ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

চুরি

শাকিলা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১০
চুরি

শীতের দুপুর। অদ্রি রেশমি সুতোর ঝিলমিলে রোদটা রিকশায় বসে উপভোগ করছে।

অফিস থেকে তাড়াহুড়ো করে আগেই বেরিয়ে পড়েছে। মা বলেছেন, বিকেল থাকতেই জুয়েলারির কাজটা সারতে। অদ্রিও জানে দিনকাল খারাপ। বাসায় পৌঁছতেই মা আলমারি খুলে ৭৫ হাজার টাকা দিলেন। বাবার পাওনা ১ লাখ টাকা, চাচার কাছ থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু চাচা সহজ অঙ্কটাকে গরল করে ফেলছেন। অদ্রি বিরক্ত। চাচা কথামতো তখনও টাকা নিয়ে পোঁছাননি। আগামীকাল ওই মার্কেটের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তার পরের দিন ১৬ ডিসেম্বর সরকারি ছুটি। বিয়ের আর মাত্র ৫ দিন বাকি। জানালা দিয়ে চাচাকে দেখতে পেয়ে মাকে চিৎকার করে বলে। আর মা তখনই চা পর্বের জন্য ব্যস্ত হয়ে যান। অবশেষে টাকাটা ব্যাগে ভরে অদ্রি রাস্তায় নামে। চারপাশে ওর সতর্ক চোখ রাখে। আলোকে গ্রাস করা আলোআঁধারি শহরে কমে যাওয়া লোকজনের নীরবতা ওকে দুর্ভাবনার জটে আটকে ফেলে। তখন ওপার থেকে অনিকেতের চিৎকার আর হাতের ইশারায়, হুট করে রাস্তা পার হয়ে বন্ধুর কাছে চলে যায়। অনিকেতের ছটফটে প্রশ্নে শব্দময় হয়ে ওঠে অদ্রির এই মুহূর্তের শহরটা।
-রাস্তায় ওভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কী চিন্তা করছিলি?
-ভাবছিলাম এই ভর সন্ধ্যায় ব্যাগে এতোগুলো টাকা নিয়ে রিকশায় উঠবো নাকি বাসায়ই ফিরে যাবো? জুয়েলারিতে যাওয়ার কথা কিন্তু রাস্তাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। হঠাৎই এরকম হয়ে গেল।
-এতো চিন্তার কী আছে? কয়েক পা পেরোলেই তো আমার বাসা। একটু বসে, চা-পানি খেয়ে একসাথেই না হয় যাওয়া যাবে জুয়েলারিতে।
-অদ্রি মনে স্বস্তি পায়। ভাবে অনিকেত পাশে থাকলে অনেকটা ভরসা পায় সে। ঝটপট উত্তর দেয়-
-হ্যাঁ, সেটা হলে তো খুব ভালো।
অদ্রির ছুটোছুটি-করা অশান্ত মনটা ধীর গতি ফিরে পায়। অনিকেতের মনটাও ফুরফুর করছে বন্ধুকে হঠাৎ দেখার আনন্দে।
-তোর সাথে কতদিন দেখা নেই, তাই না অদ্রি?
-তবুও তো তোর সাথে হুটহাট দেখা হয়ে যায়, এটাই বা কম কী? ছেলেবেলার কত বন্ধু তো হারিয়েই গেছে। সারা জীবনেও হয়তো দেখা হবে না।
-কেমন আছিস? বাড়ির সবাই ভালো?
-হ্যাঁ, ভালো। তিথির বিয়ে।
-তাই নাকি? খুব ভালো খবর।
-তোর কথা বল। সেই প্রাইভেট কোম্পানিতেই আছিস? মাল্টিন্যাশনাল কো-অপারেটিভ...।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ। সবই একইভাবে চলছে।
-তোর ধারাবাহিক প্রেম?
-এটা এমন কি মন্দ ব্যাপার। ওভাবে হাসছিস কেন?
-মন্দ এই যে, বেশিদিনের ব্যবধানে দেখা হলে প্রেমিকার নাম পাল্টে যায়। তোর এই প্রেমিকা-বদলের রহস্যটা কী?
-বাসায় গিয়ে আড্ডা দেব যখন, তখন সব রহস্য উদঘাটিত হবে।

ফোরে ম্যাট্রেক্স ও কুশন বিছানো। ছোট্ট মজার আয়োজনে ওরা বসে। একদিকে কিছু বই ছড়ানো। তার পাশে অ্যাশ ট্রে, ছাইয়ে ভরা। খাটের পাশে গোলাকৃতির কালো রঙের স্টিল আলনায় ঝুলে আছে গেঞ্জি, শার্ট, ট্রাউজার ইত্যাদি। অদ্রির দৃষ্টি এতণ এদিক-ওদিক ঘুরলেও একটা বিস্ময়ের ছায়া হেলে পড়ে চোখের কোণ ঘিরে। ভেবেছিল আগের মতো অনিকেত চায়ের জল চুলায় জলদি বসাবে আর বলবে সাথে সে কী খেতে চায়। সেরকম কোনো লণ দেখতে না পেয়ে অদ্রি নিজেই বললো, আমি কিচেনে যাবো? নাকি, চায়ের দোকানে মন্টুকে বলে আসবো চা আর ডালপুরি পাঠিয়ে দিতে? জুয়েলারিতে যেতে হবে না?
-মন্টুর চায়ের কথা তুই ভুলিসনি?
-আহ, ভনিতা ছেড়ে বল, তুই যাবি, কি যাবি না?

অনিকেতের যেন দুটোতেই সম্মতি আছে এরকম একটা চেহারায় কিছুণ থেকে বেরিয়ে গেল দ্রুত দরজা দিয়ে একেবারে রাস্তায়। ঘনকালো মেঘে চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে হঠাৎই। একটু আগেও আকাশের অবস্থা এরকম ছিল না। এখন মনে হচ্ছে বৃষ্টি বা ঝড় একটা কিছু হবে। থমথমে গুমোট আবহাওয়া কিসের পূর্বাভাস বোঝাই মুশকিল। অনিকেত লম্বা লম্বা পা ফেলে দোকানে পৌঁছেই অর্ডার দিয়ে দেয়। মন্টু আকাশের দিকে তাকাচ্ছে আর চায়ের গ্লাসে সুরেলা টুংটাং শব্দে চামচ নাড়াচ্ছে। অনিকেত লোভী চোখে চেয়ে আছে। পাশের বড় কড়াই থেকে গরম গরম পুরি তুলে টিনের চৌকোনা পাত্রে রাখা হচ্ছে। ওখান থেকে পুরি ঠোঙাতে ভরে চায়ের দুটো গ্লাস ছোট ট্রেতে নিয়ে দৌড় দিল পিচ্চি। বালকের শরীরে টুপটাপ বড় বড় বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। অন্য সময় হলে একটু দাঁড়িয়ে ভিজে নিত। এখন কিন্তু ওর মনে ভয়, চা ঠান্ডা হলে কাস্টমারের বকা খাবে। অনিকেত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পৌঁছে, গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠল-- ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। /মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে, কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ,/ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্ত বেণী পিঠের প’রে লোটে,/কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ’।
অদ্রি কৌতূহলী হয়ে ওঠে আড়চোখে বিশেষ অর্থে চেয়ে থাকে অনিকেতের দিকে। বলে মিষ্টি হেসে,
হরিণ চোখের কালো মেয়েটির নাম কী? কোথায় থাকে? কোথায় পেলি তারে?
অনিকেত আবার সুর করে বলে : দেখেছিলেম মাঠে। পার্ক ভিউয়ের মাঠে।
ওরা তখন হাসির প্রাণবন্ত উচ্ছলতায় মগ্ন। কখন বৃষ্টির ছটা এসে ঘর ভিজিয়ে দিয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। অদ্রি উঠে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে বাইরের অন্ধকারের সাথে রাস্তা ঘাটে ছুটে যাওয়া লোকজন, গাড়ি-রিকশার দৃশ্য। ওর মুখ চিন্তার গাঢ় রেখায় কঠিন হয়ে ওঠে। নিচু স্বরে বললেও বৃষ্টির শব্দ ঘরের মধ্যে নেই বলে অদ্রির কথা বেশ স্পষ্টই শোনা যায়, আশ্চর্য! হঠাৎই আবহাওয়াটা দুর্যোগপূর্ণ হয়ে গেল।
অনিকেত সরল রসিকতায় টইটুম্বুর, এতো চিন্তার কী আছে? তুই কি রাস্তার জমা জলে ভাসছিস? তাও যদি হতো নৌকা দিয়ে তোকে পার করে দিতাম। কিন্তু তুই জানিস খুব নিরাপদ জায়গায় তুই অবস্থান করছিস। বরং বাসায় ফোন করে দে আবহাওয়া ভালো না হওয়া পর্যন্ত তুই এখানেই থেকে যাচ্ছিস। বেশি রাত হলে যাওয়ার দরকার কী? সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে জুয়েলারিতে যাবি প্রথমে, তারপর বাসায় গয়নার বাক্সটা রেখে সোজা অফিস। ব্যস। রাত-বিরাতের ভয় নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনাও নেই।
অদ্রি শুনছিল, অনিকেতের কথা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। তবু জুয়েলারির কাজটা ঝুলে থাকাতে ভালো লাগছিল না। মায়ের চিন্তিত মুখটার কথা মনে করে বিচলিত হয়ে উঠলো। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বসলো, না, বাসায় ফিরে যাই এখনই। বৃষ্টি আর থামবে না। আর এখানে থাকার কথাটা মাকে ফোনে রাজি করানো যাবে না। অনিকেতের মুখের উড়িয়ে দেওয়া হাসিটা সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়লো সূর্যের আলোর মতো।
-অদ্রি, তুই না একটা পাগল। এতো রাতে কেউ ব্যাগে টাকা নিয়ে রাস্তায় বের হয়?
সত্যিই অদ্রির ভেতরটা খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। ওদের বাড়িতে ঘটা করে বিয়ে হচ্ছে এই প্রথম। কত ধরনের আয়োজন, দায়িত্ব কর্তব্য। সব ঠিকঠাকমতো হবে কি-না এ দুশ্চিন্তা সবার মধ্যে কাজ করছে। ওরা তিনভাই এক বোন। বড় ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে একেবারেই আড়ম্বরহীনভাবে। নিজেদের পছন্দের বিয়ে। কোর্ট ম্যারেজ করেছিল ওরা। শুধু যেদিন বউ ঘরে এল উপস্থিত আত্মীয়স্বজনদের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, নিতান্তই ঘরোয়াভাবে। মেজভাই কবি মানুষ, রোমান্টিকও বটে। মাঝে মাঝে তাকে একটি মেয়ের সাথে দেখা যায়। ওর মুখে শোনা যায় বেলী ফুলের বিয়ের সৌন্দর্যের কথা। চুপ থাকতে দেখে অনিকেত ইচ্ছা করেই যেন ধাক্কা দিল, অদ্রিকে, বন্ধু, তার দেখা পেলি?
-কার?
-তোর সেই স্বপ্ন মেয়ের?
-সব স্বপ্ন মেয়ে-টেয়ের কথা বলতে পারবো না। তবে, ইদানীং দেখছি এক কলিগ বেশ পছন্দ করছে আমাকে-
-তুই?
-আমিও একটু আধটু করি। তবে, এখনও অনির্ধারিত অবস্থায় আছে। বাদ দে। বল তোর কৃষ্ণকলিকে দেখাবি না? তিথির বিয়েতে নিমন্ত্রণ রইলো, বুঝলি?
-তিথি। ছোটবেলায় ওকে দেখেছি কতবার লম্বা চুলের চঞ্চল ছোট্ট মেয়ে, যখন তখন আমাদের সামনে দিয়ে পাড়ার বন্ধুর সাথে দৌড়ে চলে যেতো। তুই আর আমি তোদের বাড়ির বাইরের দরজার পেছনের মাঠে গল্প করতাম। ওরই বিয়ে কদিন পর, ভাবতেই অবাক লাগছে! কত দ্রুত সময় চলে যায়।
আমরাও তখন খুব বড় ছিলাম না।
-হ্যাঁ।
অনিকেতের পাশে শুয়ে নির্ভরতায়, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎকে জোড়া দিতে দিতে এক সময় অদ্রি বলে ওঠে, তোর বাবা-মার সাথে কম্প্রোমাইজ হলো?
-না।
-কেন? একটা কিশোর ছেলে সেই যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর ফিরলো না। ফিরবে না এটা কী করে হয়?
-কেন ফিরবো?
-তোর সাথে আমি যুক্তিতর্কে যাবো না। ভেতরে ভেতরে আমি খুব টেনশনে আছি মায়ের জন্য। আমি খুব কান্তও। তোর ব্যাপারটায়ও আমি চিন্তিত। তোর বাবা তোকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। তখন এর বেশি কিছু তুই বলিসনি।
-তখন আমি স্কুলে পড়ি। আর মেয়েটি কলেজের ছাত্রী। অসম প্রেম। আমার প্রথম প্রেম। ওকে খুব ভালো লেগেছিল। খুব ভালোবাসি ওকে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছি। বলেও দিয়েছি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবো, শহরে। ওই মেয়েটি এবং ওর বাবা-মা আমার ওপর প্তি। ওর অভিভাবকরা পারলে ঠ্যাঙ্গায়। অবশ্য সেই কাজটা আমার বাবা করলেন। সেদিন সম্ভবত হাট থেকে বাবা সব কাহিনী শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে বাড়িতে ফিরেই আমাকে পিটানো শুরু করলেন। আর জখম করে লাথি মেরে বের করে দিলেন।   মা নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন। ওটাই ছিল মায়ের স্বভাব। প্ল্যান হয় বন্ধুবান্ধব মেয়েটিকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসবে। ওকে নিয়ে উধাও হয়ে যাবো। মায়ের গয়নাও আলমারি থেকে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছি। কিন্তু এরপর থেকে মেয়েটিকে গ্রামের কোথাও পাওয়া গেল না।
অদ্রি ঘুম ঘুম চোখে বলে, দুর্দান্ত প্রেম এবং অনুচিত পরিকল্পনা।
অনিকেত সিগারেট ধরায়, ধোঁয়া উড়িয়ে বলে, প্রেম-ট্রেম কিচ্ছু না। দু দিনের মোহ। ওটা কেটে গেলে আবার সব সাদা শ্লেট। শূন্য।

অদ্রি চাদরটা টেনে আনমনেই চোখ বন্ধ করলো। আর একটু পরেই ঘুমে তলিয়ে গেল। অনিকেতের চোখে কিন্তু ঘুম নেই। ওর রাত জাগার অভ্যাস। মতিঝিলের অফিসে অনেক রাত পর্যন্ত থাকে। ই- মেইল চেক করে, উত্তর দেয়। ইন্টারনেটে আরও কী সব কাজ করে। হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে রাস্তায় রাতভর ঘুরে বেড়ায় এখানে ওখানে। অনেক সময় পুলিশ ধরেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কিন্তু বেশিণ ধরে রাখতে পারে না। পুলিশকে বোঝাতে পারে নিষিদ্ধ ড্রাগ ব্যবসা, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাপি বা মেয়েমানুষের দালালিতে তার কোনো হাত নেই। তারপর রাত শেষ করে খুব ভোরে বাসায় ফিরে ঘুম দেয় আর উঠে দুপুরে। অনিকেত একা থাকে দোতলার নিচতলায় গ্যারেজের সাথে লাগানো এক রুমের বাসায়। সাথে একটুকরো বারান্দা। ছোট্ট রান্নাঘর ও বাথরুম। রাত যত গভীর হচ্ছে অনিকেত তত দ্রুত পায়ে ঘরময় অস্থির পায়চারি করছে। সিগারেট ধরিয়ে বেতের সোফায় আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে কী যেন ভাবছে। লাইটটা তখনও অন করা। একদৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে অদ্রির ঘুমের দৃশ্য। যেন নাটকের কোনো সিকোয়েন্সে কোথাও ত্র“টি আছে কি-না, পরিচালকের তীè চোখ তা-ই দেখছে। ওর সিগারেটের ধোঁয়া ঘরকে গুমোট আর ধোঁয়াটে করে ফেলেছে। কিছুটা সময় পরে লাইট অফ করে সোফাতেই চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলো অনিকেত।

রোজ ঠিক সকাল ৮টার আগে অদ্রির ঘুম ভাঙ্গে। দৌড়ঝাঁপ করে রেডি হয়ে ৯টার মধ্যে অফিসে পৌঁছে যায়। একাউন্টস বিভাগের সিনিয়র কর্মকর্তা। প্রাইভেট অডিট অফিস। একটুও দেরি হওয়ার জো নেই। কিন্তু আজ একটু দেরি হবে। চারদিন পর একমাত্র বোনের বিয়ে। আয়োজন চলছে। দোকানপাট খুললে তবে তো অদ্রি জুয়েলারিতে যাবে। টাকা দিয়ে গয়নার বাক্সটা নিয়ে মায়ের হাতে দিয়ে তবেই শান্তি। মায়ের হুঁশিয়ারি ছিল রাতে যেন গয়নার বাক্স নিয়ে বাসায় না ফেরে সে। মায়ের কথামতোই কাজ করেছে ভেবে মনটা ফুরফুর করে ওঠে। সে অফিস ব্যাগের মধ্যে আরেকটা ছোট ব্যাগে টাকাগুলো রেখেছিল। ঠিক ঠিকই জুয়েলারিতে পৌঁছে গেছে। অথচ ওই ছোট ব্যাগ খুলে দেখে সব শূন্য। কিচ্ছু নেই। সে তখন ভাবছে তাহলে কোথায় পড়লো? অদ্রি দোকানের চারপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে, ঘুরতে থাকে। জুয়েলারির সেলসম্যানকে গয়নার বাক্স তুলে রাখতে বলে। আর হন্তদন্ত হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। যে পথে এসেছিল রিকশা করে, সেই পথ ধরে আবার রওনা হলো। সতর্ক দৃষ্টি ক্যামেরার চোখের মতো চারদিকে ঘুরতে থাকে। ওর সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। কোথাও হারানো জিনিসের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে না। ওর ভারী পা দুটো অনিকেতের বাসা পর্যন্ত এসে থেমে যায়। দরজায় তালা। নিজেকে তখন একবারে নিঃস্ব লাগে। সে তাহলে কাকে বলবে এ কথা? তাছাড়া, অনিকেত ১১টার আগে নাকি কোনওদিন ওঠে না ঘুম থেকে। বরং দুপুর পর্যন্তই গড়ায়। তারপর স্নান সেরে সামনের হোটেলে ঢোকে। তারপর বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা মতিঝিল, ওখানেই ওর অফিস। কিন্তু, আজই ওকে তাড়াতাড়ি যেতে হলো? মোবাইলের বাটনে প্রেস করে ঝটপট, অনিকেত, আমার খুব বড় দুর্ঘটনা হয়ে গেছে।
-দুর্ঘটনা! কী হয়েছে? তুই ঠিক আছিস তো? আসার সময় রাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট দেখলাম। রিকশার সাথে প্রাইভেট কারের।
-না, না, ওসব কিছু না। আমার ব্যাগের টাকাটা নেই। এতগুলো টাকা। প্রায় দু লাখ। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কী করবো এখন? তিথির বিয়ের গয়না আনবো কীভাবে?
-আমি মানিকগঞ্জে যাচ্ছি অফিসের কাজে। নইলে তোর কাছে এখনই যেতাম। একটা উপায় তো বের করতেই হবে। তুই চিন্তা করিস না। জুয়েলারিতে গিয়ে বল দু-তিন দিন পর নেব।
-কিন্তু সে কী করে সম্ভব? ব্যবস্থা তো হবে না।
-আজ সন্ধ্যায় তুই বাসায় আসিস। তখন কথা হবে। ওতো ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? দুঃসময় আসে আবার চলেও যায়। বুকে সাহস রাখ। দেখা হবে। বাই।
ওকে। বাই।

নিজেকে বিভ্রান্ত হতে না দিয়ে সেই রকমই একটা পথ বেছে নিয়ে হাঁটছিল অদ্রি। সেই পথই তাকে বিট্রে করলো। চৌরাস্তার মোড়ে একটু দাঁড়িয়ে বাঁদিকের রাস্তায় বাঁক নিল। কিন্তু,  কোথায় যাবে? এখন অদ্রির প্রয়োজন অনিকেতকে। একজোড়া টলটলে নিষ্পাপ চাহনির মতো ওর পুরো ব্যক্তিত্ব।
একমাথা কোঁকড়ানো চুল। নির্দোষ মুখ। হৃদয়বান। পরোপকারী। কর্মে অঢেল উৎসাহ। ওর নির্লোভ হাত দুটো শুধু মানুষের কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়। অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেই ওর আনন্দ। অনিকেতের মুখটা সামনে দেখতে পেলেই সাহস বেড়ে যায়। অদ্রির অফিসে যেতে পা চলছে না। মনটা একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু না গিয়ে উপায় কি? ভাবে সন্ধ্যায় অনিকেতের পরামর্শটা কী জানতে হবে, সেটায় কোন সুরাহা হবে কি? নিজেই মনে মনে এর উত্তর তৈরি করে, কিছুই হবে না। মাঝখান থেকে তিথির বিয়েটাই না ভেঙে যায়! ছেলেপরে শর্তই ছিল মেয়েকে গয়না এবং প্রয়োজনীয় আসবাব দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া। যদি এসব নিয়ে ওই পরে সাথে গ-গোলে বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়? তবে, এটাও ঠিক এসব শর্ত-ফর্ত নিয়ে বিয়ে হওয়া উচিত নয়। এসব শর্তের খেলা ভেঙে ফেলার জন্য আমাদেরই এগোতে হবে। অদ্রি অফিসে একাউন্টস নিয়ে বসে। এই কোম্পানির পাকা হিসাব কর্মকর্তা। মনের ভেতর যত বড় ঝড় উঠুক, সে এতোটুকু বিচলিত বা অসংলগ্ন হবে না। টাকা-পয়সার গরমিল হবে না। অথচ নিজের ব্যক্তিগত হিসাবে সে এতো কাঁচা প্রমাণিত হলো! টাকাটা ওভাবে ব্যাগে নিয়ে এখানে ওখানে যাওয়াই ঠিক হয়নি। সরাসরি বাসা থেকে জুয়েলারিতে, সেখান থেকে বাসায় চলে আসা-- এটাই করা উচিত ছিল। উফ! নিজের গালে নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে করছে। এতো বড় ভুল! সে মনে করার চেষ্টা করে অনিকেতের বাসায় যাওয়ার আগে কী কী করেছিল এবং ওদের বাসায় যাওয়ার পরে ওখানে আর কেউ এসেছিল কি না। ছবির মতো করে সব দৃশ্য ফাশব্যাকে এনে দেখলো। না, কোনো হদিস সে পাচ্ছে না। বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় অস্থির পা রাখে। কান্তিহীন হাঁটতে থাকে। চেনা রাস্তা চেনা ঘরবাড়ি পেরিয়ে এক সময় অচেনা রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, গাছপালা, লোকজন চোখে পড়তে লাগলো। পা দুটো টনটন করতে রিকশায় উঠে বসলো-
-বাইজান কোথায় যামু?
-তোমার যেখানে খুশি। তবে একুট ধীরে চালিও। কারণ, আমি একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছি। সেটাই খুঁজছি। ওটা আমার পেতেই হবে।
এটা পাগলামি হলেও অদ্রির এরকম একটা ইনট্যুইশন কাজ করছে। মনে হচ্ছে অলৌকিকভাবে টাকাটার হদিস পাওয়া যাবে। আবার ভাবছে ও  এত বোকা! ভেবে নিজেরই করুণ হাসি পাচ্ছে। অতল কান্নার সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। ঘরবাড়িও তো দেখছে না এখানে। নির্জনতা চারপাশকে ছায়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে। একটা পরিত্যক্ত রেললাইন চোখে পড়লো। কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়ে রেল লাইনেই দৌড়াদৌড়ি করছে। মারামারি করছে। কাঁদছে। আবার হাসাহাসি করছে। রিকশাওয়ালা আর যেতে চাইলো না।
-বাইজান আর যাওয়ান যাইবো না। আর রাস্তা নাই।
-ঠিক আছে, তোমারে আমি ছেড়ে দিচ্ছি। হেঁটেই যাই। দেখি, কতদূর যাওয়া যায়।

এখনও সূর্যের হালকা আলো প্রকৃতির ওপর ছড়িয়ে আছে। অদ্রির মনে পড়ে একদিন রিকশা থেকে অনিকেত স্টেশনের এই জায়গাটা দেখিয়ে বলেছিল, ওই রেল লাইনের পথ ধরে চলে গেলে একটা রাজপ্রাসাদ পাওয়া যাবে। সেখানে সে মাঝে মাঝে আড্ডা দিতে আসে স্টেশনের মজুকুলির সাথে। ওই প্রাসাদ দেখার সাধ হয়েছিল অদ্রির। অনিকেতকে বলেছিল, আমাকে নিয়ে যাবি একদিন? ও তার জবাব দিয়েছিল দীর্ঘায়িত এক হাসির শব্দে। অনিকেতকে ওখানে সত্যি পেয়ে গেলে ওর মনটা ভালো হয়ে যেত। মনে মনে বিস্মিত হচ্ছিল বার বার। কীভাবে সে এখানেই উপস্থিত হয়ে গেছে সৌভাগ্যবশত! রেল লাইনের পাশের যে সরুপথ, তার ওপর দিয়েই অদ্রি হেঁটে যাচ্ছে। একেক জায়গায় টিনের চালের ঘর আর দু-একটা পাকা ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে দূরে দূরে, এতণ তা চোখেই পড়েনি। মাটির ঘরও বেশ আছে ভেতরে ভেতরে। পলিথিন দিয়ে তাঁবুর মতো করে ঘর বানিয়েও মানুষজন বাস করছে। তাঁবু দেখলেই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ চেহারার দৃশ্য চোখে ভেসে আসে। যুদ্ধসৈনিক নেই তো ওখানে? আরেকটু এগোনোর পর বোঝা গেল তাঁবুর ভেতরে পুরুষ-মহিলা, শিশুর বসবাস আছে। উঁকি দেওয়ার ইচ্ছা হলেও অদ্রি তা দিল না। দূর থেকে দেখতে পেলো প্লাস্টারখসা রঙহীন ভাঙাচোরা ঐতিহাসিক চিহ্নে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ি। পুরনো আমলের জমিদারবাড়ির মতো। সম্ভবত এটাই অনিকেতের বলা সেই রাজপ্রাসাদ। মুহূর্তে অদ্রির অনিকেতকে পাওয়ার একটা আকাক্সা আকাশকে ছুঁয়ে যায়। মনে হয়, অনিকেতকে সে ওখানে পেয়ে যাবে। আর একটা পজিটিভ সমাধান অলৌকিকভাবে ওর সামনে হাজির করবে অনিকেত। অদ্রি ওই প্রাসাদের দিকেই যাচ্ছে। কৌতূহলী শিশুদের একটা দল ওকে অনুসরণ করছে পেছন পেছন। ও ঘুরে দেখাতে ওরা থেমে গেল আর তাঁবুর দিক দৌড় দিল। অদ্রির পা ওই পোড়া জমিদারবাড়িটির দরজাবিহীন প্রবেশপথে থেমে যায়। একজন হাতের ওপর চকচকে কাগজে ওষুধের মতো কী যেন রেখে লাইটার দিয়ে তাপ দিচ্ছে। মুখটা প্রায় অন্ধকারে পোড়া তামাটে দেখাচ্ছে। ঝাঁকড়া চুলে অর্ধেক মুখ ঢাকা। পেছন ফেরা, পাশে একটা অফিস ব্যাগ। মনে হচ্ছে প্রচ- এক নেশার আসক্তি শরীরজুড়ে। ওই মগ্নতা ভাঙবেনা জেনেও কণ্ঠটাকে পরিষ্কার করে অদ্রি বলে, আচ্ছা, আশপাশে কি কোথাও মজুকুলি থাকে? তার সাথে গল্প করতে আসে অনিকেত ওর নাম, আমার বন্ধু।

ততণে যুবক ঝোঁকানো মাথা তুলে পেছনে ফিরে দেখে আগন্তুন্তকের মুখ। চিনতে কষ্ট হয় না। সিনেমার সিকোয়েন্সের মতো অনিকেতের পুরো অস্তিত্বটা যেন সাপের খোলস থেকে বের হয়ে আসে মুহূর্তে। ভালোবাসার অহঙ্কার প্রহসন হয়ে হো হো করে হেসে ওঠে। হাসতে থাকে। অনিকেত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সত্য ও মিথ্যা জীবনের সংজ্ঞার ব্যাখ্যায় অদ্রিকে চোবাতে থাকে। অদ্রি শুধু বজ্রাহতের মতো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কষ্টের জলে ভিজতে থাকে, ডুবতে থাকে।
-হ্যাঁ আমার কাজ এই রেল লাইনের ধারে এই প্রাসাদেই চলে। দুপুর বিকেল সন্ধ্যা রাত হয়তো পুরো রাতটাও এখানে কেটে যায়। বোস। ঘেন্না করলেও এখন আর আমার কিছু করার নেই। আমি হিরোইন গাঁজা চরস মদ চালান চক্রের এক সহযোগী ব্যবসায়ী। হাইজ্যাক চুরি ডাকাতি, খুন জখম এরকম কত শত অপরাধের সাথে জড়িয়ে আছি। মিথ্যাবাদী ভন্ড নষ্ট এক যুবক আমি। তবে, এখন আমি যা বলছি সব সত্যি। তবে সেদিন রিকশায় তোর পাশে বসে জায়গাটা তোকে চিনিয়ে দিয়ে সত্যিটা বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি তুই কোনওদিন এখানে হানা দিবি সিআইডি কর্মকর্তার মতো। তবে এরপর আর কোনওদিন এখানে আসিস না। কাউকে বলবি না এই আস্তানার কথা। আমার কাজের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে এই পরিত্যক্ত রেল স্টেশনের পুরো এলাকাটায়, এসবে জড়ালে তোরই তি হবে। প্রশ্ন করতে পারিস কেন তোর সাথে বন্ধুত্বের ভান করলাম?
না, ভান আমি করিনি। অন্য সব লোভের সাথে তোর ভালোবাসা পাওয়ার লোভও ছিল আমার। তোর সাথে যেটুকু সময় আমি কাটিয়েছি, ওটুকু সময় ভদ্র পরোপকারী অতিভালো বিশ্বস্ত যুবকের এক বন্ধুর চেহারায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগতো। দ্বিখন্ডিত অনিকেতের তোর প্রতি ভালোবাসা মিথ্যা ছিল না। কিন্তু সমগ্র আমি সেই মানুষটি একেবারেই অচেনা অন্ধকারের। উত্তর দেওয়ার বদলে অদ্রির সারা  অস্তিত্ব ঘৃণায় জ্বলে উঠলো। আগুনেরও একটা শব্দ আছে। অদ্রি তা শুনছে।
- এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছা করছে না। আমার যেতে হবে।
- অত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই অদ্রি। হ্যাঁ, আমার সাথেই তো আজ বসার কথা ৮টায়। তুই মন্টুর দোকানে থাকিস। আমি ঠিক সময়ে হাজির হয়ে যাবো।

অনিকেতের কণ্ঠস্বরে কোনো মাতলামি না থাকলেও নরম মাতাল আবেগে সে জড়িয়ে ছিল। অদ্রি পরিত্যক্ত রেল লাইনের ওপর দিয়ে ভারী পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। একা।   সমস্ত অস্তিত্ব তবিত। তবু চলতে হবে। কেন? আরও কী জানার আছে ওর? জানতে জানতে সে মৃত্যুঘরের কাছাকাছি চলে গেছে। সে কি মৃত্যুকেও দেখে এলো? ওর বন্ধু অনিকেতের মৃত্যু?

এখন অন্ধকার থেকে আলোর শহরে অদ্রি। হ্যাঁ, এটা ব্যস্ত কোলাহলের শহর। সে নিজের মুখোমুখি হয়। সে জানতে চাইবে অনিকেতের কাছে, টাকাটা সে কীভাবে ফেরত পাবে? ওর আরেকটা বিবেকের তাগিদ থাকবে অনিকেতকে ওই পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা...।

ছোট্ট ঘরে লোডশেডিংয়ে মোমের ঝপসা আলোটাই ভরসা। মোমবাতির হালকা নীলচে বাদামি আলোর রঙে অনিকেতের চেহারা অদ্রি ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। অনিকেতও হয়তো নিজের চিরচেনা জায়গায় অভ্যস্ত চোখেও সেরকম দেখতে পাচ্ছে না অদ্রিকে।
-তুই আসতে বলেছিলি কেন?
- হুঁ, আসতে বলেছিলাম কেন, না? টাকাটা  ফিরিয়ে দেব কাল অথবা পরশু সেটা আলাপ করতে।
দুজনের কণ্ঠস্বরে অস্বস্তি ধরা পড়ে। কিন্তু মুখ দুটোর পরিবর্তনের রেখাগুলো আড়াল হয়ে যায় বিনা চেষ্টায়, অদ্রির কণ্ঠস্বর তবু সরল রেখায়ই চলে-
-এভাবেই চলবে তোর জীবন? তুই এটা? উফ! ভাবতেও গা শিউরে উঠছে। তোকে দেখলে আমার ভয় করছে।
-কিসের ভয়?
-মানুষ এত বীভৎস!
- হ্যাঁ, একমাত্র মানুষকেই বীভৎস দেখায়। কারণ, মানুষ নিজের মুখ ইচ্ছেমতো পাল্টাতে পারে নিজের সুচতুর কৌশলে। প্রাণীকুলের আর কেউ তা পারে না। একদিন এই মুখ তুই সুন্দর দেখেছিলি। এই একই আমাকে আজ আবার কুৎসিত চেহারায় দেখছিস। সেটা তো আমি নিজের প্রয়োজনে করেছি। গ্রাম থেকে যেদিন শহরে এলাম দেখলাম চারদিক এতো ঝলমলে চকচকে। কিন্তু আমার জীবন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। আমি বাঁচতে চাইলাম, স্রেফ খেয়েপরে। কিন্তু এই শহর আমাকে তার চেয়েও বেশি কিছু দিল। কাঁচা টাকা, অস্ত্র, নিষিদ্ধ মেয়েমানুষ, সুখ, যন্ত্রণা সব সব দিল। আমি প্রজাপতি থেকে শুঁয়োপোকা হয়ে সুন্দরতাকে হারালাম। প্রকৃতির নিয়মকে মানলাম না। তাই, সুন্দরের বদলে অসুন্দর বেঁচে থাকলো আমার মধ্যে। উল্টো জীবনপ্রবাহে আমি নষ্ট মানুষে পরিণত হয়েছি।
-তুই কি বিয়ে করেছিস?
-এক ব্রথেল মেয়ে আমাকে ভালোবাসে। হরিণ চোখের মিষ্টি মেয়ে, রঙটা কালো। তাই ওর নাম দিয়েছি কৃষ্ণকলি। ওকেই বিয়ে করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
-মনে হচ্ছে তুই অনিকেত না অন্য একটা মানুষ।
-অদ্রি, এর উত্তর দেওয়া এখন নিরর্থক।
-তোর বাবা-মা তোকে দেখতে চান না, বাড়িতে যেতে বলেন না? তুই দেশে ফিরে যা।
-না, সে আর হবার নয়। মা ডাকে, বাবা নয়। আমি যাবো না। মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়, এটুকুই। অহেতুক যাওয়া-আসার ন্যাকামি আমার ভালো লাগে না। আমি যে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তার মধ্যেই থাকতে চাই। আর এতোদিন তোকে ছাড়তে পারিনি, হয়তো একটা ভদ্র জীবনযাপন কাছ থেকে দেখার ইচ্ছা ছিল। এবার তাও ছাড়তে হবে। ঘৃণা আর ভালোবাসা একসাথে থাকতে পারে না। চিন্তা করিস না টাকাটা তুই পেয়ে যাবি। তোর সাথে আমার কালপরশু দেখা হবে। টাকাটা কীভাবে অন্যের হাতে চলে গেল সেই কাহিনী তখনই বলবো তোকে।
-অনিকেত, আমি তোর জন্য চাকরির চেষ্টা করবো অথবা অল্প পুঁজিতে কীভাবে ব্যবসা করা যায় উপায় বের করতে হবে আমাদের। তাছাড়া তুই নিজেও সেটা পারবি।
-না পারবো না। চাকরি বা ব্যবসার জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন, আমার সেটা নেই। আমি একসময় পেয়িং গেস্টের চাকরি পেয়েছিলাম। ওদের বলেছিলাম বিএ পাস। অথচ আমি এসএসসিও পাস করিনি। তবে, আমি পড়াতাম ভালো। আমার ছাত্রী মেয়েটি বোবা ছিল। একসময় ওর গার্জেনরা আমার সাথে ওর বিয়ে দিতে চাইলো। আমি চাইনি। ওখান থেকে পালিয়ে গেলাম। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছিল ওঁরা। ওটা আমি সাফ করে সেই যে উধাও হলাম, ওই সীমানায় কোনওদিন আর যাইনি।
-এখনও সময় আছে, তুই সুস্থ জীবনে ফিরে আয়। ওই অন্ধকার জগৎ তোকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছিস না। জীবনের জন্য আলোর দরকার। ঘরসংসার কর সমাজের আর সবার মতো।
-ঘরসংসার! আলো! হাসালি! হুঁ--অন্ধকার। অন্ধকারই তো আমার আলো। চোখ বন্ধ করলে সেই আলোকে দেখতে পাই।
-ওই রেল লাইনের ধারের ভাঙা প্রাসাদে একদিন গুলি খেয়ে পড়ে থাকবি, আর কিছুই করার থাকবে না তখন।
- হুঁম! পরাজিত রাজা!

বাতাসে মোমবাতিটা এধার-ওধার করে দপ দপ করছিল। অদ্রি উঠে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে লোকারণ্যে মিলিয়ে গেল।
অনিকেত ওর কিছু দরকারি কাগজপত্র ও কাপড়চোপড় একটা হ্যান্ডব্যাগে আগেই পুরে রেখেছিল। ওর একরুমের ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে, চাবিটা গ্যারেজে লাগানো পেরেকে ঝুলিয়ে, বাসা ছেড়ে চলে গেল সেদিনই গভীর রাতে...।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫১৫, সেপ্টেম্বর ০৪, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।