ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

আবদুল মান্নান সৈয়দ: অতৃপ্ত ও অস্তিত্ববাদীর প্রস্থান

আনোয়ারুল করিম রাজু | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১০
আবদুল মান্নান সৈয়দ: অতৃপ্ত ও অস্তিত্ববাদীর প্রস্থান

বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন ব্যতিক্রমী এক ব্যক্তিত্ব। যিনি সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই পদচারণা করেছেন।

ষাটের দশকে বাংলা সাহিত্যে তার আবির্ভাব। চার দশকেরও বশি সময় ধরে তিনি লেখালেখি ও গবেষণা করে গেছেন।

কবি, লেখক কিংবা গবেষক যাই বলা হোক না কেন, মানুষ হিসেবে আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন একজন অস্তিত্ববাদী। সাহিত্যিক মহলে সৌন্দর্য ও কললাকৈবল্যবাদী হিসেবেও গণ্য করা হতো তাকে। যদিও তিনি নিজেকে জীবনবাদী হিসেবেই ভাবতেন।

জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি নিজেকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছিলেন। সেইসঙ্গে তার ফেলে আসা দিনগুলোর কাজ নিয়েও সন্তষ্ট হতে পারছিলেন না। প্রকৃত শিল্পীর মতো এক ধরনের অতৃপ্তি তাকে ঘিরে ছিল। তিনি চেয়েছিলেন আরও গবেষণা। অথচ মাত্র ৬৭ বছর বয়সেই চলে গেলেন তিনি। ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে বিদায় নিলেন অতৃপ্ত এক কবি।

গতবছর এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, ‘পরাবাস্তববাদী নই, আমি এখন নিজেকে মনে করি অস্তিত্ববাদী। ’

তিনি মনে করতেন পরাবাস্তববাদ মুক্তির কোনো উপায় নয়, কারণ এটা কোনো ছবি দেখায় না। কিন্তু অস্তিত্ববাদ মানে হচ্ছে নিজের অস্তিত্বকে নিজেই অর্থবান করে তোলা।

মান্নান সৈয়দ সেদিন বলেছিলেন, ‘জীবনভর আমার অস্তিত্বকে আমি আমার অজ্ঞাতসারেই অর্থময় করে তুলেছি। আমি মার্কস-লেনিনের ভক্ত এখন। আমি এখন বিশ্বাস করি যে এটাই মুক্তির উপায়। ’  

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পরিভ্রমণকারী আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে জীবন দর্শনের মূল্যায়ন করে বলেছিলেন, ‘একটা বয়সে এসে বুঝতে পারছি, আমি চারপাশে তাকাইনি। দ্বিতীয়বার হৃদরোগের পরে, দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থেকে আমি আমার আশপাশে মানুষদের দেখলাম- আমার পাড়ার মানুষেরা, বাজারের লোকজন, খুব সাধারণ মানুষদের। বুঝতে পারছি, যাদের দিয়ে আমার জীবন চলছে, তাদের জন্য আমি কোনো কিছু করিনি। ’

আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, ‘ইজম নিয়ে ব্যবসা করা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমার ব্যবসা একটাই, তা সাহিত্য। এখন আমি চাই, শুধু সাহিত্যের মধ্য দিয়ে না, নিজের জীবন দিয়ে যদি সেটা করা যায়। যেমন, তলস্তয়, ভিক্তর হুগো- এরা হচ্ছেন প্রকৃত বড় লেখক। রবীন্দ্রনাথ বা গ্যেটে- এরা ওই লেভেলের না। কারণ, জীবন দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, আপনি মানুষকে ভালোবাসছেন। ’

আবদুল মান্নান সৈয়দ তার ৬৬তম জন্মদিনের আগে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘রিকশাওয়ালার ওপর গল্প-উপন্যাস লিখলে হবে না, নিজে রিকশা চালিয়ে দেখুন, রিকশা চালানোর পরিশ্রম কী?’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আক্ষেপ হয়, এমন একটা সময়ে আমার এই উপলব্ধি হলো যখন শারীরিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছি, যখন আমার কর্মক্ষমতা কমে গেছে। তবে সাহিত্যের যে সামাজিক দায়িত্ব, আমি বোধহয় সেটা অনেকের চেয়ে বেশি পালন করে গেছি। ’

মান্নান সৈয়দ বলতেন, তিনি সাহিত্যে কোনো ‘বিভাজন’ করেন না।   বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম প্রবোধচন্দ্র সেনের জীবনী লেখেন। আবার আব্দুল গনি হাজারী, সৈয়দ মুর্তজা আলীর জীবনীও লিখেছেন। তিনি শাহাদাত হোসেনের ইসলামী কবিতা যেমন সম্পাদনা করেছেন, তেমনি কমরেড মোজাফফর আহমদের পত্রাবলীও সম্পাদনা করেছেন। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নজরুল চর্চা করেন।

কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ এমন একজন মানুষ যিনি দীর্ঘ সময় ধরে দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক সংগ্রামের মতো পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের দু’টি পত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন। এ প্রসঙ্গে মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন, ‘কারণ, সাহিত্যকে আমি বিভাজন করিনি। ’

পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার করতে কবি সেদিন উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘ষাটের দশকে সমকাল ছিল প্রতিষ্ঠিতদের পত্রিকা; কণ্ঠস্বর ছিল তরুণদের কাগজ। আমি ছিলাম দুই কাগজেরই প্রধান লেখক। ’

আবদুল মান্নান সৈয়দ তার গবেষণা প্রসঙ্গেও একই আদর্শ লালন করে গেছেন। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি মানিক গবেষক, আবার কায়কোবাদ গবেষকও। ’

এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘গবেষক হিসেবে আরেকটা বিষয় আমার মধ্যে কাজ করেছে। যেমন কলকাতায় মানিককে নিয়ে যখন গবেষণা করেছি তখন নিজের মধ্যে একটা দায়িত্ববোধ থেকেই তা করেছি। যেমন, আমি যে ধর্মীয় সমাজ থেকে এসেছি সে সমাজের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে। কলকাতা থেকে এসেই আমি ভাবলাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ওপর আমার একটা বই লেখা উচিত। পরিশ্রম করে লিখেও ফেললাম। ’

শেষ জীবনে এসে মান্নান সৈয়দ তার গবেষক সত্তার আরও বিস্তৃতি ঘটাতে চেয়েছিলেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘মাইকেল সম্পর্কে, বঙ্কিমের উপন্যাস সম্পর্কে আমার লেখার ইচ্ছা আছে। ফররুখ আহমেদ একজন বিরাট লেখক। আমার একটা আক্ষেপ, এত বড় কবি জসীমউদ্দীন, তার ওপর আমি কোনো কাজ করিনি। জীবনানন্দকে নিয়ে আমি যে কাজটা করেছি, মানিক বন্দোপাধ্যায়কে নিয়েও সে রকম কাজ করা আমার উচিত ছিল। ’

আনোয়ারুল করিম রাজু: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’র সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।