
সেই আখ্যানের উল্লেখমাত্র নয়ন সজল হয়ে উঠল পাঁচ ভিক্ষুর।
“পুরাকালে শ্রাবস্তী নগরীতে বিজন জেতকাননে সমাসীন বুদ্ধদেবের নিকট অনাথপিণ্ডদ আসিয়া বলিলেন- ভগবান! আমার কন্যা সুমাগধাকে পৌণ্ড্রবর্ধণবাসী সার্থনাথের পুত্র বৃষভদত্ত বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। আপনার অনুমতি পাইলে তাহাকে কন্যাদান করিতে পারি।
বুদ্ধদেব অনুমতি দান করিলেন।
বুদ্ধদেবের অনুমতি অনুসারে অনাথপিণ্ডদ বৃষভদত্তকে কন্যা সম্প্রদান করিলেন।
সুমাগধা যখন পতিগৃহে বাস করিতেছিলেন, একদিন তাহার শ্বশ্রু তাঁহাকে আদেশ করিলেন যে- সুমাগধা, তুমি সমস্ত পূজাপকরণ সজ্জিত করো। জগৎপূজ্যগুণ ভগবান জিন(জৈন ধর্ম প্রবর্তক) কল্য প্রাতে আমাদের গৃহে আগমন করিবেন।
পরদিন মুণ্ডিতকেশ ও সম্পূর্ণ নগ্ন জৈনগণকে অন্তঃপুরে আসিতে দেখিয়া সুমাগধা অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া বস্ত্রদ্বারা মুখাচ্ছাদনপূর্বক খেদ ও নির্বেদবিনত হইয়া গুরুজন সমে শ্বশ্রুদিগকে বলিয়াছিলেন- ছিঃ! ছিঃ! দিগম্বরগণের সম্মুখে কুলবধূগণ রহিয়াছেন, এইরূপ আচার এই প্রথম দেখিলাম! এই শৃঙ্গহীন পশুগণ আপনাদের গৃহে ভোজন করিতেছে। ইহারা মনুষ্য নহে, সম্ভবত এই মনে করিয়াই বুঝি অঙ্গনাগণ ইহাদিগকে দেখিয়া লজ্জিতা হন না।
সুমাগধা এই প্রকারে জৈনদের বহু দোষ-কীর্তন করিলে তাঁহার শ্বশ্রু বিষণ্ন হইয়া তাঁহাকে বলিলেন- ভদ্রে তোমার পিত্রালয়ে কিরূপ লোকের পূজা হইয়া থাকে তাহা বলো।
তিনি বলিলেন- আমার পিত্রালয়ে ভগবান বুদ্ধদেবের পূজা করা হয়। তিনি কারুণ্যবশত সমস্ত জগতের কুশল লাভের জন্য সতত উদ্যত থাকেন।
এইরূপে বুদ্ধের অশেষ গুণ বর্ণনা করিলে শ্বশ্রু সুমাগধার নিকট বুদ্ধের দর্শনের অভিপ্রায় জানাইলেন।
সুমাগধা ভক্তিভাবে বুদ্ধদেবকে আহ্বান করিলে বুদ্ধদেবের আসন টলিল। তিনি পুরোবর্ত্তী আনন্দকে বলিলেন- কল্য প্রাতঃকালে আমাদিগকে পুণ্ড্রবর্ধণ নগরীতে যাইতে হইবে। সুমাগধা আমার ও মদীয় সঙ্ঘগণের পূজা করিবার জন্য প্রার্থনা করিতেছেন। পুণ্ড্রবর্ধন নগর এখান হইতে শতষষ্টি যোজনেরও অধিক, তথাপিও একদিনেই সেখানে যাইতে হইবে। এস্থলে বিলম্ব করা উচিত নহে। যে সমস্ত প্রভাবশালী ভিক্ষুগণ আকাশমার্গে যাইতে পারেন, তাঁহাদিগকেই তুমি নিমন্ত্রণশলাকা সমর্পণ করো।
অনন্তর রাত্রি প্রভাত হইলে সমস্ত ভিক্ষুগণ নানাপ্রকার দেববেশ গ্রহণপূর্বক বিমান দ্বারা আকাশমার্গে গমন করিলেন।
সুমাগধার শ্বশুরাদিগণ সূর্যসম তেজস্বী একজন ভিক্ষুকে দেখিয়া প্রীতিসহকারে সুমাগধাকে বলিলেন- ইনিই কি ভগবান?
সুমাগধা বলিলেন- ইনি ভগবান নহেন। ইনি ভিক্ষু, অজ্ঞাত কৌণ্ডিল্য বলিয়া বোধ হইতেছে।
এইরূপে এক একজন ভিক্ষু বিমানমার্গে দেখা দেন, আর সুমাগধার শ্বশুরাদিগণ জিজ্ঞাসা করেন- ইনিই কি ভগবান?
সুমাগধা প্রণিধানপূর্বক দেখিয়া সেই ভিক্ষুর পরিচয় দেন।
অজ্ঞাত কৌণ্ডিল্যের পর যথাক্রমে মহাকশ্যপ ভিক্ষু, ভিক্ষু শারিপুত্র, মৌদ্গল্য ভিক্ষু, ভিক্ষু অনিরুদ্ধ, ভিক্ষু সুপূর্ণ, ভিক্ষু এষ্যজিৎ, ভিক্ষু উপালী, ভিক্ষু কাত্যায়ন, ভিক্ষু কৌষ্টিল, ভিক্ষু পিলিন্দ বৎস, ভিক্ষু শ্রোণকোটি এই দ্বাদশ ভিক্ষু- তৎপর ভগবান বুদ্ধের পুত্র চক্রবর্তী রাহুলক এবং সর্বশেষে কাঞ্চনবর্ণ শত সূর্য আলোকে আলোকিত করিয়া দেব-নর পুষ্পাঞ্জলি গ্রহণরত ভগবান জিনেন্দ্র বুদ্ধদেব পুণ্যবানগণের নয়নগোচর হইলেন। ভগবান অষ্টাদশ মূর্তিতে অষ্টাদশদ্বার-সমন্বিত ঐ নগরে প্রবেশ করিয়া সুমাগধার গৃহ যেন শশিকান্ত মণির প্রভায় প্রভাময় করিয়াছিলেন।
তত্রত্য সকলেই বুদ্ধদেবকে যথাযোগ্য পূজা করিয়াছিল। শ্বশুরাদিবর্গ-সহিত সুমাগধা এবং অন্যান্য পুরবাসী জনগণ শাস্ত্রের উপদেশ দ্বারা বিশুদ্ধাশয় হইয়া সত্য দর্শন করিয়াছিল।
তৎপরে সমগ্র পৌণ্ড্র জনপদে শুধু একই ধ্বনি, ত্রিশরণের ধ্বনি- বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি! ধম্মং শরণং গচ্ছামি! সংঘং শরণং গচ্ছামি!”
সুমাগধা এবং বুদ্ধের আখ্যান মনে পড়ায় নয়নযুগল অশ্রুপাবিত হয়ে ওঠে ভিক্ষু উপগুপ্তের। তিনি স্খলিত কণ্ঠে আর্তনাদ করেন- আহা কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব স্বর্ণখচিত দিনগুলি! আজ! আজ আমাদের কী দুর্দৈব! আজ এই দেশটা কাদের? এই সাম্রাজ্য কাদের?
কাদের আবার! সকলেই জানে এই দেশ এই পালসাম্রাজ্য বৌদ্ধদের।
প্রিয়রেক্ষিতর মুখে তিক্ত একটুকরো হাসি- সেকথাই সবাই বলবে। কেননা এই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ মহীপাল এখনো নিজেকে পরমসুগত বৌদ্ধ বলেই পরিচয় দান করেন। এই পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল, মহাত্মা ধর্মপাল এবং দেবপাল নিজেদের বৌদ্ধ পরিচয়কেই সবচেয়ে উর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। তাঁরা তাঁদের কর্মের মাধ্যমেও সর্বদা প্রমাণ করতে চাইতেন নিজেদের বুদ্ধপ্রীতি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজা নামেমাত্র বৌদ্ধ। তাঁর রানীরা সব উত্তর বা দণি দেশের হিন্দু রাজবংশের কন্যা। তাঁর মাতা-বিমাতা-মাতৃকুলের সবাই হিন্দু। রাজার মহামাত্য হিন্দু এবং হিন্দুধর্মের প্রসারে সদাব্যস্ত। এমনকি সাম্রাজ্যের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এই সাম্রাজ্যকে এখন কি আর বৌদ্ধ সাম্রাজ্য হিসাবে আখ্যায়িত করা সমীচীন? এই ভূমিকে কি এখন আর ভগবান গৌতমের চরণাশ্রিত ভূমি বলে আখ্যায়িত করা যায়?
সুভদ্র সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানান প্রিয়রতিকে। তিনি পরম শ্লেষের সঙ্গে যোগ করেন- রাজার হিন্দুপ্রীতি অতুলনীয়! হিন্দুদের জন্য রাজা যেন কল্পতরু!
অথচ অতীতের হিন্দু রাজাদের দুস্কৃতির কথা মনে পড়লে যে কোনো বৌদ্ধের শরীরের রোম শিউরে ওঠে। হিন্দু রাজারা বৌদ্ধদের ওপর কী অত্যাচারই না করেছে! বৌদ্ধধর্মকে এদেশের মাটি থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করার অভিপ্রায়ে এমন কোনো কাজ নেই যা করেনি তারা। রাজা শশাঙ্কের কথা তো সকলেরই মনে আছে। তার জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন ছিল এই পলিমাটি আর লোহিতমৃত্তিকার দেশ থেকে বৌদ্ধধর্মকে সমূলে উচ্ছেদ করা। গয়ার বোধিদ্রীম সমূলে উৎপাটন করেছিলেন হিন্দুরাজা শশাঙ্ক। সেখানে যত বৌদ্ধমন্দির ছিল সবগুলি মন্দির থেকে বৌদ্ধমূর্তি সরিয়ে সেখানে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। কুশীনগরের মহাবিহারকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন মাটির সঙ্গে। অজস্র ভিক্ষুকে হত্যা করেছিলেন, দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলেন, জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। মহাবোধিসত্ত অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের পদচিহ্ন সম্বলিত প্রস্তরখণ্ড, যেটি ছিল এই বিস্তৃত সাম্রাজ্যের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সকল মানুষের আধ্যাত্মিক গর্বের ধন, সেই মহাপবিত্র প্রস্তরখণ্ডটিকে গঙ্গায় নিপে করেছিলেন পাষণ্ড রাজা শশাঙ্ক। চিরতরে জলের অতলে তলিয়ে গেছে সেই বুদ্ধচিহ্নস্মারকটি।
আর আমাদের রাজা সেই হিন্দুধর্মের উন্নতির জন্য অর্থ ব্যয় করে চলেছেন অকাতরে। হিন্দুমন্দির প্রতিষ্ঠায় সহায়তা দিচ্ছেন, হিন্দুধর্মপ্রচারকদের নিরাপদে কাজ করার নিশ্চয়তা বিধান করছেন। অথচ আজ দেখুন আমাদের নিজেদের কী রকম দুরবস্থা! সঠিকভাবে ধর্মচর্চা কিংবা জ্ঞানচর্চা করার মতো ন্যূনতম পরিবেশও বিদ্যমান নেই আমাদের জন্য।
ভেবে দেখুন, আমাদের মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন, অর্থাৎ, আবির্ভূত হয়েছিলেন আচার্য শীলভদ্র, শান্তিরতি, পদ্মসম্ভব, কমলশীল, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, চন্দ্রগোমী, অভয়াঙ্কর গুপ্ত, জেতারী, জ্ঞানশ্রীর মতো মহাত্মাবৃন্দ। ভাবতে পারেন, উত্তর হিমালয়ের দুর্গম পর্বতমালা অতিক্রম করে আমাদেরই অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে জ্বালিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্মের আলোকবর্তিকা। আবার দেিণ সুদূর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুবর্ণদ্বীপে শৈলেন্দ্ররাজ শ্রীসংগ্রামধনঞ্জয়ের রাজগুরুপদে বরিত হয়েছিলেন আমাদেরই আচার্য কুমার ঘোষ। হায় আমরা কেউ-ই তাঁদের যথার্থ উত্তরাধিকারী হয়ে উঠতে পারব না!
কেমন করে পারব? আমাদের কি নিরন্তর সাধনা ও পঠনপাঠনের কোনো সুযোগ আছে? এই বিশাল পালসাম্রাজ্যের গৌড়-পুণ্ড্রবর্ধন-বরেন্দ্রীতে একটাও মহাবিহার নেই। নেই পুঁথিসংগ্রহ। নেই দেশ-বিদেশের ধর্মাচার্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে তাঁদের কাছে বিদ্যা অর্জনের সুযোগ।
এখন তাহলে কী করা যায়?
করতে হবে তো অনেক কিছুই। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন এই প্রদেশে এমন একটি বৌদ্ধ মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করা, যা হবে নালন্দার সমতুল্য। আর একই সঙ্গে বড় আকারের যে বিহারগুলি রয়েছে, সেগুলিকে মহাবিহারে রূপান্তরিত করতে হবে। তা নাহলে বৌদ্ধ ধর্মকে রা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আমাদের প্রথম কাজ হবে মহারাজের কাছে এই ধরনের মহাবিহার প্রতিষ্ঠার আবেদন জানানো।
আবেদন নয়, দাবি। সুভদ্র সংশোধন করে দিলেন উপগুপ্তের বাক্য।
আচ্ছা ঠিক আছে দাবিই জানানো হবে। তা সেই দাবি আমরা জানাব কী প্রকারে?
কেন! রাজার কাছে গিয়ে আমরা আমাদের মহাবিহারের প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে বলব। তাঁর অন্তরে যদি মহাবুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধার কণামাত্রও অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তিনি অবশ্যই আমাদের দাবি মেনে নেবেন।
কিন্তু সহোদরোপম ভ্রাতা! রাজার কাছে আমরা পৌঁছুব কী করে? রাজার দর্শন পেতে হলে আগে আমাদের যেতে হবে মহামাত্য ভট্টবামনের কার্যালয়ে। আর তার কাছে গেলে তিনি আমাদের রাজার কাছে যেতে তো দেবেনই না, বরং যাতে আমরা কোনোভাবেই রাজদর্শন না পাই তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন। সৃষ্টি করবেন অযুত প্রতিবন্ধকতা।
হরিভদ্র উত্তেজিত হয়েছেন প্রচণ্ড- তবু আমাদের দেখা করতেই হবে মহারাজের সঙ্গে। যত প্রতিবন্ধকতাই আসুক, সেগুলি আমাদের অতিক্রম করতেই হবে!
কিন্তু কীভাবে?
রাজপ্রাসাদে বৌদ্ধ অমাত্য এখনো যারা অবশিষ্ট রয়েছেন, তাদের কাছে যেতে হবে আমাদের। তারা নিশ্চয়ই আমাদের সাহায্য করবেন রাজদর্শন পেতে।
প্রিয়রতি বিষণœকণ্ঠে বললেন- আমার বিহারের ব্যয়নির্বাহ যে কী কঠিন হয়ে পড়েছে! যারা পূর্বে নিয়মিত মুদ্রাদান করতেন, সেইসব বৌদ্ধ শ্রেষ্ঠীরা আজ নিজেরাই সর্বস্বান্ত, কপর্দকশূন্য। কূটবুদ্ধির অভাবে আর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ব্যবসাবৃত্তিতে তারা হেরে যাচ্ছেন হিন্দু বণিকদের কাছে। কারণ রাষ্ট্র হিন্দুবণিকদের দিচ্ছে অনেক অন্যায় পপাতিত্ব। তাছাড়া বাণিজ্যে এমন কোনো হীনপন্থা নেই যা অবলম্বনে দ্বিধা করে হিন্দুরা। যখন ছলে-বলে-কৌশলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করতে পারে না, তখন তস্কর পাঠিয়ে চুরি করিয়ে নেয় বৌদ্ধশ্রেষ্ঠীদের পণ্যভাণ্ডার, কিংবা পথিমধ্যে দস্যু লেলিয়ে দিয়ে লুঠ করে নেয় সব। তাই আজ আমাদের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিজেদের অন্নের জন্য অপরের অনুগ্রহপ্রার্থী। তারা বিহারে অর্থ দান করবেন কীভাবে?
রাজকোষের বার্ষিক অনুদানের কী খবর?
কী জানি কার অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে সেই বার্ষিক অনুদানের পরিমাণ আজ এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় শূন্যের পর্যায়ে। আমি অন্তত দশবার আবেদনপত্র পাঠিয়েছি প্রাদেশিক অমাত্যের কাছে। তিনি অনুদানবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিজের অপারগতা জানিয়েছেন প্রতিবারই। আগে একশত ত্রিশজন করে যুবক প্রতিবছর বুদ্ধের শরণ নেবার জন্য ভর্তি হতেন আমার বিহারে। অথচ এখন সেই সংখ্যা কমাতে কমাতে বছরে মাত্র চল্লিশ জনে নামিয়ে এনেও আমি ব্যয়সাম্য রা করতে পারছি না। বিদ্যার্থীদের কাসাবস্ত্রের কথা না হয় বাদই দিলাম। প্রবারণা পূর্ণিমার সময় কঠিন চীবরদান উৎসবে সন্নিহিত গ্রামের বৌদ্ধ গৃহস্থেরা যে বস্ত্রগুলি দান করে যান, তা দিয়ে আমরা সাংবাৎসরিক বস্ত্রচাহিদা মিটিয়ে চলতে পারি কোনোমতে। কিন্তু দিনান্তে একবার তো অন্তত বিদ্যার্থী ও অধ্যাপকদের মুখে শাকান্ন তুলে দিতে হবে। সেই ব্যয়নির্বাহ করাই আমার পে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারির দক্ষিণা। ধরুন, গণক কায়স্থ মালাকার তৈলিক কুম্ভকার কাহলিক(ঢোলবাদক) শঙ্খবাদক দ্রাগড়িক(সময়জ্ঞাপক নাকাড়াবাদক) কর্মকর চর্মকার- এদের সবার মাসান্তিক দক্ষিণা প্রদানের অর্থসংস্থানের চিন্তায় আমাকে প্রতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহে কুঞ্চিতললাট হয়ে থাকতে হয়।
একটু থামলেন প্রিয়রতি। তারপর বিষণ্ন কান্ত হাসি ফুটল তার ঠোঁটে- আপনাদের কাছে আর খুলে বলার প্রয়োজন কী! আমি জানি, আমাদের সকলের অবস্থাই কম-বেশি একই রকম।
বিনয়পালিত রুষ্ঠকণ্ঠে বললেন- আমাদের রাজা বৌদ্ধ। এই পালসাম্রাজ্য ভূ-মণ্ডলে বৌদ্ধসাম্রাজ্য নামে পরিচিত। অথচ সুগতশিাপীঠগুলির এই অবস্থা। অথচ জানেন কি এই সাম্রাজ্যের সবগুলি নগরে দেবকুল স্থাপিত হচ্ছে মহা আড়ম্বরে। সেখানে হিন্দু দেবতার সেবার নামে কী যে অশ্লীলতা চলছে! রাজার মতো দেবতারও সেবাদাসীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারা সব চামরধারিণী, ধূপদীপপ্রজ্জ্বালিনী, আলিস্পনকারিণী, নৃত্য-গীতে আনন্দবর্ধিনী। ভট্টবামনের ভাগীনেয় কোটিবর্ষ নগরে যে প্রদ্যুম্নেশ্বর প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানে নাকি অর্ধাঙ্গনাস্বামিনো রত্নাক্ষলংকৃতিভিবি শোষিতবপুঃ শোভাঃ শতংক্ষঃ সুভ্রুবঃ- একশত সুন্দরী দেবদাসী দেবসেবায় নিযুক্তা।
পাঁচ অধ্য পুতপবিত্র চরিত্রের অধিকারী। তারা জীতেন্দ্রিয় হিসাবে বিবেচিত এবং পূজিত। কিন্তু জীতেন্দ্রিয় হোন আর যা-ই হোন, পুরুষ তো বটে। তাই নারী, বিশেষ করে, যুবতী সুন্দরী রমণীদের কথা আলোচনাস্থলে মাত্র একবার উঠেই বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যাবে, তা তো হতেই পারে না। হরিভদ্রের মতো বৃদ্ধও এই আলোচনায় যোগ দেন অবচেতনের উৎসাহে। বলে ওঠেন- আরে শুধু মন্দির আর দেবদাসীর ব্যবস্থা করেই তো ক্ষান্ত দেননি আমাদের মহামাত্য। নিজনামে প্রশস্তিও লিখিয়ে নিয়েছেন আমাদের মহারাজের রাজসভার এক সভাকবিকে দিয়ে। অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ সব পংক্তিমালা। সেগুলি উচ্চারণ করাও পাপকার্য। তবু বাস্তব পরিস্থিতির কতখানি অবনতি হয়েছে, সেকথা বোঝানোর জন্য আপনারা শুনতে চাইলে আমি শোনাতে পারি সেই অশ্লীল পংক্তিমালা।
শোনান! শোনান! সোৎসাহ আহ্বান আসে।
এসব উচ্চারণেও অন্তরে মালিন্য আসে। মহাপ্রভু মার্জনা করুন। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা বোঝানোর জন্যেই এসব উচ্চারণ করতে হচ্ছে আমাকে। শুনুন তাহলে-
এতস্মৈ হরিমেধসে বসুমতিবিশ্রান্তবিদ্যাধরী
বিভ্রান্তিং দধতীঃ শতং স হি দদৌ শারঙ্গীশাবীদৃশঃ।
দগ্ধস্যোগ্রদৃশা দৃশৈব দিশতীঃ কামস্য সংজীবনং
কারা কামিজনস্য সঙ্গাম গৃহং সঙ্গীতকেলিশ্রিয়াম। ।
(সেই চিদাত্মা হরিকে তিনি দান করেছিলেন শতসংখ্যক তরুণহরিণাক্ষী যারা মর্ত্যে অবতীর্ণ বিদ্যাধরীর ভ্রান্তি উৎপন্ন করে, রুদ্রনেত্রে দগ্ধ কামকে যারা কটাইক্ষে উজ্জীবিত করতে পারে, যারা কামুকদের বন্দিশালা, যারা সঙ্গীতকলাবিলাসের মিলনবাসর। )
ধিক্! শতধিক্ এই কবিকে। আর ধিক্ এই ব্যভিচারের উদ্ভাবক মহামাত্যকে!
সমস্বরে ঘৃণাবর্ষণ করে চারটি কণ্ঠ।
আর সেই সম্মিলিত কণ্ঠস্বর এতই উচ্চকিত যে হরিভদ্র, হয়তো আরো কিছুণ এই ব্যাপারটি নিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তার, থতমত খেয়ে থেমে যেতে বাধ্যই হলেন একপ্রকার।
চারজনের ধিক্কার এবং হরিভদ্রের হঠাৎ কথা থামিয়ে দেবার পরিণতিতে কয়েক মুহূর্তের অনিবার্য নৈঃশব্দ। আসলে ঠিক কীভাবে তাদের মূল আলোচনার সূত্রমুখ ফের আঁকড়ে ধরা যাবে তা ভাবতে সময় নিচ্ছিলেন পাঁচজনই। শেষ পর্যন্ত সুভদ্রই শুরু করতে পারলেন আবার। তার কণ্ঠ চিরে বেরুল হাহাকার- আহ্ আমরা আজ এতই অবহেলিত! এতই অবহেলিত বৌদ্ধধর্ম আজ!
অবহেলিত। উপেতি। অবমানিত।
ভাবুন একবার! মহারাজা দেবপালের রাজসভায় যে কোনো বৌদ্ধবিহারের অধ্য ছিলেন ঔত্থিতাসনিক (যাকে দেখলে নিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো হয়)। আমাদের কোনো ভিক্ষু রাজসভায় প্রবেশ করলে পৃথিবীর অধীশ্বর দেবপাল এবং ধর্মপাল সসম্মানে সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভিক্ষুকে অভ্যর্থনা জানাতেন। আর আজ! সেই ভিক্ষুদের উত্তরপরুষ আমরা। আমাদের অধিকারই নেই রাজসভায় প্রবেশের। নিজধর্মের রাজার দর্শনলাভের জন্য, সাক্ষাৎ লাভের জন্য, অনুমতি সংগ্রহ করতে হবে বিজাতীয়, ভিন্নধর্মীয় মন্ত্রী-অমাত্যের মাধ্যমে।
কখনোই না! বজ্রকণ্ঠে বলে ওঠেন উপগুপ্ত- আমরা ভট্টবামনের দ্বারস্থ হবো না কোনোমতেই। বরং চলুন আমরা রাজসভায় যে কয়েকজন বৌদ্ধ অমাত্য অবশিষ্ট রয়েছেন তাদের সঙ্গে দেখা করি। তাদের মাধ্যমে মহারাজের কাছে আমাদের নিবেদন প্রেরণ করি।
তা বোধকরি যুক্তিযুক্ত হবে না। প্রিয়রক্ষিতর কণ্ঠ ম্রিয়মান- এতে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চাওয়ার অপরাধে অপরাধী হতে হবে হয়তো। পরবর্তীতে একথা অবশ্যই জানতে পারবেন ভট্টবামন। তিনি তখন মন্ত্রণা দিয়ে রাজার মনকে আমাদের বিরূদ্ধে আরো বেশি করে বিষিয়ে তুলবেন। এর ফলে আমাদের আরো বেশি তি হয়ে যেতে পারে।
তাহলে?
প্রথমে আমাদের দেখা করার চেষ্টা করতে হবে ভট্টবামনের সাথেই। তার মাধ্যমেই আবেদন জানাতে হবে মহারাজের সাক্ষাৎকারের। মনে রাখবেন, ভট্টবামনের সহানুভূতি না পেলেও তার বিরূপতা অর্জন, অন্তত এইমুহূর্তে, আমাদের কাম্য হতে পারে না।
এই যুক্তির বিরোধিতা করার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না কেউ। [চলবে]
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৩৪০, নভেম্বর ২৭, ২০১০