কবিকে ‘মেধাবী’ বলা যায় কি-না অথবা বললে তাঁর সৃজন-অনুরণনকে অবমূল্যায়ভারে আনত হতে হয় কি-না- এসব বিষয় বিবেচ্য রেখেই, আবুল হাসান(১৯৪৭-১৯৭৫)কে বলা যায় ‘প্রতিভা’। যে প্রতিভার শক্তি আর আলোকে তিনি নির্মাণ করেছেন আত্ম-পরিভ্রমণের বর্ণনলিপি।
‘আবুল হাসান’ নামক কবিতায় তিনি কাব্যযাত্রার ঊষালগ্নে জানিয়েছেন আন্তর-বিলোড়ন, চেতনায় আঘাত করতে-থাকা প্রশ্নাবলি, তার সমাধান-ইঙ্গিত আর নিয়তি-পাওয়া প্রকাশ-আকাক্সার জটিল সব বিষয়াদি-
সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,
মায়াবী করুণ
এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?
এটা কি পাথর নাকি কোনো নদী? উপগ্রহ? কোনো রাজা?
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্না ভেজা চোখ?
মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর
কী অর্থ বহন করে এই সব মিলিত অর?
অতঃপর বিচিত্র জিজ্ঞাসা, উত্তরপ্রাপ্তির জন্য প্রবল মানসিক ছোটাছুটি, ফুল-মোমবাতির প্রসন্নতা, দীর্ঘশ্বাস, সংশয় প্রভৃতি প্রসঙ্গ পেরিয়ে কবি হাসান পৌঁছে যান এক জীবনসত্যের অধিচেতনিক প্রান্তরে। কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকের শেষপ্রান্তে তিনি লেখেন- ‘এটা তোর জন্মদাতা জনকের জীবনের রুগ্ন রূপান্তর,/একটি নামের মধ্যে নিজেরি বিস্তার ধরে রাখা,/তুই যার অনিচ্ছুক দাস!’- এখান থেকেই আবুল হাসানের শিল্পভ্রমণ আরম্ভ। তাঁর ভ্রমণসঙ্গী- নতুন নির্মিত সাঁকো, মৃদুগতি জল, অপরিসীম বিদ্বেষ, ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা-একাকিত্ব-অসহায়বোধ, সস্তা স্মৃতির বিষণ্ণতা, প্রবল প্রবাহে অন্তর্গত আপনঅস্তিত্ব, স্বপ্নবোঝাই মাঠ, হঠাৎ-দেখা বৃক্ষ মানব, শতজীবনের কুয়াশার গান, মানুষের উর্ধ্বগতি-নিুগতি। পিতা-মাতার স্বপ্নসংলাপে হাসান যেন শৈশবেই খুঁজে পান সভ্যতা-অসভ্যতা দ্বন্দ্বের, সাফল্য-অসাফল্য বিষয়ক কিছু জিজ্ঞাসা-
মা বোলতেন বাবাকে তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?
ঘুস খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,
কত রকম ফন্দি আটছে কত রকম সুখে থাকছে,
তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?
(চামেলী হাতে নিুমানের মানুষ)
আবুল হাসান দেখেছেন, প্রকৃতঅর্থে, আমরা ভালো থাকি না; ভান করি মাত্র। অন্ধকারে আলো কুড়াতে-থাকা মগ্ন মানুষ কি সত্যিই বলতে পারে- সে ভালো আছে? না, পারে না। সভ্যতার অগ্রগমণে মানুষের পায়ের আওয়াজ আর পানিপতনের শব্দে সৃজনশীলব্যক্তি সঞ্চয় করেন সবুজাভ শক্তি। বেদনা আর ভবালাবাসার ভাষা খুঁজতে-থাকা কবি হাসান যেন অজান্তে বুকের ভেতর গড়ে তোলেন অরভরা উপন্যাসের জরা-পাহাড়। এক সময় তাঁর কণ্ঠ শোককাতর হয়ে ওঠে। তিনি স্বাধীনতার পতাকায় দেখতে থাকেন চেনা মানুষের মুখ, মুখের প্রতীক- আপনজন হারানোর যন্ত্রণা-আভাস-
তবে কি আমার ভাই আজ
ঐ স্বাধীন পতাকা?
তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদীতে উৎসব?
(উচ্চারণগুলি শোকের)
শিল্পের প্রতি, তার লাবণ্য আর প্রসন্নতার প্রতি দারুণ আস্থাশীল কবি আবুল হাসান। সকালবেলার রোদমাখা প্রিয়ার নরম হাত, তার লজ্জানত মুখ, চুল থেকে ভেসে আসা সুগন্ধী বাতাস আর মনের কোণে লুকিয়ে-থাকা ইচ্ছাগুলিকে তিনি শিল্পের তাজা জলে ভিজিয়ে নিতে চান। তিনি জানেন, শিল্প কখনো কাউকে নিরাশ্রয়-দুঃখলগ্ন করে না; অভাবের কালো ব্যাধিতে, দুরারোগ্য ক্ষেত শিল্প আরোগ্য-পথ্যের প্রলেপ বুলায়। এ প্রবল জানা থেকে তাঁর সহজ প্রকাশ-
শিল্প তো স্বাতীর বুকে মানবিক হৃদপিণ্ড, তাই
আমি তার হৃদপিণ্ডে বয়ে যাই চিরকাল রক্তে আমি
শান্তি আর শিল্পের মানুষ!
(স্বাতীর সঙ্গে এক সকাল)
অবশ্য তিনি ‘প্রত্যাবর্তনের সময়’ দেখেছেন- আলোকসভা নির্মাণ করতে পারে এমন মানুষ আজ বিরল। গড়িয়েছে ব্যাপক সময়, বিগত হয়েছে অগণন মানুষ- মানুষের কীর্তি-অকীর্তি; রেখে গেছে ‘শিল্পমোড়কে’ অনেক অনেক ‘সুবিধাবাদ’।
ব্যক্তিস্বাধীনতা, অস্তিত্ববাদ, অভিব্যক্তিবাদ-কেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশে মানুষ ক্রমাগত হয়ে পড়েছে আত্মকেন্দ্রিক। গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়ভিত্তিক চেতনাবলয় ছেড়ে স্বতন্ত্র-ব্যক্তিনির্ভরতা একদিকে যেমন অর্জন করেছে প্রাতিস্বিকতার স্বীকৃতি, অন্যদিকে হারিয়েছে দলগতভাবে অবস্থানের সুবিধাদি। একসময়, নগরসভ্যতার উদ্ভব-পর্বে কৃষিনির্ভরতা ছেড়ে গাঁয়ের কর্ষণজীবি মানুষ আকর্ষণমুখি জীবনের প্রতি ঝুঁকে, দিয়েছিল আত্মাহুতি- অজান্তেই। অতঃপর আধিপত্যবাদ-আগ্রাসিচিন্তা প্রভৃতির মোহজাল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত সচেতন-আধুনিক মানুষ পুনরায় আটকে পড়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা নামক অন্য এক ব্যাধিতে। এ রোগে আক্রান্ত লোকের কাছে যেন চেনা লোক হয়ে যায় অচেনা, পরিচিত-জানা পরিবেশ-প্রতিবেশ হয়ে পড়ে অজানা। হাসান লিখছেন-
ভাঙা বয়স, ভাঙা আয়না, গ্রীবা রেখায় ধুলো জমছে একই বৃত্তে একই সঙ্গে
দেখে যাচ্ছি সত্য বলি সবাই কেমন আত্মগ্রস্থ : শবযাত্রীও বোলতে পারো,
এখন আমরা কেউই কাউকে চিনতে চাইনা; স্বজন বন্ধু অন্নদাত্রী,
(ব্যক্তিগত পোশাক পরলে)
পৃথিবী এক রঙ্গমঞ্চ। এখানে চলছে আসা-যাওয়ার খেলা, কাঁচা সংলাপের অসাবধানী চাল, বেহিসাবি হিসাব-নিকাশ। বিদায় নিচ্ছে ক্রমাগত বুড়ো-হওয়া নারকেল গাছ, ‘গোলাপ চারার মতো সুন্দর বয়সমাখা প্রসিদ্ধা তরুণী’। এসব বিদায়দৃশ্য সামান্য বেদনা জাগালেও, কোনো কোনো আগমণবারতা বয়ে আনে অফুরন্ত ধেয়ে-চলাশক্তি। মানবের আসা-যাওয়ার নিত্যমঞ্চ এই প্রাচীন পৃথিবী যেন বড় নির্দয়; আচ্ছন্ন তৃণ, বিস্তর জমি, নিবিড় নৌকা, উদার আকাশ, কলরবরত পাখিকুল, উদ্দাম যৌবনযন্ত্রণা, চাঁদ-জ্যোৎস্না, শরীরের শান্ত বুনন, খাঁ খাঁ মাটির কলস, প্রশান্ত ফুলদানি আর ইতস্তত কলমাদির কান্নায় যেন খেলাসমাপ্তির অনাবিল আবাহন-
যাবি তো থামিস কেন? কোথাও থামার নেই, আর
ঐতো নৌকো যায়, মাটির কলস যায়, ফুলদানি যায়!
(রূপসনাতন)
লোকভাবনা, লোকবিজ্ঞান আর লোকসংস্কৃতির আলোয় স্নাত আবুল হাসান ও তাঁর কবিতা। লোকবিশ্বাস গ্রামীণজীবনে অবশ্যগ্রাহ্য বিষয়- হাসান তা জানেন, মানেন। মা, মাতৃভূমি আর মমতার অসীম আকাক্সার, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ব্যাপারাদি যেন লোকসংস্কার দ্বারা অনেকটাই আচ্ছাদিত; যাকে আমরা না বুঝেই বলি ‘কুসংস্কার’। আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভাবে হয়তো লোকসংস্কারে লোকের বিশ্বাস কমেছে, কিন্তু আদৌ কি মুছে গেছে সব আস্থা? কাকের ডাকে অমঙ্গল আশঙ্কা, উঠোনে চাল ছিটিয়ে বিপদনাশ-প্রচেষ্টা, আনন্দের জন্য টিয়েপাখিকে ডাকা, পেঁচার ডাকে শুভ-বারতার আগমণ-ইঙ্গিত, বিড়ালের হাই তোলায় অতিথি আসবার সম্ভাবনা- এসবকে বাদ দিয়ে কি গ্রামজীবন চলে? লোকজচিন্তালগ্ন হাসান লিখছেন-
কে সেই অতিথি? কে সেই বিড়াল হাত আঁচায়, অন্ধকারে
কে সেই সুন্দর পেঁচা যার ডাকে লী চলে আসে?
এসব প্রশ্ন থাক, তার চেয়ে এই যেন হয়?
ছোটবোন বারান্দায় বারবার
কাক ডেকে উঠলেই বলে ওঠে, ভাই,
গুনে গুনে সাতটি চাল ফেলে দে তো কাকটার মুখে!
মা যেন আবার বলে দেয়
কোনদিকে, কোথায় এখনো আছে
ভালোবাসা, পাখি, প্রেম, অন্ধকার আলো ও মানুষ!
(একমাত্র কুসংস্কার)
ইতিহাস-ঐতিহ্য-সভ্যতার দাগ আর অবদান চিত্রণে আবুল হাসান সত্যান্বেষী। সভ্যতার আলো-বাতাস থেকে সরে-আসা মানবযাত্রা আর পথযাত্রীদের সত্যবিচ্যুতির কষ্ট যেন শুধু লালন করেন কবি। তাই তাঁর অনভূতিও দায় ও দায়িত্ব গ্রহণকারী-বহনকারীর মতো। তাঁর ভাবনার অনুরণন-
প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে মনেও রাখবে না
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম, কেন আমি
এ বুক স্পর্শ করে বলেছি একদিন গ্রীস, কলহাস্য, অদিতি উৎসব!
আমি তাম্রলিপি আমি হরপ্পার যুগল মূর্তির কার কে?
কী আমার অনূভূতি? কোনোদিন কোনোই নারীকে
কেন আমি বলিনি মাতৃত্ব? কেন বলেছি নির্জন?
(সেই মানবীর কণ্ঠ)
রাজনীতি নামক এক দানব যেন ছেয়ে ফেলেছে মানুষের চলার স্বচ্ছন্দ গতি, স্বপ্ন ও সুখের সূত্রাবলি; ‘নইলে ডাইনীর মতোন কেন কোমর বাঁকানো/একটি চাঁদ উঠবে জ্যোৎস্নায়’?, ‘মহিলার শাড়ি কেন সভ্যতার শোভার মতোন/খুলে যায়/নেমে যায়, আজকাল/কেন এত সহজেই ভেঙে পড়ে কালো চোখ, কোমল যৌবন’? সর্বত্র রাজনীতি-রাজনীতির কালো ধোঁয়া- দালানের নির্মিতি ও ভাঙায়, গোলাপের ফোটা ও ঝরায়, মানুষের জন্ম ও প্রস্থানে, যৌবনের নতমুখ অসহায়তায়, দুর্ভিরে বিষবাষ্পে আর বেদেনীর তীব্র সাপখেলায় রাজনীতি গড়েছে নিবিড় বাড়ি। তা না হলে কেন ‘বৃষ্টি হলে গা জুড়াবে কেউ বলে না এখন’? বিভ্রমমাখা এই রাজনীতি-বিষয়ে হাসানের বিবৃতি-
তরুণেরা অধঃপাতে যাচ্ছে তাও রাজনীতি পুনরায়
মারামারি যুদ্ধ আর অত্যাচার, হত্যার আগ্রাসী খুন মানুষের
ছড়ানো বীর্যের ব্যথা, বিষণ্ণ মিথুন
মহিলার রক্তের ভিতরে ভ্রুণ, সমস্যার ছদ্মবেশে আবার আগুন
উর্বর হচ্ছে, রাজনীতি, তাও রাজনীতি!
(অসভ্য দর্শন)
আবুল হাসান আশাবাদ-অভিজ্ঞানের শিল্প-নির্মাতা। তিনি তথাকথিত সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে ভয় পাননি; পরোয়া করেননি শহরের শত্রুকবলিত হবার সম্ভাবনাকে, মহামারী-আগ্রাসনআভা-প্রেমহীনতা আর উদ্ধতস্বভাবকে। ‘মানসিক শ্রমে জব্দ জীবনধারিণী’র সর্বস্বখোয়ানো অভিমানে বারবার বাংলাভাষার, স্বদেশের অনাগত-প্রত্যাশিত ‘ভোর, রঙ্গীন জলের আয়না, মধ্যরাত, সোনালি সুদিন’ প্রভৃতির স্বপ্নাবিলতা অনুভব করেছেন তিনি। শরীর থেকে ক্রমাগত নিঃসৃত পাপরস; ‘ঘাম, রক্ত, শ্রমের গানির হেতু’ খুঁজতে গিয়ে পেয়েছেন কেবল কান্তি, করুণতা। শুদ্ধ সামাজিক হাসানের অভিজ্ঞান-
কিন্তু আমি তরবারীর সঠিক স্বভাব আজো বুঝতে পারিনি,
আমি সমাজের সঠিক শব্দার্থ আজো খুঁজে পাইনি কোনো শোকে;
মানবিক ভালোবাসা, নারীর নির্জন হাত কাকে বলে এখনো জানি না!
আমি সমুদ্রের কাছে গিয়ে পুনর্বার সমাজের কাছে ফিরে এসেছি!
রমণীর কাছে গিয়ে পুনর্বার প্রশ্নাতীত আঁধারের কাছে ফিরে এসেছি তমসা,
আমি আলোর ভিতরে শুধু ধ্বংস, হাড় হৃদপিণ্ড, রোদনের স্রোত দেখে
এসেছি তোমার কাছে ফিরে ফিরে হে পালক, অগ্নিশিখা হে তীব্র তামস!
(শিকড়ে টান পড়তেই)
এক কিশোরের কান্তি আর উদাসীনতায় কবি আবুল হাসান যেন দ শিল্পীর মতো নির্মাণ করেন জাগতিক সমূহ স্থবিরতা। এই অজানা (কিন্তু বাস্তবে হয়তো সবার চেনা) কিশোর সারাদুপুর বিষণ্ন চোখে, কান্ত মুখে ‘বুকের মধ্যে কিসের একটা কঠিন দুঃখ’ নিয়ে ঘুরে ঘুরে যখন ঘরে ফিরে, তখন তাকে বিপন্ন দেখায়। কিশোর কী যেন অভিমানে সারাদুপুর বাড়ি ফেরে না; মুষ্ঠিবদ্ধ উত্তোলিত হাতে কী যেন পেতে চায়। কবি তখন সেই কিশোরের কান্তি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না- ‘বিকেলবেলায় যখোন ফেরাও পা দুটিকে, কান্ত দেখায়/কান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ কান্ত দেখায়,/ কান্ত দেখায়! তোমাকে ভীষণ কান্ত দেখায়!’ কবি এক চিরন্তন মানবিক কান্নায় বিনম্র থাকেন। যেন মাটির ভিতরে সুগোপনে একটি স্বদেশ রেখে, বৃ রেখে, বীজ রেখে, অদেখা কোনো শিকড়- যার কোনো শিকড়ত্বই নেই, তার জন্য কাঁদেন তিনি। আর বুকের ভিতর দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী না রাখার প্রত্যয়ে স্থিত থাকেন। দেশমাতার প্রতি তাঁর প্রাণখোলা আহ্বান-
উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো!
... ... ...
সবুজ দীঘির ঘন শিহরণ? হলুদ শটির বন? রমণীর রোদে
দেয়া শাড়ি? তুমি কি দ্যাখোনি আমাদের
আত্মাহুতি দানের যোগ্য কাল! তুমি কি পাওনি টের
আমাদের য়ে যাওয়া চোখের কোণায় তুমি কি বোঝোনি আমাদের
হারানোর, সব হারানোর দুঃখ- শোক? তুমি কি শোনোনি ভালোবাসা
আজও দুঃখ পেয়ে বলে, ভালো আছো হে দুরাশা, হে নীল আশা?
(উদিত দুঃখের দেশ)
যাপিতজীবনের যাবতীয় পাপবোধ থেকে মানসিকভাবে মুক্তি-প্রত্যাশী কবি মাপ্রার্থনায় অবনত। ‘অধঃপতন থেকে এবার বেড়ে’ ওঠার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। ‘অনিদ্রায় চোখের পাতায় শান্ত সমুদ্র বাতাস যেইভাবে ফিরে আসে/সমুদ্রচারীর নিশ্বাসে’, সেইভাবে তিনি যন্ত্রণা থেকে উত্তোরণ আশা করেছেন। বৃহৎ-সম্ভাবনার চেয়ে সামান্যপ্রাপ্তিতে যে অর্ধশিতি জাতি মুখর-নিমগ্ন, নেতৃত্ব দেবার চেয়ে শাসিত হতে যারা ভীষণভাবে অভ্যস্ত, তাদেরকে উদারতা কিংবা আত্ম-উন্নয়নের শিক্ষা দিতে গিয়ে যেন বিব্রত হয়েছেন কবি। ন্যূনতম অর্জন অথবা বিকৃত-প্রাপ্তির বিষয়াদিকে তিনি বাণীবদ্ধ করেন এভাবে-
করাতকলের কাছে কাঠচেরাইয়ের শব্দে জেগেছিল সম্ভোগের পিপাসা!
ইস্টিশানে গাড়ীর বদলে ফরেস্ট সাহেবেব বনবালাকে দেখে
বাড়িয়েছিলাম বুকের বনভূমি!
... ... ...
অন্ধকারে আমি আলোর বদলে খুঁজেছিলাম আকাশের উদাসীনতা!
মধু-র বদলে আমি মানুষের জন্য কিনতে চেয়েছিলাম মৌমাছির
সংগঠনমতা!
(ভ্রমণ যাত্রা)
আলোর পাশে নির্জনতা, মধু-র চাঁকের মতো আঁধার; আঁধারের তীব্র উষ্ণতা, আপাদমস্তক অপরাধ, কুয়াশালীন রক্তের আগুন, দুঃখময় সুখ, ভিনদেশি সভ্যতার অপার মাতম, সমুদ্রের অশেষ মহিমা আর ভুল বুঝা মানুষ- এসবের ভেতরে চলে কী দারুণ নাটক! বসবাস করে ‘কালো দাগ কালো চতুরতা’। হাসানের কবিতায় এ-ভাবনার প্রতিফলন-
পূজোর দিনে তো আমি অনেককেই দেখেছি কেমন
প্রতিমা দেখার নামে চুপে চুপে দেখে নিচ্ছে
লাবণ্য লোভন লোনা মাংসের প্রতিমা।
(আড়ালে ও অন্ধকারে)
অবসাদগ্রস্ত সমাজ, শিল্প-ফুল-হুলুস্থুল সমিতিপ্রধান সভ্যতা, রৌদ্র আর রাত্রির প্রসন্নহীনতা থেকে ছুটি কামনা আবুল হাসানের কবিতার একটি প্রধান অনুষঙ্গ। রাজা, রাজ্য, সিংহাসন, আচ্ছন্ন জ্যোৎস্নারাত তাঁর ঘুম কেড়ে নেয় অনবরত। ঘৃণা আর প্রতিবাদে তিনি থুথু ফেলতে উদ্যত হন প্রতিনিয়ত। নগ্নশিল্প, হত্যাশিল্প, খেলনা সমিতি আর ‘গোলাপভুক সিংহের কারসাজি’ কবির যাপিতজীবনের চালচিত্রে দিয়েছে ভিন্নতর প্রলেপ; কোমলতার অন্তরালে নির্মমতার ছবি তাঁর দেখা- জানা। এখন বড্ড কান্ত তিনি-
আমি দেখেছি তো মানুষ কেবলি তারা ভুল মানুষ ভুল মানুষ,
ভুল মানুষ!
আমি দেখেছি তো শিল্প কেবলি তারা ভুল শিল্প ভুল শিল্প!
আমি দেখেছি নির্মাণ কেবলি তো অবৈধ নির্মাণ, শুধু অবৈধ নির্মাণ!
হয়েছে আমার দেখা হয়ে গেছে সব, জানা হয়ে গেছে সব, চেনা হয়ে
গেছে সব!
(পাতকী সংলাপ)
আবুল হাসান এমন এক পথিক, যার খ্যাতির শীর্ষস্পর্শ কিংবা লাভের লোভ নেই; যেন তিনি কেবলই হাঁটতে থাকা এক বিপন্ন পথিক। কৃত্রিমতা তাঁর আয়ত্বে নেই; শুধু অজান্তে মাঝে মাঝে স্নান করেন করুণ কাঁকরে কিংবা নারীর নম্রতায়। ঘরের ছাদ, মসলিন তাঁত অথবা মিহি কুয়াশায় তিনি খোঁজেন নতুততর শিল্পকলা। অরণ্য আর হাটুরের পায়ের চিহ্নলাগা ঘরেফেরা পথে আজও শুনতে চান ঘুমপাড়ানিয়া গান। কিন্তু বাইরে কেবল বিবস্ত্র যুগ, হাহাকার, তমসা; গোলাপের নামে অবগোলাপের ভিড়, নির্মেঘ রাতের আকাশে নির্জন বাতাস। ‘পৃথিবীতে আজ বড় অবিশ্বাস!’ কবিকে কেউ কেউ করুণায় সিক্ত করতে চায়। কেউবা তাঁকে নিয়ে যেতে চায় শীতল পাটির স্নেহমাখা সরল নদীর গ্রামে; গাছপালা, মাছ আর বেদে-মাঝির বহরে। যেন পথিক হাসান পথ চলতে থাকেন নির্বিকার-
রঙ্গীন রুমালে কিছু ফুলমূল, সবুজ তন্ডুল নাও, তরতাজা তারুণ্য আর
তিনটি রমণী নাও, ধানশীষ মাটির কোদাল!
পথে যেতে দেখা হবে সময় ঘাঁটির সৈন্য, দেখা হবে ভিুক্ষুক শ্রমণ
বাম দিকে দেখতে পাবে অমর করবী ফুল, জোড়াদিঘি, ঘরের অঙ্গন!
একটি ভিুক্ষুক হাসতে থাকবে ভিুক্ষুনীর অর্ধকোল জুড়ে!
... ... ...
ঐ সব পিছে রেখে ডানে এগুলেই একটি গ্রামের ভিতর
দেখতে পাবে খড় এনে আজো ঘর বাঁধছে ঘরামী!
(ভুবন ডাঙ্গায় যাবো)
জল-জলছায়া-জলবাঁশি প্রভৃতি হাসানের প্রিয় শব্দাবলির খণ্ডচিত্র। তিনি জলে ভেসে বেড়াতে আর জলের বিভ্রম থেকে শিা নিতে প্রস্তুত সর্বদা। কবি ‘ঝর্ণার নৃত্য, সীমাবদ্ধ সমুদ্র’ অতিক্রম করে, ‘আরব্য রজনী, শাহী গণিকাদের গোলগাল নাভির অপেরা হাউস!’ পর্যবেণ করে পথ পাড়ি দিতে চান। কেননা, ফিরে তাকালেই দেখতে পান চোখের সামনে সারি-বাঁধা অধঃপতন-স্রোত আর স্বেচ্ছাচারের তরবারী। মন-খারাপ-লাগা ঘোরের মধ্যে যেন তিনি হাঁটতে থাকেন প্রবল অনিচ্ছায়। তাঁর এই ভালো-না- লাগার অনুভূতি-
আমার এখন চাঁদ দেখলে খারাপ লাগে
পাখির জুলুম, মেঘের জুলুম, খারাপ লাগে
কথাবর্তায় দয়ালু আর পোশাকে বেশ ভদ্র মানুষ
খারাপ লাগে,
এই যে মানুষ মুখে একটা মনে একটা. . .
খারাপ লাগে
খারাপ লাগে
(আমি অনেক কষ্টে আছি)
কবি আবুল হাসান ঘাস-শহর-কুমারী শিকড়-বকুল ফুল-রাত-বাড়ি-শিল্প-জ্যোৎস্না-মৃত্যু-শান্তি-নদী-কান্না-ছায়া-ভেজা মাটির নীরব স্পর্শ আর কঠিন ‘জেদীপনা’য় নির্মাণ করেন কবিতার নিবিড় কথামালা। শিল্পের পথ পাড়ি দিতে দিতে নিজের ভিতর তৈরি করেন সহন-শক্তি আর সৃজন-সামর্থ্যের সব প্রত্যয়। ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ নামক তিন পংক্তির ছোট্ট কবিতায় পাওয়া যায় তাঁর সেই প্রত্যয়ের বিবরণ- ‘ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও!’- এ-ই তো আবুল হাসান, এ-ই তো তাঁর কবিতা-কল্পনা, তাঁর কবিতা-ভ্রমণ, কবিতা নির্মাণ।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২২০০, ডিসেম্বর ২, ২০১০