ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, প্রথম পর্ব, অধ্যায় ১৮-২৩

জাকির তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০১১
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, প্রথম পর্ব, অধ্যায় ১৮-২৩

১৮. খণ্ডযুদ্ধের কাল
নাম উগ্র। কিন্তু মস্তিষ্ক তার এতই শীতল যে দিব্যোক পর্যন্ত মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়।

চরম উত্তেজনা কিংবা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তাকে দেখলে মনে হবে সে আরো বেশি শান্ত হয়ে পড়ছে। যে রকম পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষ সাধারণ বোধবুদ্ধি এবং স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে, সেই সময়ে যেন উগ্র আরো বেশি চিন্তাশীলতায় মগ্ন হতে পারে। তার চিন্তার তীক্ষ্ণতা তত যেন বাড়তে থাকে। আবার যুদ্ধের মাঠে তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারে না। যুদ্ধকালে সে এত নিখুঁতভাবে অস্ত্র চালায়, যেন মনে হয় কোন অস্ত্র সে কোনদিকে এবং কখন প্রয়োগ করবে, আগে থেকেই সবকিছু তার পরিকল্পনা করা ছিল।

প্রত্যাঘাত-পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব তাই রুদ্রের কাঁধেই ন্যস্ত করা হয়েছে।

আঘাত এমনভাবে করা হবে, যাতে মনে হয়, দেদ্দাপুরসহ চারটি গ্রামের বিক্ষুব্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ কৈবর্তরাই প্রতিশোধ নেবার জন্য মরিয়া হয়ে নেমে পড়েছে। আক্রমণে অংশ নেবার জন্য এমন সব যুবকদের বেছে নেওয়া হয়েছে, যাদের সাথে দিব্যোক বা তার সাথীদের কোনো সংস্রব আছে, এমন দাবি সপ্রমাণ করা অসম্ভব হয়। সৈন্যদল বা দিব্যোকের দেহরীদের হাতে যেসব অস্ত্র-শস্ত্র থাকে, সেসব অস্ত্র এই আক্রমণে আদৌ ব্যবহার করা হবে না। কোনো দেবগ্রামে সার্বিকভাবে আক্রমণ চালানো হবে না। সাধারণ হিন্দু বা বৌদ্ধদের ওপর কোনো অস্ত্রাঘাত করা হবে না। কোনো নারী বা শিশুর ওপর তো নয়-ই। খুঁজে খুঁজে তালিকা করা হয়েছে শ্রীবৎসপালস্বামীর অপকর্মের সঙ্গীদের। তাদের আবাসস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে। দিব্যোকের অনুচররা জানে সেই আক্রমণকারীদলের সদস্যরা কে কোথায় অবস্থান করছে। শুধু তাদেরই বেছে বেছে তুলে আনা হবে। যদি তারা বন্দিত্ব বরণ না করে, তবে সেখানেই তাদের হত্যা করা হবে। সেই হত্যাকাণ্ডে মুগুর ছাড়া আর কোনো অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। মুগুরের আঘাতে চূর্ণ করে দেওয়া হবে তাদের মস্তক। আর যাদের বন্দি করা সম্ভব হবে, তাদের তুলে আনা হবে  দেদ্দাপুরে। যেখানে এখন ভস্মস্তুপ ছাড়া আর কিছুই নাই। সেখানে সূর্যোদয়ের প্রাক্কালে তাদের বিচার অনুষ্ঠিত হবে। যারা অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তাদের জীবন ভিক্ষা দেওয়া হবে। তবে তারা যেন আর কোনোদিন কৈবর্তদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে না পারে, সেজন্য তাদের হাত এবং পা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে মুষলাঘাতে। অন্যেরা, যারা এই দুষ্কর্মের মূল হোতা, তাদের বলি দেওয়া হবে গাঁওদেব-গাঁওদেবীর থানে।

সম্পূর্ণ অভিযান এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে মনে হবে যে এটি বিক্ষুব্ধ একটি কৈবর্তগোষ্ঠীর কাজ। এমন বিক্ষুব্ধ কয়েকটি দল অনেক আগ থেকেই কাজ করছে বরেন্দিতে। তারা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালায় রাজপুরুষদের ওপর, কেড়ে নেয় আদায়কৃত রাজকীয় কর, মাঝে মাঝে হত্যাও করে অত্যাচারী কোনো কোনো রাজপুরুষ এবং রাজকর্মচারীকে। এইসব গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় ভল্লর দস্যু-বাহিনী। ভল্ল একসময় ছিল একজন দশগ্রামিক। তার লোকদের বিষ্টি দেবার জন্য ধরে নিয়ে হতো জাগদল বিহারে। তখন জাগদল বিহার নির্মাণ করা হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে বিষ্টি  দেবার জন্য দশগ্রামের প্রায় সকল সম লোককেই মাসের পর মাস বাধ্য করা হতো। নিজেদের ক্ষেতের কাজ করার অবকাশই জুটত না কারো। ফলে ক্ষেতে ফলানো গেল না ফসল। দশগ্রামের মানুষ খেতে পায় না। তারা এসে হাত পাতে ভল্লর কাছে। ভল্ল কোত্থেকে অন্ন দেবে তাদের। তার নিজের ক্ষেতেও তো পড়ে আছে চাষের অভাবে ফসলরিক্ত হয়ে। সে তখন সঙ্গীদের নিয়ে গিয়েছিল বিহারের অধ্যরে কাছে। নিবেদন জানিয়েছিল, যত চড়া সুদই লাগুক না কেন, তাদের খাদ্যঋণ দেওয়া হোক। নইলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে মরে যাবে। কিন্তু বিহার থেকে তাদের এককণা খাদ্যও দেওয়া হলো না। সেই রাত্রেই ভল্ল তার সঙ্গীদের নিয়ে বিহারে অভিযান চালাল। তারা কাউকে হত্যা করেনি। শুধু নিজেদের জন্য ন্যূনতম পরিমাণ খাদ্য কেড়ে এনেছিল বিহারের গোলাঘর থেকে। প্রতিশোধ নিতে দেরি করেনি রাজকীয় সৈন্যরা। পরের দিনই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ভল্ল সতর্ক ছিল। গ্রামের প্রবেশপথে একটা মোটামুটি উঁচু টিলা। সেই টিলার মাথায় দাঁড়ালে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টির গোচড়ে আসে। সেখানে সার্বণিক প্রহরায় লোক রেখেছিল ভল্ল। তারা অনেক দূর থেকে আসতে দেখেছিল আক্রমণকারী সৈন্যদলকে। সময়মতো সংকেত পেয়ে গ্রামের নারী আর শিশুরা কাছের পাহাড়ে বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছিল। ভল্ল নিজের সঙ্গীদের নিয়ে প্রতিহত করতে গিয়েছিল রাজপুরুষদের। তবে কিছুণের খণ্ডযুদ্ধের পরেই আর টিকতে পারেনি তারা বিপুল শত্রু পক্ষের সাথে। বন্দি হয়েছিল ভল্ল। তাকে এনে রাখা হয়েছিল প্রাদেশিক অমাত্যের বন্দিশালায়। সেখান থেকে তাকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয় দিব্যোকের দেহরী বাহিনীর লোকরা। পালিয়ে গিয়ে পাহাড়ে আর বনে আশ্রয় নেয় ভল্ল। গড়ে তোলে একটা দুর্ধর্ষ দস্যুদল। সেই দল নিয়ে গত কয়েক বছরে বরেন্দির বিভিন্ন দেবগ্রামে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে ভল্ল। অনেক দেবগ্রামে এখন মায়েরা ঘুমাতে অনিচ্ছুক শিশুকে ঘুম পাড়ায় ভল্লর ভয় দেখিয়ে- চুপ! চুপ! ঐ আসছে ভল্ল ডাকাত। কোনো শিশুকে কাঁদতে শুনলে সে তুলে নিয়ে যায়, আর পাথরের গায়ে আছড়ে শিশুদের মাথা গুঁড়ো করে দেয়। শ্ শ্ শব্দ কোরো না সোনা! ঘুমাও শিগগির!

ভল্ল তার ত্রাস সৃষ্টিকারী দল নিয়ে থাকবে অভিযানের একেবারে সম্মুখভাগে। তার পেছনে থাকবে চারটি গ্রামের যুবকের দল। তবে তারা থাকবে মুখে মুখোশ পড়ে। যে মুখোশ জোটাতে পারেনি, তার মুখে কালি-ঝুলি লেপ্টে দিয়ে এমন ভয়ংকর আনন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ঘুমভাঙ্গা চোখে এমন অবয়ব চোখে পড়ামাত্র আঁতকে উঠবে মানুষ। আর সবার পেছনে থাকবে উগ্র-র নেতৃত্বাধীন দিব্যোকের অনুচরদের যুদ্ধ-প্রশিতি একটা দল। তারা পারতপে নিজেদের অবয়ব দেখাবে না। তারা নিজেরা ঢুকবে না কোনো দেবগ্রামে। গ্রামে ঢোকার পথগুলিতে অবস্থান গ্রহণ করবে। অবরুদ্ধ করে রাখবে গ্রামকে। ইত্যবসরে নিজেদের কাজ করবে ভল্লর দল। যদি কোনো কারণে ভল্লর নেতৃত্বাধীন যুবকরা পরাজয় কিংবা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে পড়ে, কেবলমাত্র তখনই, সংকেত পেলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর।

১৯. ভট্টবামনের ক্রোধ
বেশ কিছুদিন ধরে বরেন্দ্রীর কোনো সংবাদ পাচ্ছেন না ভট্টবামন। সেখানে কর্মরত খোলদের(গুপ্তচর) বলে দেওয়া হয়েছে যে বরেন্দ্রী যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর স্থান, তাই যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তার কাছে এসে পৌঁছাতেই হবে। রাজকীয় খোলদের পাশাপাশি ভট্টবামন নিজস্ব উদ্যোগে আরো কয়েকজন খোল নিযুক্ত করেছেন। তাদের কেবলমাত্র ভট্টবামনের নিকটেই সংবাদ পৌঁছে দিতে হয়। এরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে। এদের পক্ষে দ্রুততর গতিতে বরেন্দ্রী থেকে রাজধানীতে সংবাদ বহন করে আনা সম্ভব। এদের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বের পর পর একটি করে গোপন জায়গাতে সতেজ ঘোড়া রাখা হয়েছে। এরা বরেন্দ্রী থেকে রওনা দিয়ে চলে আসবে প্রথম জায়গাটিতে। এখানে এলেই পাবে বিশ্রামের সুযোগ, খাওয়ার সুযোগ, এবং তাৎক্ষণিকভাবে কান্ত অশ্বের পরিবর্তে অন্য একটি তরতাজা অশ্ব পাওয়ার সুযোগ। কাজেই কান্ত ঘোড়াকে বিশ্রাম দেবার জন্য তাকে সেখানে একটি রাত্রি বা একটি বেলা অপেকা করতে হচ্ছে না। ফলে অন্য যে কারো চেয়ে অন্তত দুইদিন পূর্বে রাজধানীতে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ তার থাকছে।
কিন্তু এত সুচারু ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক দিন হলো বরেন্দ্রীর কোনো সংবাদ এসে পৌঁছেনি ভট্টবামনের কাছে।
সেই সংবাদ আজ এল। কিন্তু  কোনো খোলের মাধ্যমে আসেনি সংবাদ। এসেছে মন্দিরের সেবায়েত শ্রীবৎসপালস্বামীর মাধ্যমে। অবশ্য শ্রীবৎসপালস্বামীকে এমন বিধ্বস্থ এবং বিস্রস্থ অবস্থায় দেখে মনে হচ্ছে তিনি এখন নিজেই একটি সংবাদ।
ভট্টবামন তাকে জিজ্ঞেস করেনÑ আপনি কবে যাত্রা শুরু করেছেন বরেন্দ্রী থেকে?
মনে মনে করাঙ্গুল গুণে শ্রীবৎসপালস্বামী বলেনÑ এগারো দিবস পূর্বে।
ভ্রƒ কুঁচকে ওঠে ভট্টবামনের*- এত সময় কেন লাগল আপনার রাজধানী পৌঁছাতে?
ওরা আমাকে পদব্রজে আসতে বাধ্য করেছে।
ওরা কারা?
ওরা। মানে কৈবর্ত দস্যুদের দল। ওরা আমাকে দিনের পর দিন হাঁটিয়েছে। আমি তো জোরে হাঁটতে পারি না। আমার হাঁটার অভ্যেস নেই। ঊচ্চবংশের কোন ব্রাক্ষ্মণেরই বা হাঁটার অভ্যেস থাকে! কিন্তু ওরা আমার কোনো কথাই শোনেনি। আমাকে হাঁটতে বাধ্য করেছে এত দিনের পথ। হাঁটতে অস্বীকার করার সাথে সাথে শারীরিক প্রহারের ভীতি প্রদর্শন করেছে। কখনো কখনা...
আর বলতে পারেন না শ্রীবৎসপালস্বামী। বিগত দিনগুলোর অত্যাচার, অবমাননা এবং লাঞ্ছনার কথা মনে আসায় কেঁদে ফেলেন হুঁ হুঁ করে। কিছুণ কাঁদার পরে ফুলে ফুলে বলতে থাকেন শ্রীবৎসপালস্বামীÑ মহান পালসাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভ শ্রীযুক্ত ভট্টবামনের আত্মীয় হয়েও, উচ্চ দ্বিজবংশজাত হয়েও, শত শত যজমানের কুলগুরু হয়েও আমাকে, এই আচার্য বৎসপালস্বামীকে, এইভাবে লাঞ্ছিত হতে হলো... আবার কেঁদে ফেলেন তিনি।
সান্ত্বনা জানানোর জন্য শ্রীবৎসপালস্বামীর বাহু আলতোভাবে স্পর্শ করলেন ভট্টবামন। এই স্পর্শ পরম শক্তিমান এক সহায়কের স্পর্শ। এই রকম স্পর্শ জানিয়ে দেয়, আপনি এখন যার সম্মুখে আছেন, তিনি আপনাকে সকল প্রকারের নিরাপত্তা প্রদানে সম, এবং তিনি আপনাকে সেই নিরাপত্তা প্রদানের আশ্বাস দিচ্ছেন। এই রকম স্পর্শ জানিয়ে দেয় যে, আপনাকে যে কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিগত দিনগুলি কাটিয়ে আসতে হয়েছে, সেই কষ্টের জন্য আপনার প্রতি সমবেদনা জানানো হচ্ছে, এবং একই সাথে নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে যে একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি আপনার জীবনে আর ঘটবে না। এই স্পর্শ আপনাকে এই নিশ্চয়তাও দিচ্ছে যে, স্পর্শকারী আপনাকে এখনো তার নিজস্ব লোক এবং স্বজন হিসাবেই গণ্য করছেন। ফলে আপনাকে যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে, তার প্রকৃত বিনিময়মূল্য আপনাকে প্রদান করা হবে।
এবার কিছুটা ধাতস্থ হতে পারেন শ্রীবৎসপালস্বামী।
তাকে নিজের সঙ্গে প্রাতরাশের আহ্বান জানান ভট্টবামন।
আহার চলাকালে কোনো বিরূপ প্রসঙ্গ যাতে না ওঠে, সে ব্যাপারে পরিপূর্ণ সতর্ক রইলেন মহামাত্য ভট্টবামন। খাওয়া শেষে আচমনের পরে আবার ফিরে এলেন বরেন্দ্রী প্রসঙ্গে। সেই আঁধার আবার ফিরে আসে শ্রীবৎসপালস্বামীর অবয়বে। কিন্তু এবার আর ভট্টবামন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করেন না। বলেনÑ আপনি এবার সব কথা খুলে বলুন। তিক্ত হলেও বলতে হবে। কারণ সব কথাই আমার জানা প্রয়োজন। সত্যি বলতে, আপনি সেসব জানানোর জন্যই তো এত কষ্ট সহ্য করে এখানে এসেছেন। তাই যা জানেন, সব বলুন আমাকে। প্রথমে একবাক্যে বলুন তো, বরেন্দ্রীর প্রকৃত অবস্থা ঠিক কেমন?
উত্তর দিতে গিয়ে শ্রীবৎসপালস্বামী ইতস্তত করছেন দেখে ভট্টবামন তাকে আশ্বাস দেনÑ দ্বিধা করবেন না। আপনার দৃষ্টিতে প্রকৃত অবস্থা ঠিক যেমনটি বলে মনে হয়েছে, সেটাই বলবেন।
শ্রীবৎসপালস্বামী দীর্ঘশ্বান মোচন করেনÑ কী আর বলব মহামাত্য! এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়, বরেন্দ্রী যেন পাল সাম্রাজ্যের অংশই নয়। মহারাজাধিরাজ মহীপাল কিংবা আপনার কোনো প্রাধান্যই সেখানে বর্তমান নেই। বরেন্দ্রী পুরোপুরি পরিচালিত হয় সেখানকার প্রাদেশিক অমাত্য দিব্যোকের অঙ্গুলি-ইঙ্গিতে। সেখানে দিব্যোকের কথার ওপরে কোনো কথা চলে না। সেখানে আবার ফিরে এসেছে অসুর-শাসন।
মাথা ঝাঁকান ভট্টবামন। তার নিজেরও এমনটাই ধারণা। কিন্তু মহারাজ মহীপালকে কিছুতেই সম্মত করানো যাচ্ছে না দিব্যোকের বিরুদ্ধে কোনো কড়া পদপে গ্রহণে। মনে মনে ছক কষে ফেলেন ভট্টবামন। শ্রীবৎসপালস্বামীকে উপস্থিত করতে হবে মহারাজ মহীপালের সামনে। একজন প্রত্যদর্শী এবং প্রত্য ভুক্তভোগীর বক্তব্য শোনার পরে হয়তো মহারাজকে দিব্যোকের বিরুদ্ধে পদপে গ্রহণে সম্মত করানো সম্ভব হলেও হতে পারে। শুধু একবার মহারাজের অনুমতি পাওয়া গেলেই হলো! ভট্টবামনের মুখের মধ্যে দন্তসকল একে অপরের সাথে ঘর্ষণে বজ্র উৎপাদন করে ফেলে প্রায়Ñ একবার অনুমতি পেলে পালসৈন্যদের তিনি লেলিয়ে দেবেন বরেন্দ্রীর ওপর। স্বয়ং কীর্তিবর্মাকে পাঠাবেন সৈন্য পরিচালনার জন্য। তাকে জানিয়ে দেবেন, বরেন্দ্রীতে তিনি কোনো কৈবর্তকে জীবন্ত দেখতে চান না। তিনি চান, বরেন্দ্রীতে কোনো এককালে কৈবর্তরা বসবাস করত, সেকথাও যেন ভুলে যায় লোকে। ভট্টবামন মনের কথা কারো কাছে তো কখনো প্রকাশ করেন না। শ্রীবৎসপালস্বামীর কাছেও গোপনই রাখলেন। শুধু বললেনÑ আমি চেষ্টা করব আপনি যাতে মহারাজের সম্মুখে আপনার এই কষ্ট এবং লাঞ্ছনা ভোগের কথা নিজের মুখে তুলে ধরতে পারেন। তবে আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আপনি পুনরায় বরেন্দ্রীতে ফিরে যাবেন সসম্মানে। সেখানে প্রতিশ্র“ত মহামন্দির প্রতিষ্ঠিত হবেই। এবং সেই মন্দিরের সেবায়েত হিসাবে সেই অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হবেন আপনিই!
ভট্টবামনের প্রতিশ্র“তি শ্রীবৎসপালস্বামীকে ঠিক কতখানি প্রভাবিত করেছে, তা তার মুখ দেখে বোঝা যায় না। তিনি বোঝেন যে তাকে এখন প্রস্থান করার ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। এবার উঠে দাঁড়ান তিনি। বলেনÑ মহামান্য মহামাত্য, আপনার জন্য আমার মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠিয়েছে দিব্যোক।
তাই নাকি? ব্যগ্র মনে হয় ভট্টবামনকে- কী সেই বার্তা?
বলা ঠিক হবে কি না একমুহূর্ত ভাবলেন শ্রীবৎসপালস্বামী। তারপরে মনে হলো এখন তো পিছিয়ে আসার সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তীè তীরকে ইতোমধ্যেই ধনুকের জ্যা-মুক্ত করা হয়ে গেছে। শ্রীবৎসপালস্বামী যান্ত্রিক কণ্ঠে বলে চললেনÑ দিব্যোক বলেছে, আপনি যেন মহারানীদের এই বলে অনুরোধ করেন, তারা যেন... তারা যেন...
ভুঁরু কোঁচকান ভট্টবামনÑ তারা যেন?
একবার ঢোক গিলতে হয়। তারপর গড়গড় করে বলে চলেন শ্রীবৎসপালস্বামীÑ মাতৃস্বরূপা মহারানীরা যেন বরেন্দ্রীতে শিবমন্দির, বিষ্ণুমন্দির, বা যে কোনো মন্দির প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন একটু কম করে দেখেন! এত ঘন ঘন স্বপ্ন দেখলে তার কৈবর্ত-সন্তানরা মহাবিপদে পড়ে যাবে। তারা বাস্তুহারা হয়ে পড়বে।
লাফিয়ে ওঠেন ভট্টবামনÑ এই বার্তা পাঠিয়েছে অনার্য পশুটি! এতবড় দুঃসাহস তার!
পরণেই তার মনে হয়, মহারাজকে এবার দিব্যোকের সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে! মহারাজের মহিষীদের সম্পর্কে এমন কটা করে বার্তা পাঠিয়েছে দিব্যোক। এবার আর সে মা পাবে না মহারাজের। তিনি ব্যগ্র ভঙ্গিতে হাত পাতেনÑ কই? কোথায় সেই বার্তা?
এই যে বললাম!
আহা তা তো বললেনই। কিন্তু সেই লিখিত বার্তাটি তো আমাকে দেবেন!
কোনো লিখিত বার্তা তো নেই!
লিখিত বার্তা নেই? তাহলে কীভাবে আমি প্রমাণ করব যে ওটি দিব্যোকেরই প্রেরিত বার্তা?
তা তো আমি জানি না। হতভম্ব দেখায় শ্রীবৎসপালস্বামীকে।
ভট্টবামন কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে কড়া চাহনি নিক্ষেপ করলেন শ্রীবৎসপালস্বামীর দিকেÑ আপনি দিব্যোককে বলতে পারলেন না তার বার্তাটি ভূর্জপত্রে লিখে দিতে?
বলেছিলাম তো। কিন্তু দিব্যোক বলল, আমরা কৈবর্তরা তো লিখতে-পড়তে জানি না। আমাদের মুখের কথাই সব। কথাটি বলবেন মহামাত্যকে। শুধু এই কারণেই আপনাকে আপনাকে প্রাণ নিয়ে রাজধানীতে ফিরে যেতে দিচ্ছে কৈবর্তরা।
ক্রোধে ভয়ংকর হয়ে ওঠে ভট্টবামনের মুখাবয়ব। বুদ্ধির খেলাতে তাকে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানিয়েছে দিব্যোক!

২০. প্রত্যাঘাতের সূত্রপাত
ঠিক পাঁচদিন পরে মহারাজের নামাঙ্কিত একটি নির্দেশপত্র নিয়ে একটি রাজকীয় অশ্বারোহী দল এসে পৌঁছে দিব্যোকের কার্যালয়ে। নির্দেশে বলা হয়েছে-পরমসৌগত মহারাজাধিরাজ মহীপালের নির্দেশ বরেন্দ্র্রী ভূক্তির প্রাদেশিক অমাত্য দিব্যোকের প্রতি:-
“আপনাকে জানানো যাচ্ছে যে বরেন্দ্রীর জনজীবনে অস্থিরতার ভাব পরিলতি হচ্ছে। সেখানে রাজকীয় কর্তব্য পালনে কিছু কিছু কর্মচারির অনীহা পরিলতি হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো রাজাদেশ সরাসরি অমান্য করা হচ্ছে। এমন কিছু ঘটনা খুবই নিকট অতীতে বরেন্দ্রীতে ঘটে গেছে, যেসব নিয়ে সাম্রাজ্যের রক হিসাবে মহারাজাধিরাজ নিজেই চিন্তিত। মহারাজাধিরাজ মনে করছেন যে প্রাদেশিক অমাত্য হিসাবে আপনি দায়িত্ব পালনে যথেষ্ঠ শৈথিল্যের পরিচয় দিয়েছেন। সেই কারণে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাস্য রয়ে গেছে। যদি এই সমস্ত জিজ্ঞাস্যের সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করতে পারেন, তাহলে আপনাকে আপনার পদে বহাল রাখা হবে।
আপনাকে তাই মহারাজ সমীপে রাজধানীতে আগমনের জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। এই পত্রনির্দেশ পাওয়ামাত্র আপনার নিযুক্তক(পরবর্তী পদাধিকারী)-এর নিকট বরেন্দ্রীর শাসনভার অর্পণ করে পত্রবাহক অশ্বারোহী দলের সঙ্গেই রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন। অধিক বিলম্ব আপনার যোগ্যতার পরিপন্থি বলে গণ্য হবে। ”

পত্র পাঠ শেষে দিব্যোকের মুখের হাসি অতই রয়েছে। রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর সদস্যদের বিশ্রামের উপযুক্ত ব্যবস্থা করার জন্য তার ছোট ভাই রুদোককে বলা হলো। অশ্বারোহী দলটির প্রধান নিজের ব্যগ্রতা লুকিয়ে বিনয়ের সঙ্গে জানতে চায়Ñ আমরা কখন যাত্রা শুরু করব মাননীয় প্রাদেশিক অমাত্য?
মৃদু হাসি খেলে যায় দিব্যোকের ঠোঁটেÑ সবে তো এলেন। একটু বিশ্রাম নিন। আপনাদের মতো অতিথির সেবা করার সুযোগ আমাদের দিন। আপনাদের শ্রান্তি অপনোদন হলে এ বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রাখি।
আবার রুদোকের দিকে ফিরে বলে- এঁদের আতিথ্যে যেন কোনো ত্র“টি না হয়! সবকিছু যাতে নিখুঁত হয়, প্রয়োজনে তুমি নিজে তার সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধান করবে। বুঝতে পেরেছ আমার কথা?
রুদোক মাথা ঝাঁকায়। সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে।
অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যায় রুদোক। তাদের চলে যাওয়া দেখে দিব্যোক। তার মুখে আবার ফিরে আসে সেই হাসি।

এই অশ্বারোহী দলের আসার কথা পূর্বাহ্নেই জেনেছে দিব্যোক। রাজধানী থেকে দিব্যোকের খোলের মাধ্যমে এই তথ্য তাকে জানিয়ে দিয়েছে বন্ধু পদ্মনাভ। জানিয়েছে যে, মহারাজ মহীপালের নামাঙ্কিত চিঠি গেলেও এ ব্যাপারে বিন্দু-বিসর্গও জানেন না মহারাজ। এটি ভট্টবামন এবং কীর্তিবর্মার পরিকল্পিত বার্তা। যারা এই বার্তা নিয়ে যাচ্ছে, তারা কীর্তিবর্মার প্রশিতি গুপ্তঘাতক। এদের সাথে পথে বেরুলে দিব্যোক কোনোদিনই সশরীরে রাজধানীতে পৌঁছাতে পারবে না। পথিমধ্যেই কোনো সুবিধাজনক স্থানে তাকে হত্যা করবে এই পেশাদার খুনীর দল। ভট্টবামন জানেন যে, দিব্যোককে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে কৈবর্তদের মুক্তি কমপে আরো একশত বৎসর পিছিয়ে যাবে। কৈবর্ত-পুলিন্দা-শবর-কোচ-ভিল-রাজবংশীসহ বরেন্দির মৃত্তিকা-সন্তানরা আর কোনোদিনই হয়তো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ভট্টবামন এবং তার সঙ্গীরা এখন তাই যে কোনো মূল্যে পৃথিবী থেকে দিব্যোক নামক আপদটিকে অপসারণ করার জন্য বদ্ধপরিকর। তাদের বর্তমান পরিকল্পনা যদি সার্থক না-ও হয়, তাহলেও তারা নিজেদের উদ্দেশ্য থেকে বিন্দুমাত্র পিছিয়ে আসবে না। প্রয়োজনে তারা মহারাজকে বাধ্য করবে বরেন্দিতে বড় ধরনের সেনা অভিযান চালিয়ে দিব্যোক এবং তার সঙ্গীদের নিশ্চিহ্ন করতে। পদ্মনাভ বার বার জোর দিয়ে জানিয়েছে, প্রেরিত ঘাতক দলের কোনো সদস্যই যেন রাজধানীতে ফিরে আসতে না পারে। তাদেরকে নিরস্ত্র এবং বন্দি করে রাখতে হবে। সেইসঙ্গে অন্য কোনো বার্তাবাহকের মাধ্যমে রাজধানীতে ভট্টবামনের কাছে সংবাদ পাঠাতে হবে এই মর্মে যে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা পার্বণের কারণে দিব্যোকের পে এই মুহূর্তে বরেন্দি ছেড়ে আসা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তবে এই কাজ বা পার্বণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে দিব্যোক রাজধানীতে উপনীত হবে। আজ হোক আর কাল হোক, ভট্টবামন ঠিকই বুঝে ফেলবে কী ঘটেছে। তবু এর ফলে হাতে কিছুটা বাড়তি সময় পাওয়া যাবে, যা নিজেদের প্রস্তুতির জন্য কাজে লাগবে।
পদ্মনাভের কথা ভাবলে সত্যিই অভিভূত হতে হয় দিব্যোককে। সত্যিকারের একজন মানুষের মতো মানুষ। যে ন্যায়ের জন্য নিজের স্বজাতির বিরুদ্ধাচরণেও পিছ-পা হতে স্বীকৃত নয়। বরং সে বলে যে এই মাটিকে যারা নিজের জন্মভূমি বলে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, কেবলমাত্র তারাই তার স্বজাতি। কত শত বৎসর আগে তার পূর্বপুরুষ আর্যাবর্ত থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিল গৌড়-পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর মাটিতে। তাদের সবার নিঃশ্বাসবায়ু একীভূত হয়ে গেছে এই মাটির আদি সন্তানদের নিঃশ্বাসের সাথে। তাই তারাই তার আত্মার আত্মীয়। যারা এই মাটিতে শত শত বৎসর ধরে বসবাস করেও এই মাটিকে নিজের দেশ বলে মনে করে না, যারা মনে করে যে তারা এই ভূখণ্ডের শাসকমাত্র, যারা নিজেদের দেববংশজাত হিসাবে দাবি করে এই মাটির সন্তানদের অসুর বলে এখনো ঘৃণা করে, যারা মনে করে এই মৃত্তিকার আদি সন্তানদের জন্ম হয়েছে শুধুমাত্র তাদের সেবা করার জন্য, তাদের প্রতি ধিক্কার প্রকাশে পদ্মনাভ অকুণ্ঠ। বরেন্দির ল ল আদিবাসীর মতো সে-ও দিব্যোককে এই যুগের পরিত্রাতা বলে মনে করে। তাই যে কোনো প্রকারেই হোক না কেন, দিব্যোককে সহযোগিতা করতে পদ্মনাভ সবসময়ই সম্মত।
বন্ধু পদ্মনাভের উদ্দেশ্যে মনে মনে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করে দিব্যোক। তারপর মনে হয়, ভট্টবামনের কাছে তো একটি বার্তা প্রেরণ করতে হবে। কী অজুহাত দাঁড় করানো যায়, ভাবতে গিয়ে তার মনে পড়ে কয়েকদিন বাদেই তো বরেন্দির মানুষের প্রিয় তিষ্যা পরব। দুইজন বিশ্বস্ত বার্তাবাহককে ডেকে পাঠায় দিব্যোক। মহারাজ মহীপালের বরাবরে একটি বার্তা প্রেরণ করে। মহারাজের আদেশ দিব্যোকের শিরোধার্য। তিষ্যা পরব অতিক্রান্ত হওয়ামাত্রই সে রাজধানীতে উপনীত হবে মহারাজ সমীপে। আর যে অশ্বারোহী দলকে মহারাজ পাঠিয়েছেন তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তারাও বরেন্দির তিষ্যা পরব দেখার এই দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। বিধায় অন্য বাহকের মাধ্যমে এই বার্তা পাঠাতে হচ্ছে।
দিব্যোক জানে, এই বার্তা মহারাজের কাছে পৌঁছুবে না। কিন্তু যেখানে পৌঁছানো প্রয়োজন, সেখানে ঠিকই পৌঁছাবে। তার মন বলছে, আর বেশি বিলম্ব নেই। কৈবর্তদের অচিরেই দাঁড়াতে হবে ভট্টবামনচক্রের মুখোমুখি। দুই চোখ বন্ধ করে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রণতি জানায় দিব্যোক। মনে মনে বলেÑ আশীর্বাদ করো পিতা! পিতামহ-প্রপিতামহ আশীর্বাদ করো! তোমাদের বরেন্দিকে আমি যেন তোমাদের সন্তানদের হাতে ফিরিয়ে দিতে পারি!
হঠাৎ ধুলো-ওড়ানো একটা দমকা বাতাস আছড়ে পড়ে ঘরের দরজা-জানালাগুলিতে। বরেন্দি একাত্মতা ঘোষণা করছে কী!

২১. মল্লর বিদায়
কত ত্যাগেরই না প্রয়োজন হয় একটা বড় কাজের জন্য! মল্ল নাহয় নিজের মাটির জন্য, স্বজাতির জন্য আত্মত্যাগের পথে নেমেছে। কিন্তু ঊর্ণাবতী? সে কেন নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে এই কাজের সঙ্গে? সে কি শুধু মল্লর প্রতি ভালোবাসার কারণে? হায় রে ভালোবাসা! বিনিময়ে কতটুকু ভালোবাসা পাবে বা পায় তার বিন্দুমাত্র পরিমাপও করতে বসেনি ঊর্ণাবতী। করলে সে দেখতে পেত যে তার দেবার পালা এত ভারি যে প্রাপ্তিকে চোখে প্রায় দেখাই যায় না। প্রাপ্তির হিসাব না করে একপাকিভাবে দান করে চলেছে ঊর্ণাবতী। মল্ল বা পপীপ কোনোদিন কি পারবে তার মহত্বময় ভালোবাসার প্রতিদান দিতে? ভাবতে গিয়ে চোখে জল চলে আসে মল্লর।

ঊর্ণাবতী স্নান করতে গিয়েছিল। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ অবয়ব এবং পুত-পবিত্র একটা শীতল অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে স্নানাগার থেকে। মনটাও আনন্দময়। কিন্তু বেরিয়ে এসে মল্লর দিকে চোখ পড়ামাত্র থমকে দাঁড়ায়। ঠোঁট থেকে মুহূর্তে উধাও হয়ে আনন্দের হাসি। ছুটে এসে দাঁড়ায় মল্লর পাশে। সমস্ত অবয়ব জুড়ে উদ্বেগÑ কী হয়েছে মল্ল? তোমার চোখে জল! বলো মল্ল কী হয়েছে তোমার? আমি কি কোনোভাবে তোমাকে আঘাত দিয়েছি?
তার দিকে তাকিয়ে চোখে জল নিয়েই হাসে মল্ল। ধরা গলায় বলেÑ এই জল কৃতজ্ঞতার অশ্র“জল ঊর্ণাবতী। এই জল ভালোবাসার। ভালোবাসা পাওয়ার। আমি... পপীপ... কৈবর্তজাতি কীভাবে তোমার ঋণ পরিশোধ করবে ঊর্ণাবতী!
ও এই কথা! বুকের পাষাণভার নেমে যাওয়ার স্বস্তি নিয়ে বলে ঊর্ণাবতীÑ ভালোবাসতে শেখায় যে মানুষ, সেই মল্লর মুখে এ কী ধরনের কথা! ভালোবাসার মানুষের কাছে কেউ কি কোনোদিন ঋণী হয়ে থাকে? প্রেমিক-প্রেমিকা কি কখনো অংক কষে পরস্পরের জন্য কোনো কাজ করে? তারা যা-ই করে, ভালোবাসাই তো সেটা করিয়ে নেয়। আর ঋণের কথাই যদি বলো, তাহলে তোমার ঋণ কি আমি সারাজীবনেও পরিশোধ করতে পারব? এই নোংরা জীবন তো কবেই চিতার আগুনে জ্বলে শেষ হয়ে যেত, আমি তো নিজের হাতেই এই নোংরা জীবনের পরিসমাপ্তি টেনে দিতাম যদি তোমার ভালোবাসা না পেতাম। এই জীবন তো প্রকৃতপে তোমারই প্রদত্ত উপহার মল্ল! এই জীবনকে যেভাবে খুশি ব্যবহার করার পূর্ণ অধিকার তো একমাত্র তোমারই রয়েছে।
তবু পপীপের জন্য তুমি যা করলে!
ঠোঁট ফোলায় ঊর্ণাবতীÑ আমি পপীপের জন্য কিচ্ছু করিনি। যা করেছি তোমার জন্য করেছি। আর তোমার জন্য আমি যা-ই করি না কেন, তার কোনো গাণিতিক নির্ঘণ্ট করে রাখতে সম্মত নই। তুমি নিজে তেমন কোনো কিছু করবে, সেটিও হতে দেব না আমি। কিছুতেই না! কোনোদিনই না! তবে যদি প্রতিদান কিছু দিতে চাও, তাহলে আমাকে কী দিতে হবে তা তো তুমি জানোই!
কী দিতে হবে?
আহা ন্যাকা! কিছুই জানে না! অপূর্ব ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ করে ঊর্ণাবতী।
মল্ল তবু জানতে চায়Ñ আহা বলোই না কী দিতে হবে!
উত্তরে ছুটে এসে মল্লর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঊর্ণাবতী। বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলেÑ তোমাকে আরো ঘন ঘন আসতে হবে আমার কাছে। আরো বেশিদিন ধরে থাকতে হবে আমার কাছে।
যদি চিরদিনই থেকে যাই তোমার কাছে! তরল কণ্ঠে বলে মল্ল।
মুখটা ম্লান হয়ে যায় ঊর্ণাবতীরÑ সে কপাল কী আর আমার কোনোদিন হবে!
অবশ্যই হবে! খুব দৃঢ়তার সাথে বলে মল্ল যদি বরেন্দিকে মুক্ত করতে পারি, তাহলে আমি তোমাকে অবশ্যই নিয়ে যাব ঊর্ণাবতী। চিরদিনের জন্য নিয়ে যাব। বিশ্বাস করো আমার কথা!
তোমাকে বিশ্বাস করব না তো কার কথা বিশ্বাস করব!
এবার একটু পপীপকে ডেকে দাও। ওকে কয়েকটি কথা বলে আমি চলে যাব।
আজকেই?
হ্যাঁ ঊর্ণাবতী। তোমাকে তো বলেছি, দিব্যোক আমাকে যত তাড়াতড়ি সম্ভব বরেন্দিতে যেতে বলেছে। পপীপের একটা ব্যবস্থা না করে যেতে পারছিলাম না। এখন তো পপীপের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা করে দিয়েছ তুমি। এবার আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারব। বরেন্দিকে মুক্ত করার যুদ্ধে। তোমাকে মুক্ত করার যুদ্ধে।

পপীপকে সঙ্গে নিয়ে ঊর্ণাবতীর কোষ্ঠকের(কোঠাঘর) পেছনের উদ্যানে আসে মল্ল। এদিকে এমনিতেই কোনো লোক সচরাচর আসে না। আর মল্ল এলে তো ঊর্ণাবতী তার সহচরীদের নিয়ে এমন নিপুণভাবে সবদিকে দৃষ্টি রাখে যে মল্লকে বিন্দুমাত্র নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় না। সে পুরো বাড়ি এবং আঙিনা জুড়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে। তদুপরি এখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। আঙিনায় কেউ দাঁড়ালে কেউ বাইরে থেকে দেখতে পাবে না। ঊর্ণাবতীর সহচরী এসে আসন বিছিয়ে দিয়ে গেল ঘাসের ওপর। কিন্তু বসে না মল্ল। পপীপকে সঙ্গে নিয়ে পায়চারি করে আঙিনা জুড়ে। মনে মনে গুছিয়ে নেয় বলার কথাগুলো। শুরু করে মৃদুস্বরেÑ পপীপ!
কাকা!
আমি এখন যেসব কথা তোকে বলব, সব কথা তুই বুঝতে পারবি না রে বাপ্। তার দরকারও নাই। তোর মাথা এখনো ছোট্ট। সব কথা তুই মনেও রাখতে পারবি না। মনে রাখারও দরকার নাই বাপ্। যখন দরকার হবে, দেখবি ঠিক ঠিক মনে চলে আসছে কথাগুলো। যখন সময় হবে, দেখবি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিস কথাগুলো। বুঝতে পারছিস বটি?
হ্যাঁ কাকা।
হুঁ, এবার তবে একটা প্রশ্নের উত্তর দে দেখি! বল দেখি তুই কেনে মায়ের কোল ছেড়ে এই বিভুঁইতে পড়ে আছিস? আর তোর বাপই বা কেনে নিজের মাটি ছেড়ে এই রামশর্মার মাটিতে খেটে মরতে এসেছে জনমভর?
কেনে কাকা?
কারণ আসলে একটা লয় বাপ। কিন্তু মূল কারণ কিন্তু একটা। একটাই! সেটা হলো মোদের বরেন্দি আর মোদের লিজেদের বরেন্দি নাই। বুঝতে পারছিস?
হ্যাঁ কাকা।
আবার উচ্চারণ করে মল্লÑ মোদের বরেন্দি আর মোদের লিজেদের নাই রে সোনা! তাই কৈবর্তের ঘরে ঘরে এত দুঃখ। তাই কৈবর্তের জনম হয়ে গেছে দুঃখের জনম।
কিছুণ চুপ করে থাকে মল্ল। পপীপ এই সময় হঠাৎ আকুল হয়ে বলে ওঠে- আমি মায়ের কাছে যাব কাকা!
অবশ্যই যাবি বাবা! আমি তোকে তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাব। যে কয়দিন যেতে পারছিস না, সেই দিনগুলির জন্যে তোকে তো আরেকটা মা দিয়ে গেলাম। ঊর্ণা মা। ঠিক কি না বল্? ঊর্ণাবতীকে তোর মায়ের মতো লাগে না?
লাগে কাকা। ঊর্ণা মা তো খুবই ভালো।
হ্যাঁ। মনে রাখিস ঊর্ণাবতীও তোর মা। একদিন লিজের মায়ের মতোন এই মায়ের ঋণও তোকে শোধ করতে হবে।
ঋণ শব্দটা শোনামাত্র ভয়ে কুঁকড়ে যায় পপীপ। বলেÑ আমাকেও কি আবার বিক্রি করে দেবে কাকা?
মল্ল অবাকÑ কে বিক্রি করবে? কেন বিক্রি করবে?
এই যে তুমি বললে ঋণের কথা! বাবা ঋণ নিয়েঠিল বলেই তো বাবা বিক্রি হলো, আমি বিক্রি হলাম।
এবার হো হো করে হেসে ওঠে মল্ল- এই ঋণ সেই ঋণ নয় রে পপীপ। এ হলো ভালোবাসার ঋণ। এটি শোধ করতে হয় আরো ভালোবাসা দিয়ে। ঊর্ণাবতী তোকে যত ভালোবাসা দিয়েছে, তুই তার চেয়ে বেশি ভালেবাসা দিকি তাকে। তাহলেই শোধ হবে তোর ঋণ। বুঝতে পারলি?
মুখ দেখে বোঝা যায় পুরোপুরি বুঝতে পারেনি পপীপ। কিন্তু মাথা ঝাঁকিয়ে বলে- হ্যাঁ কাকা।
মল্ল আবার বরেন্দির কথায় ফেরে- যে কথা বলছিলাম। মোদের সকল দুঃখের কারণ হচ্ছে
বরেন্দি আর মোদের বরেন্দি লয়। মল্লর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে পপীপ।
ঠিক বলেছিস! মল্ল সপ্রশংস দৃষ্টিতে একবার তাকায় পপীপের দিকে। বলে- এবার আমরা ঠিক করেছি, বরেন্দিকে ফের লিজেদের বরেন্দি বানাব। মোদের বরেন্দিকে আমরা আবার ফিরে নেব।
কিন্তু তার জন্য অনেক কষ্ট করতে হবে পপীপ। তোকে কষ্ট করতে হবে, আমাকে কষ্ট করতে হবেÑ সবাইকে কষ্ট করতে হবে। আর বলি দিতে হবে। অনেক বলি দিতে হবে। রক্তের বলি। বরেন্দি মায়ের অনেক অপমান হয়েছে। সেই অপমান মুছে ফেলতে হবে মোদের রক্তের বলি দিয়ে। বলির কথা শুনে ভয় পাচ্ছিস পপীপ?
না কাকা!
তাহলে শোন! বরেন্দি মা তোকে বেছে লিয়েছে খুব বড় একটা কর্মের জন্য।
কী কর্ম?
যে কর্মের জন্য ঊর্ণাবতী লিজের মূল্যে তোকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে এখানে এনেছে। আমি তোকে যে কর্মের জন্য রেখে যাচ্ছি ঊর্ণাবতীর কাছে।
পড়া শিখা?
হ্যাঁ পড়া শিখা। এই অরের মধ্যেই রয়ে গেছে সাদা চামড়ার দস্যুদের সমস্ত শক্তির প্রাণভোমড়া। তোর কাজ হবে সেই প্রাণভোমড়ার কুল-ঠিকানা খুঁজে বের করা। আবার সেই শক্তি কীভাবে কৈবর্তদের পে ব্যবহার করা যায়, সেই পথও খুঁজে বের করতে হবে।
একটু বিভ্রান্ত দেখায় পপীপকেÑ কীভাবে আমি পারব কাকা? কীভাবে পারব?
আশ্বস্ত করার হাসি মল্লর মুখেÑ ঐ যে বললাম। সময় হলে সব বুঝতে পারবি। এখন তোর একমাত্র কাজ হচ্ছে ঊর্ণাবতীর কাছে পড়া শিখা। যত পুঁথি আছে ঊর্ণাবতীর কাছে, সব সে তোকে পড়াবে, কণ্ঠস্থ করাবে। সেগুলো পড়া শেষ হলে মন্দির আর পুরোহিতদের কাছ থেকে এনে দেবে আরো অনেক শাস্ত্রগ্রন্থ। সব তোকে কণ্ঠস্থ করতে হবে পপীপ। আর লিখতেও শিখতে হবে তোকে। কৈবর্তরা লিখতে পারে না বলে তাদের পূর্বপুরুষের অনেক জ্ঞান হারিয়ে গেছে। আর আমরা আমাদের কোনো জ্ঞান-সম্পদ হারাতে চাই না।
কীভাবে আমি এত কাজ করব কাকা!
এখন তোর পড়া আর লেখা শিখার কাজ। সেই কাজ করতে থাক মন দিয়ে। বাকি কাজের সময় ওলান ঠাকুর তোকে পথ দেখাবে। বরেন্দি মা তোর পূজা নিলে কোনো কর্মই আর অসম্ভব থাকবে না। মনে রাখিস কথাগুলো। এবার আমি আসি পপীপ!
পপীপ বুভুুর মতো আবার বলে ওঠে- মায়ের কাছে যাব কাকা!
রহস্যময় হাসি মল্লর ঠোঁটেÑ মায়ের কাছে তুই লিজেই যেতে পারবি পপীপ। আরো কত শত জনকে তুই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবি তাদের মায়ের কাছে। তখন দেখিস!
অন্ধকারে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় মল্লর সুঠাম দেহটা। কিন্তু তার উচ্চারণ করা শব্দগুলি বাজতে থাকে পপীপের কানে। বাজতেই থাকে।                       

২২. রাজায় রাজায়...
মহারাজ মহীপালের আবাল্য অভ্যাস প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই একপাত্র পানা(শরবত) খাওয়া। বিভিন্ন মৌসুমে এই পানার প্রকারভেদ হয়। কোনো মৌসুমে চোচ-পানা(ডাবের জল), কখনো মোচ-পানা(একরকম ফলের রস), কখনো কুলক-পানা(কাঁকুড়ের শরবত), কখনো খর্জুর-পানা(খেজুরের রস), কখনো পরসুক-পানা(দ্রাক্ষারস)। তাঁর অন্তরঙ্গ(ব্যক্তিগত চিকিৎসক) ভানু দত্ত দাবি করেন যে এই পানা পানের কারণেই মহারাজ কোষ্ঠ্যকাঠিণ্য থেকে চিরমুক্ত। আর সেই কারণেই যাবতীয় রাজকীয় কর্মকাণ্ডে তিনি পরিপূর্ণ মনোযোগ নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
ভানু দত্তের দাবিকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে না। কারণ তিনি ভূ-ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈদ্য চক্রপাণি দত্তের সহোদর ভাই। জনশ্রুতি আছে, চক্রপাণি দত্ত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র যতখানি জানতেন, তার পুরোটাই তিনি দান করেছেন তার অনুজ ভানু দত্তকে। মহারাজ মহীপাল ভানু দত্তের উপদেশ মেনে চলেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। কখনো কখনো মহারাজ পরিহাসছলে বলেনÑ আমি আমার কীসের রাজা! প্রকৃত রাজা তো আমার অন্তরঙ্গ ভানু দত্ত। পাল সাম্রাজ্য পরিচালিত হয় আমার নির্দেশে। কিন্তু আমি পরিচালিত হই ভানু দত্তের নির্দেশে। তাহলে কে আসলে বড়? নিশ্চয়ই ভানু দত্ত। আমি রাজা হলে ভানু দত্তই রাজাধিরাজ।
মহারাজের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করে দেন ভানু দত্ত। তিনি এই খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করেন তার গুরু ও বড় দাদা চক্রপাণি দত্তের শিার আলোকে। “প্রথমে দুগ্ধ পান করতে হবে। তারপরে ভালো করে সিদ্ধ ঝরঝরে শালি চালের ভাত। তাতে প্রচুর ঘি দিতে হবে। আর প-িমাংসের সহযোগে খেতে হবে। মাংসের পরিবর্তে নির্দোষ বড় মাছ হলেও চলবে। যেমন মাগুর রুই শোল ইত্যাদি। এসব মাছ ভালো ভাবে সিদ্ধ করে খেলে প্রায় মাংসেরই মতো উপকারী।
পানিফল কেশুর কলা তাল নারিকেল ইত্যাদি এবং অন্য যে সব বলকারী মিষ্ট ফল, যেমন কাঁঠাল খুবই ভালো। কেচুক(কচু), ওল(ওল), তালের মেথি, বাতিঙ্গন(বেগুন), পটল, ডাঁটা, মুগ, মসুর, আখের রসÑ এইসব নিরামিষ আনাজ প্রশস্ত। রুচির জন্য অল্প-স্বল্প বাস্তুক(বেথো শাক) খাওয়া যাবে।
দইয়ের সঙ্গে দুধ মিশিয়ে তৈরি দধিকূর্চিকা এবং ঘোলের সঙ্গে ক্ষর মিশিয়ে প্রস্তুত তক্রকূর্চিকা খাওয়া যাবে। তাবে তা আধা বাটির বেশি নয়। ”
মহারাজ এবং তার মহিষীরা ভানু দত্তের সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলেন অরে অরে।
তবে তাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পানা-প্রস্তুতিতে।
মহারাজের জন্য পানা প্রস্তুত করা হয় অতি যতেœ এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। রাত্রি দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে প্রধান রাজকীয় পাচক এই পানা তৈরির কাজে মনোনিবেশ করে। অতি সতর্কতার সাথে বাছাই করা হয় ফল বা ডাব। পানা তৈরি শেষ হওয়ার পরে বারবার ছাঁকুনি দিয়ে ছেঁকে তা থেকে পৃথক করা হয় সূèতম আঁশটিকেও। তারপর পিতলের পানপাত্রে পানা ঢেলে নিয়ে তাকে রাখা হয় ছিদ্রযুক্ত পাথরের কুলুঙ্গিতে। রাত্রির বাকি অংশজুড়ে সেই পাথরের কুলুঙ্গির মধ্য দিয়ে অবিরাম প্রবাহিত করা হয় শীতল জল। প্রভাতে যখন মহারানী নিজহাতে মহারাজকে পরিবেশন করেন পানা, তখন সেই তাম্র-পানপাত্রের গায়ে স্বেদবিন্দুর মতো জমে থাকে স্ফটিকস্বচ্ছ জলের কণা। এই পানপাত্র মহারাজকে যেন দিন শুরুর শুভাশিস জানায়। মনে করিয়ে দেয় মহান পাল সাম্রাজ্যের অধীনে আরো একটি দিন শুরু করতে যাচ্ছে আমাদের এই পৃথিবী। প্রত্যুষের পাখির কাকলির মধ্যে এই পানা পান করতে খুবই পছন্দ করেন মহারাজ মহীপাল।

কিন্তু আজ সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে।
রাত শেষের আগেই মহারাজের সবথেকে বিশ্বস্ত খোল(গুপ্তচর) এসে মহারাজের দর্শন প্রার্থনা করেছে। এই অধিকার কেবলমাত্র তার মতো গুটিকয় ব্যক্তিরই রয়েছে। নিশ্চয়ই সে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় মহারাজের গোচরে আনার জন্য রাত্রিব্যাপী অশ্ব ছুটিয়ে রাজপ্রাসাদে এসে পৌঁছেছে।
সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ! এবং বিপজ্জনকও!
দাণিাত্যের শক্তিমান রাজা রাজেন্দ্র চোল গঙ্গাতীর কুগিত করার জন্য চতুরঙ্গ সৈন্যদল নিয়ে ধেয়ে আসছে পাল সাম্রাজ্যের দিকে। আর হয়তো বড়জোর চারটি দিন। তারপরেই রাজেন্দ্র চোলের পরাক্রান্ত সৈন্যদল পৌঁছে যাবে পাল সাম্রাজ্যের সীমানায় এবং আক্রমণ চালাবে কালবিলম্ব না করে।
অতএব অবিলম্বে সর্বোচ্চ পরিষদের সভা আহ্বান করা হোক!

সংবাদ পাওয়ামাত্র রাজপ্রাসাদে পৌঁছে গেলেন মহামাত্য ভট্টবামন, মহাসান্ধিবিগ্রহিক পদ্মনাভ, এবং মহাপ্রতিহার কীর্তিবর্মা। বোঝা যাচ্ছে তারাও এমন তাৎণিক সভার উদ্যোগের কারণে কিছুটা তটস্থ।
মহারাজ সবার সামনে তাঁর খোলকে ডাকলেন। নির্দেশ দিলেন যে সংবাদ সে বয়ে এনেছে তা সবার সামনে আরেকবার জানাতে।
খোলের মুখে সম্পূর্ণ বিবরণ শুনে যেন মুখ থেকে রক্ত সরে গেল পদ্মনাভের।
মহারাজ প্রথমে পদ্মনাভকেই জিজ্ঞেস করেনÑ তামিল নৃপতি রাজেন্দ্র চোলের সঙ্গে আমাদের মৈত্রীচুক্তি স্বারিত হয়েছিল তাই না?
হ্যাঁ মহারাজ।
কী ছিল সেই চুক্তিতে?
তামিল রাজ্যের চোল-সম্রাটদের সাথে পাল-সম্রাটের প্রথম মৈত্রীচুক্তি স্বারিত হয়েছিল আমাদের মহামহিম দিগ্বিজয়ী রাজ-চক্রবর্তী দেব পালের সময়ে। তখন থেকে এই মৈত্রী অটুট ছিল। প্রতি বছর দুই সাম্রাজ্যের মহারাজ পরস্পরের মধ্যে উপঢৌকনাদি বিনিময় করে থাকেন পারস্পরিক মৈত্রীর স্মারক হিসাবে। এই বৎসরও সেই রকম উপহারাদি বিনিময় হয়েছে। সে বিষয়ে মহারাজ জ্ঞাত রয়েছেন।
তাহলে আজ হঠাৎ রাজেন্দ্র চোল সেই মৈত্রীর পরিবর্তে বৈরিতার পদপে নিচ্ছেন কেন? আপনার কী মনে হয় মহাসান্ধিবিগ্রহিক? হঠাৎ তিনি কেন যুদ্ধে ব্যাপৃত হতে চান?
পদ্মনাভ এদিক-ওদিক মাথা নাড়েনÑ আমার জানা নেই মহারাজ।
মহারাজ বলেনÑ আমি খোলের মুখে শুনেছি যে রাজেন্দ্র চোল এই অভিযান পরিচালিত করছেন গঙ্গাজলের অধিকার দাবি করে। এ সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
পদ্মনাভ বলেনÑ প্রথম মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনের কালে চোল-সম্রাট এই অনুরোধ জানিয়েছিলেন যে তাঁর রাজ্যের প্রায় সকল প্রজা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের নিত্য পূজাকর্মে গঙ্গাজল অপরিহার্য। অথচ তাঁর রাজ্য সীমানায় গঙ্গার কোনো প্রবাহ নাই। সেই কারণে তিনি গৌড়াধিপতিকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এমন একটি ব্যবস্থা করতে যাতে তাঁর রাজ্যের সকল পূজামণ্ডপে গঙ্গাজলের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
মহারাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পদ্মনাভের দিকে। এটুকু শুনে মাথা নাড়লেন। বললেনÑ তারপর?
গৌড়াধিপতি অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে তামিল নৃপতির এই আবেদন বিবেচনা করেছিলেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, দাণিাত্য থেকে গঙ্গানদী পর্যন্ত একটি পথ নির্মাণ করা হবে। সে পথের প্রস্থ এমন হবে যাতে পাশাপাশি দুইটি গো-শকট নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে। দিবারাত্রি চব্বিশ ঘণ্টা তামিল রাজ্যের যে কোনো মানুষ সেই পথে গঙ্গাজল আনা-নেওয়া করতে পারবে। গৌড়াধিপতির কোনো সৈন্য-অমাত্য বা প্রজা এই জল পরিবহনে কোনো বাধা সৃষ্টি করবেন না। তবে পথের সত্ত্ব-সার্বভৌমত্ব থাকবে সম্পূর্ণরূপে গৌড়ের অধীন।
এত সুন্দর একটি ব্যবস্থা সত্ত্বেও কেন রাজেন্দ্র চোল যুদ্ধ করতে আসছেন এই বিষয়টিকে উপল করে?
সকলেই অস্বস্তি বোধ করছেন মহারাজের এই প্রশ্নে। অবশেষে আবার মুখ খুললেন পদ্মনাভইÑ এতদিন এই ব্যবস্থা নির্বিঘেœ প্রতিপালিত হচ্ছিল। কিন্তু গত ছয় মাসাধিক কাল ধরে একটি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
কী সেই জটিলতা?
এতদিন এই পথে জল পরিবহনের জন্য কোনো শুল্ক দিতে হতো না তামিলবাসীদের। কিন্তু ছয় মাস হলো প্রতি গো-শকটের জন্য এক কার্ষাপণ করে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই আজ তামিল-ভূপতি ক্রোধান্বিত হয়ে সমরসজ্জায় ব্যাপৃত হয়েছেন বলে আমি ধারণা করছি।
আশ্চর্য! মহারাজ রুষ্টকণ্ঠে বললেনÑ এমন একটি ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হলো অথচ আমি কিছুই জানলাম না! আমাকে না জানিয়ে কে এই ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছে?  
কে পরিপূর্ণ স্তব্ধতা নেমে এল। কেউ উত্তরটা দিতে চাইছেন না। শেষ পর্যন্ত ভট্টবামন বললেনÑ এই শুল্ক আরোপ করেছেন গঙ্গাতীরস্থ তিন সামন্তরাজ্যের শাসক। তারা তাদের রাজকোষের আয় বৃদ্ধির জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
মহারাজ সক্রোধে স্বভাববিরুদ্ধ উচ্চকণ্ঠে বলে উঠলেনÑ কিন্তু সেটি আমাকে জানানো হলো না কেন? অন্য একটি সাম্রাজ্যের সাথে কোনো সন্ধিচুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করার আগে যে মহারাজের অনুমতি নিতে হবে, সেই রাজকীয় রীতির কথা কি ভুলে গেছে আমাদের সামন্তরাজরা? তারা কেন আমাকে বা সর্বোচ্চ পর্ষদকে জানায় নি? এত দুঃসাহস তারা কোত্থেকে পেল!
ভট্টবামন মৃদুকণ্ঠে বলেন- আমাকে জানিয়েছিলেন তারা।
মহীপাল আশ্চর্য হয়ে গেছেনÑ আপনাকে জানিয়েছেন তারা, অথচ আপনি আমাকে জানাননি! আপনি নিজেই তাদের এই কাজের অনুমোদন দিয়ে দিয়েছেন!

ভট্টবামনের চেহারা টকটকে লাল হয়ে গেছে। তার কপালে ঘাম। মৃদু মৃদু কাঁপছেও শরীরটা।
তার অবস্থা দেখে মহীপাল সামলে নেন নিজেকে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলেনÑ আপনি যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন তার পেছনে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রনৈতিক কোনো গূঢ় উদ্দেশ্য রয়েছে। আপনি জেনে-বুঝে  কোনো  ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন এমনটি আমি মনে করি না। শুধু যদি জানাতেন যে আপনার এই সিদ্ধান্ত প্রদানের পেছনে যুক্তিটা কী ছিল!

আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলেন ভট্টবামন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু না বলেই থেমে গেলেন।
মহীপাল নাছোড়Ñ বলুন মহামন্ত্রী! আমরা সবাই শুনতে চাই। তাতে আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক জ্ঞান অন্তত কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে।
আমি মনে করি ঐ মৈত্রীচুক্তিটি আমাদের দিক থেকে শুধু অসম্পূর্ণই নয়, বলা চলে অসম্মানজনকও। কারণ আমাদের ভূমি আমরা তাদের ব্যবহার করতে দিচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে কিছু নিচ্ছি না বা পাচ্ছি না। কিন্তু নিজের সত্ত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রমাণের জন্য স্মারক আকারে হলেও কিছু তারা আমাদের প্রদান করবে নিয়মিত, এটাই রীতি। তাই আমাদের সামন্ত রাজন্যবর্গ যখন তাদের ওপর জলশুল্ক আরোপ করলেন, তখন আমি এই শুল্ক নির্ধারণের বিরোধিতা করিনি।

পদ্মনাভ আপত্তির সুরে বলেন- কিন্তু এই কর আরোপের বিষয়টি রাজা রাজেন্দ্র চোলকে জানিয়ে এবং তার মতামত নিয়েও তো করা যেতে পারত!
ভট্টবামন অস্বীকার করেন না। বলেন- তা হয়তো করা যেত। তবে আমি চেয়েছিলাম প্রস্তাবটি তাদের দিক থেকেই আসুক। সেই জন্যই পরীক্ষামূলকভাবে এই শুল্কের সূত্রপাত করা হয়েছিল।

পদ্মনাভ বিড়বিড় করে বললেন- তার ফলাফল হিসাবে আজ আমাদের একটা সর্বাত্মক যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে!
ভট্টবামনের মুখ অপমানে আরো লাল হয়ে ওঠে। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন- তা যদি হয়েও থাকে, তাহলে মাননীয় মহাসান্ধিবিগ্রহিককে মনে করিয়ে দিতে চাই যে পরাক্রান্ত পাল সাম্রাজ্য তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যে কোনো যুদ্ধের মুখোমুখি হতে কখনোই পরাক্সমুখ নয়।
এই পর্যায়ে নিজেই মধ্যস্থতার ভূমিকা নেন মহারাজ মহীপালÑ এখন আপনাদের বিবেচনায় আমাদের কী করা কর্তব্য?

পদ্মনাভ বললেনÑ তামিল-নৃপতির কাছে দূত পাঠিয়ে জানানো হোক যে এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া কারো জন্যেই মঙ্গলজনক নয়। আমরা আলোচনায় বসতে পারি। মহারাজ অনুমতি দিলে আমি নিজেই রাজা রাজেন্দ্র চোলের কাছে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারি। আমি জানাতে পারি যে, বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আমরা আলোচনার দরজা খোলা রেখেছি। আমাদের যে আলোচনায় বসার পূর্ণ সদিচ্ছা রয়েছে এটা বোঝানোর জন্য আমরা এই মুহূর্ত থেকে গঙ্গাজলবাহী গো-শকটের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

অসম্ভব! প্রায় চিৎকার করে ওঠেন কীর্তিবর্মাÑ তা করলে তামিল-নৃপতি ধরে নেবেন যে তার সৈন্যসামন্তের ভয়ে আমরা নতি স্বীকার করেছি। একথা তিনি সগর্বে প্রচার করে বেড়াবেন। এর ফলে অন্য রাজ্যের মানুষের কাছে তো বটেই, পাল সাম্রাজ্যের অধীন সকল মানুষের কাছেও গৌড়াধীপের মস্তক হেঁট হয়ে যাবে।

পদ্মনাভ তবুও চেষ্টা চালিয়ে যান- শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে কখনো কারো মস্তক হেঁট হয় না মহারাজ! যে কোনো যুদ্ধেই লোকয়, সম্পদয় ছাড়াও প্রজাদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্দশা। আমরা ইচ্ছা করলেই এই অনাবশ্যক যুদ্ধ এড়াতে পারি। তাতে আমাদের লাভ ছাড়া কোনো তির আশংকা তো দেখি না। তাছাড়া যেহেতু শান্তিচুক্তির প্রথম শর্ত ভঙ্গের বিষয়টি আমাদের দিক থেকেই শুরু হয়েছে, তাকে পুনর্নবায়নের উদ্যোগ নিতে কোনো দোষ আছে বলে আমি মনে করি না।

কীর্তিবর্মা ব্যঙ্গের স্বরে বলেন- শান্তির কথা বলবে দুর্বলরা। তামিলদের শৌর্য-বীর্য এতটা বাড়ল কবে যে তারা পাল-সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসে! দিগবিজয়ী রাজ-চক্রবর্তী দেব পাল সেই সময় তার যুদ্ধকান্ত সৈন্যদের বিশ্রাম দেবার জন্য তামিলদের সাথে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। আমাদের সেই সমস্যা নেই। আমরা কেন যুদ্ধে পিছ-পা হবো?
তাহলে? মহারাজ মহীপাল নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।

যুদ্ধযাত্রায় যখন রাজেন্দ্র চোল এগিয়েই এসেছেন, তখন যুদ্ধই হোক। যুদ্ধে তাদের পরাজিত করার করার পরেই মাত্র আমরা আলোচনার জন্য তাদের আহ্বান করতে পারি। বিজয়ীর ঔদার্য দেখিয়ে তখন হয়তো আমরা জলশুল্ক কমিয়েও দিতে পারি।

পদ্মনাভ বলেনÑ আমি আবার সবাইকে এই কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই যে যুদ্ধ করার জন্য রাজা রাজেন্দ্র চোল এগিয়ে এসেছেন বটে, তবে প্রথম সূত্রপাতের জন্য যদি কারো ত্র“টি থেকে থাকে, তা আমাদেরই।

সেক্ষেত্রে রাজেন্দ্র চোল নিজেও তো গৌড়াধিপতির কাছে দূত পাঠিয়ে শুল্কের ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানাতে পারতেন। তা না করে তিনি সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসছেন। এখন তার মুখোমুখি না দাঁড়ালে আমাদের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হবে।
মহারাজ মহীপালকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছেÑ তাহলে আপনারা বলছেন যুদ্ধই শ্রেয়?

অবশ্যই মহারাজ! ভট্টবামন এবং কীর্তিবর্মা একসঙ্গে বলে উঠলেন- কেউ আমাদের কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করে যদি, আমরা তা দিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু কেউ যদি সৈন্যদল নিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে আসে, তাহলে তাকে উচিত শিক্ষা না দিলে সে চিরকাল উত্যক্ত করতে থাকবে আমাদের।
পদ্মনাভ কিছু একটা বলতে চাইছিলেন। কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন মহীপাল। এই মুহূর্তে তার মনে-মস্তিষ্কে যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নাই। জেগে উঠেছে রাজকীয় অহম। জেগে উঠেছে ত্রিয় রক্ত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন চাইছিলেন না স্বজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে। কিন্তু কৃষ্ণ তাকে ত্রিয়-ধর্মের কথা বলে তার রক্তে যুদ্ধের উন্মাদনা জাগিয়ে তুলেছিলেন। এখন মহীপালের রক্তে সেই যুদ্ধের উন্মাদনা জাগিয়ে তুলেছেন দুই পারিষদ ভট্টবামন এবং কীর্তিবর্মা। মহীপাল ইতোমধ্যেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন যে তিনি তামিল জয় করে সেই রাজ্যের রাজধানীতে পদার্পণ করছেন। দিকে দিকে পরম শক্তিমান মহারাজ মহীপালের জয়ধ্বনি। তামিল প্রজারা দলে দলে আসছে নতমস্তকে তার কাছে প্রাণভিা চাইতে। শ্র“তকীর্ত মহারাজ দেবপালের পরে পাল-সম্রাটরা আর কোনো যুদ্ধযাত্রা করেননি। তাই পাল-সাম্রাজ্যের সীমানাও আর বর্ধিত হয়নি কোনো দিকে। আজ যখন সুযোগ দোরগোড়ায় এসেই গেছে, তখন হোক যুদ্ধ। তিনিও পূর্বতন দিগবিজয়ী রাজ-চক্রবর্তী দেবপালের মতো স্বীয় জয়স্কন্ধ্যাবার স্থাপন করবেন রাজেন্দ্র চোলের বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য স্বীয় বাহুবলে জয় করে নিয়ে।

পদ্মনাভের কথা এখন আর মহারাজের কানে ঢুকছেই না। কীর্তিবর্মার মতো তারও মনে হচ্ছে যে পদ্মনাভ মানুষটা নিতান্তই কাপুরুষ। ‘শান্তি’ ‘শান্তি’ মন্ত্র জপ করে চলেন। কিন্তু স্থায়ী শান্তি স্থাপনের জন্য মাঝে মাঝে যে শক্তি প্রদর্শনেরও প্রয়োজন রয়েছে, একথাটি তার মনেই থাকে না। মহারাজ মহীপাল এবার পুরোপুরি উপো করেন পদ্মনাভকে। কীর্তিবর্মার দিকে তাকিয়ে বলেনÑ আপনি অবিলম্বে যুদ্ধযাত্রা করুন। রাজধানীর শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যতগুলি সৈন্য রাখা প্রয়োজন, শুধুমাত্র সেই কয়েকজনকে রেখে বাকি সকল সৈন্যকে নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করুন। ঝাঁপিয়ে পড়–ন রাজেন্দ্র চোলের ওপর। তাকে দেখিয়ে দিন যে গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার পরিণাম কত ভয়ানক! পালসৈন্যদের তরবারি অনেকদিন শত্র“র শোনিত পান থেকে বিরত রয়েছে। সেই কারণে রাজেন্দ্র চোলের মতো একজন ুদ্র নৃপতি পাল-সম্রাটের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার সাহস পেয়েছে। আপনি এগিয়ে যান সৈন্যবাহিনী নিয়ে। ঝাঁপিয়ে পড়–ন রাজেন্দ্র চোলের ওপর! সপ্তাহান্তেই আমি বিজয়ের সংবাদ শুনতে চাই।
কীর্তিবর্মার দুই চোখ চকচক করছে যুদ্ধের উন্মাদনায়। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান মহারাজকে। তার মনে স্বপ্ন। এবার সুযোগ পাওয়া গেছে। মহারাজকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ তিনি দেখাবেন অবশ্যই।

২৩. ভূমিযাত্রা... যুদ্ধযাত্রা...

দিব্যোকের ঠোঁট নড়ে ওঠে। উচ্চারিত হয় একটিমাত্র শব্দ- চলো!
      
দিব্যোকের কপালে জ্বলজ্বল করছে ওলান ঠাকুরের থানে দেওয়া বলির রক্ত মাখা বরেন্দির লাল মাটির টীকা। ধান-দূর্বা মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করে গেছে গ্রামের মাতৃস্বরূপা রমণীরা।
গাঁওদেব-গাঁওদেবীর মূর্তিকে শেষবারের মতো প্রণাম জানিয়ে চলতে শুরু করে দিব্যোক। তার ঠিক পেছনে মল্ল। বাকি সঙ্গীরা তার একধাপ পেছনে। তারা গাঁয়ের সীমানায় এসে পৌঁছুতেই আবার উলুধ্বনি করে মহিলারা।
এবার দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করে দলটি।
গ্রাম পেরিয়ে এসে একবার পেছনে ফিরে তাকায় দিব্যোক। তার পেছনে সম কৈবর্তপুরুষরা দাঁড়িয়ে আছে। শিকার পরবের সাজ তাদের। আজ তারা বনে পশু শিকারে যাচ্ছে না। আজ তাদের এই যাত্রা নিজেদের ভূমি আর নিজেদের জীবনকে ফিরিয়ে আনার যাত্রা।
দিব্যোক উঠে দাঁড়ায় কাছের টিলার মাথায়। চিৎকার করে বলে, আমরা মোদের বরেন্দিকে ফিরিয়ে আনব! লয়তো সবাই ওলান ঠাকুরের নামে মরব!
অস্ত্র উঁচিয়ে সঙ্গীরা চিৎকার করে প্রতিধ্বনি তোলে, আমরা মোদের বরেন্দিকে ফিরিয়ে আনব! লয়তো ওলান ঠাকুরের নামে মরব!
দিব্যোক আবার বলে, যারা বরেন্দির নামে মরতে ভয় পায় তারা ফিরে যাক!
কথাটা বলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দিব্যোক। তাকিয়ে থাকে সমবেত কৈবর্তদের দিকে। কিন্তু কেউ তার জায়গা ছেড়ে নড়ে না। দিব্যোক তখন জোরে চিৎকার করে, আমরা সবাই মোদের বরেন্দির জন্যে জীবন দিব!
সমস্বরে প্রত্যুত্তর আসে, হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা জীবন দিব!
টিলা থেকে নেমে ফের হাঁটতে শুরু করে দিব্যোক।
কিছুণ এগিয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকায়। প্রায় নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করছে হাজার হাজার কৈবর্ত। কেউ ফিরে যায় নি।
আনন্দিত এবং গর্বিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফের হাঁটতে থাকে দিব্যোক। পরবর্তী গ্রামের মুখেও দঁড়িয়ে আছে শত শত মানুষ। তারা মাথা নিচু করে অভিনন্দন জানায় দিব্যোককে। তারপর দিব্যোকের পেছনে হাঁটতে থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে পা মিলিয়ে নিজেরাও হাঁটতে থাকে।
প্রত্যেক কৈবর্তগ্রামের প্রান্তসীমায় পৌঁছামাত্র একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। দলে দলে মানুষ যোগ দিচ্ছে দিব্যোকের রাজধানীমুখী পদযাত্রায়।
এইভাবে সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে মানুষগুলোর সমষ্টি রূপ নেয় জনসমুদ্রে। গর্জন নেই। কিন্তু ফুঁসছে সেই সমুদ্র। সেই ফুঁসে ওঠা ক্ষোভ বুকে নিয়ে রাজধানীর দিকে এগিয়ে চলেছে জনসমুদ্র।
কোনো যোদ্ধাদল যুদ্ধযাত্রাকালে সঙ্গে থাকে পর্যাপ্ত খাদ্য-পানীয়, থাকে বৈদ্য-চিকিৎসক, থাকে শুশ্রূষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট করা থাকে দিনশেষে আশ্রয় বা বিশ্রাম নেবার জায়গা। থাকে অস্থায়ী শিবিকা (তাঁবু) এবং অন্যান্য সরঞ্জাম।
কিন্তু কৈবর্তদের সঙ্গে তেমন কিচ্ছু নেই। তারা সারাদিন পথ চলে। যেখানেই রাত সেখানেই তাদের নিদ্রার স্থান। পথ চলতে চলতেই তাদের কেউ কেউ বনে ঢুকে শিকার করে আনে। কেউ কেউ চলতে চলতে পথের পাশ থেকে কুড়িয়ে নেয় খাওয়ার মতো কোনো কন্দ বা মূল। আর জলাশয় দেখলেই সেখান থেকে আঁজলা ভরে খেয়ে নেয় জল। দিব্যোকের জন্যও একই ব্যবস্থা। তাকেও রাত নামলে শুতে হয় মাটি-ঘাসের শয্যাতেই। জল খেতে হলে তাকেও নামতে হয় জলাশয়ে। শুধু মল্ল এবং কয়েকজন সঙ্গী তাকে শিকারের জন্য বনে ঢুকতে দেয় না। তারা নিজেরা পালাক্রমে শিকার করে আনে। সেই খাবারের অংশ দেয় দিব্যোককে। দিব্যোক অনুযোগ করলে তারা হেসে বলে, যেহেতু অনেকদিন দিব্যোকের শিকারের অভ্যেস নেই, তাই সে বনে ঢুকলে তার আহত হবার কিছু না কিছু আশংকা আছেই। আর দিব্যোক আহত হলে তাদেরকেই তখন তার ভারি শরীরটা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তার চাইতে তাকে শিকারের অংশ দেওয়াটা অনেক কম পরিশ্রমের। বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়েছে মল্লরা। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে দিব্যোকও। এবং মেনে নিয়েছে তাদের যুক্তি।

দিব্যোক এমনকি এটাও জানে না তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে কতজন কৈবর্ত পদযাত্রী। মল্ল একবার বলেছিল সংখ্যাটি নিরুপণ করে নেওয়া উচিত। কিন্তু যেহেতু প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে সংখ্যা, প্রতিদিন যোগ দিচ্ছে নতুন নতুন পথসঙ্গী, তাই সেই কাজটিও ফেলে রাখাই হয়েছে। দিব্যোক মনে মনে ভেবে রেখেছে রাজধানীর কাছাকাছি পৌঁছে কোনো বড় প্রান্তরে সবাইকে একত্রিত করে লোক গণনার কাজটি সেরে নেবে।

এগারো দিনের দিন তাদের পৌঁছে যাওয়ার কথা রাজধানীতে। তারা বরেন্দি থেকে যাত্রা শুরুর কয়েকদিন পূর্বে দিব্যোক উত্তর দিকে পাঠিয়েছে উগ্রকে। দণি দিকে ছোটভাই রুদোককে। পশ্চিমে গেছে তার বাল্যবন্ধু বুধিয়া। দিনুয়া গেছে পূর্বদিকে। ওরা ঐসব অঞ্চলের কৈবর্তদের তো বটেই, কোল-ভিল-রাজবংশীদেরও আহ্বান জানাবে এই যাত্রায় যোগ দেবার জন্য। দিব্যোক নিজের সঙ্গীদের নিয়ে চলেছে সোজা রাজধানীর পথ ধরে। তবে পথের পাশে যেখানেই কোনো আদিবাসী গ্রাম পড়ছে, সেখানেই দিব্যোক তাদের মোড়লকে অনুরোধ জানাচ্ছে সঙ্গী হতে। অনেকেই যোগ দিচ্ছে দিব্যোকের পদযাত্রায়। রাজধানীর প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে তাদের সাথে মিলিত হওয়ার কথা উগ্র, রুদোক, বুধিয়া এবং দিনুয়ার। গতির অংক কষে দিব্যোক বলেছিল রাজধানীর প্রবেশদ্বারে মিলিত হবে তারা তাদের যাত্রা শুরুর দশম দিনে। তাই দিব্যোক শুধু একটি বিষয়ে কড়া ল রাখে। যাতে তাদের পথচলার গতি কম-বেশি না হয়ে যায়।
তাদের পরিকল্পনা করা আছে সবকিছু।
রাজধানীতে পৌঁছে তারা অবস্থান নেবে চার সিংহদ্বারের বাইরে। সেখান থেকে দিব্যোক লোক পাঠিয়ে প্রার্থনা করবে মহারাজের দর্শন। মহারাজ যদি তাদের দুই-চারদিন অপোও করিয়ে রাখেন, তাতেও আপত্তি থাকবে না তাদের। মহারাজ অনুমতি দিলে দিব্যোকসহ পাঁচজনের একটি প্রতিনিধিদল যাবে তাঁর প্রাসাদে। তারা বিস্তারিত জানাবে কৈবর্ত এবং অন্যান্য ভূমিপুত্র প্রজাদের ওপর কী নিপীড়ন চালাচ্ছে রাজপুরুষরা, হিন্দু পুরোহিতরা, বৌদ্ধ মঠাধ্যরা। তারা বিস্তারিত জানাবে কীভাবে সর্বস্বান্ত হচ্ছে এই বরেন্দির ভূমিপুত্ররা। কোন কোন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় এই নিপীড়ন চলছে, সেগুলিও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানানো হরে মহারাজকে। রাজ্যের কোন কোন রীতি ও বিধানের কারণে ভূমিপুত্রদের সাথে মানবেতর আচরণ করতে অন্যরা সম হচ্ছে সেকথাও জানানো হবে মহারাজ মহীপালকে। দিব্যোকের দৃঢ় বিশ্বাস, সব কথা মহারাজের গোচরে আনতে পারলে মহারাজ তার প্রতিবিধান করবেনই।
পদযাত্রার পুরো এগারোটি দিন অন্তরে এই আশা পোষণ করেই প্রতিটি পদপে এগিয়েছে দিব্যোক। নির্দিষ্ট দিনেই তারা সবাই মিলিত হলো একত্রে। দিব্যোক আবার সবাইকে মনে করিয়ে দিল তাদের পরিকল্পনার কথা।

কিন্তু পরিণতি হয়ে গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
গুপ্তচরদের মাধ্যমে আগেই কৈবর্তদের এই রাজধানীযাত্রার কথা পৌঁছে গেছে মহারাজ এবং মহামন্ত্রীর কানে। অন্যান্য সময়ের মতো আরো একবার ভট্টবামনের ভুল মন্ত্রণায় ভুল পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত  নিয়ে অপো করছেন মহারাজ মহীপাল।     
দিব্যোকের নেতৃত্বে কৈবর্তরা রাজধানীর সিংহদুয়ারে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের দিকে বৃষ্টির মতো ধেয়ে এল শত শত তীর। নগরীর সবগুলি সিংহদ্বার বন্ধ করে দিয়ে নগরপ্রাকারে দাঁড়িয়ে তীর ছুঁড়ছে ধনুর্ধররা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকে গাঁথা বিষাক্ত তীর নিয়ে আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কয়েকজন কৈবর্ত যুবক। হতবিহ্বল দিব্যোককে হ্যাঁচকা টানে মাটিতে শুইয়ে দিল মল্ল। কয়েকজন ছুটে এসে দিব্যোককে ঘিরে তৈরি করল মানব-ঢাল।
তার কিছুণ পরেই কোনোকিছুই আর দিব্যোকের নিয়ন্ত্রণে রইল না। মল্ল, রুদোক, উগ্র,  পরভুর নেতৃত্বে কৈবর্তযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ল পালসেনাদের ওপর।

যুদ্ধ শেষ হতে বেশি সময় লাগল না আদৌ।
মহারাজের পুরো সেনাদল রাজেন্দ্র চোলের সাথে গঙ্গাতীরে যুদ্ধে ব্যস্ত। রাজধানীতে রয়ে যাওয়া সামান্য কয়েক শত সৈন্য বেশিক্ষণ টিকতে পারল না কৈবর্তদের সামনে। সিংহদ্বার হাট করে খুলে দেওয়ামাত্র কৈবর্তরা স্রোতের মতো ধেয়ে গেল নগরমধ্যে। শত শত বৎসরের নিপীড়ন-লাঞ্ছনা-শোষণ-অমানবিক আচরণের শিকার হওয়া, এবং সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণা-অপমান ঘৃণা হয়ে জমে আছে কৈবর্তদের বুকে। আজ সেই ঘৃণা নিজেকে উন্মুক্ত করার পথ পেয়েছে। তাকে আজ রুখবে কে!
কচুকাটা হয়ে গেল গৌড়ের সেনাদল। মত্ত হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট হলে যেমন পরিণতি হয়, সেই ভাবে বিধ্বস্থ হয়ে গেল পাল-সাম্রাজ্যের রাজধানী। লুণ্ঠনে বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারাল শত শত নগরবাসী। যারা পারল পালিয়ে বাঁচল। রাজপ্রাসাদ বিধ্বস্থ হলো সম্পূর্ণরূপে। আর কার যেন বল্লম ফুঁড়ে ফেলল মহারাজ মহীপালের বুক।

বিধ্বস্ত নগরজুড়ে কৈবর্তরা বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর জয়ধ্বনি উঠছে দিব্যোকের নামে। তারা দিব্যোকের নেতৃত্বে ফিরে পেয়েছে তাদের বরেন্দিকে। সাথে পুণ্ড্রও। ওলান ঠাকুর দিব্যোকের বেশে জন্ম নিয়ে এই মাটির সন্তানদের মুক্ত করেছে শত শত বৎসরের দাসত্ব থেকে।

 [চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৪৩০, জানুয়ারি, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।