ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

‘রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারেনি’: আবদুল মান্নান সৈয়দ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১০
‘রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারেনি’: আবদুল মান্নান সৈয়দ

৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ প্রয়াত হয়েছেন কবি-গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ। ২০০৮ সালের আগস্টের প্রথম দিকে গিয়েছিলাম তার গ্রিন রোডের বাসায় সাক্ষাৎকার নিতে।

আমাদের সামনে তখন উপলক্ষ বলতে ছিল ৩ আগস্ট তার জন্মদিন এবং এর ৪ দিন পরই ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন। ফলে আমাদের কথা হয় মূলত মান্নান সৈয়দের রবীন্দ্রপাঠ ও রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে তার ভাবনা নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি তখন ছাপা হয়েছিল একটি জাতীয় দৈনিকে।

বাসায় যেতেই মান্নান ভাই ভাবীকে বললেন চা আর বিস্কুট দিতে। খাবার খেতে খেতেই শুরু হয়ে যায় আমাদের আলাপ। আলাপের এক ফাঁকে আমরা গাবও খেয়েছিলাম। মান্নান ভাই তাঁর বিখ্যাত অভিজাত হাসিটি দিয়ে বলেছিলেন,‍‌‍"রবীন্দ্রনাথ খাবার খেতে খুব পছন্দ করতেন। গাব খেতে খেতে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা করাটা একটু অন্যরকমের ব্যাপার। "

রবীন্দ্রনাথের দেড়শোতম জয়ন্তি আর আমাদের সমকালের একজন মনস্বী কবি-গবেষকের প্রয়াণ এই সাক্ষাৎকারটিকে আবারও প্রাসংগিক করে তুলেছে। বাংলানিউজের পাঠকের জন্য এটি আবারও মুদ্রিত হলো।  

ফেরদৌস মাহমুদ : মান্নান ভাই, আপনার জন্মদিনের চারদিন পরই তো ২২ শ্রাবণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিন। আপনি শেষ রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লেন কবে?

আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমি এখন যেটা করি, প্রায় রোজই রবীন্দ্রনাথ শুনি এবং `গীতবিতান` আমার কাছে থাকে। রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকি। আগে নয়, এ ২০০৬-০৭ কিংবা ২০০৮-এ আমি রবীন্দ্রসংগীতকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথের আমার শেষ প্রিয় গান `আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো`। আরও যোগ করা উচিত, কেউ কেউ আমাকে রবীন্দ্রসংগীতের খেই ধরিয়ে দেয়। আর `শেষের কবিতা` থেকে, কবিতা ও গদ্যের উদ্ধৃতি শুনিয়ে আমাকে জাগ্রত রাখেন। কয়েকদিন আগে `রক্তকরবী` নাটকটি নতুন করে পড়লাম এবং আবার অভিভূত হলাম।

: আপনার জীবনযাপনের সঙ্গে রবীন্দ্র সাহিত্যের সম্পর্কটা কেমন।

আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথের কিছু গান ও কবিতার অর্থ বেশ কিছুকাল হলো আমার কাছে নতুনভাবে উদ্ভাসিত হলো। কেননা আমি যে কোনোভাবেই হোক রাবীন্দ্রিক ওই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছি।
 
:দুই বোন` উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বর্ষা ঋতুকে বলেছিলেন `মা` আর বসন্ত ঋতুকে `প্রিয়া`। রবীন্দ্রনাথের বর্ষা আর বসন্ত বিষয়ক ভাবনাকে সামনে রেখেই এ বিষয়ে আপনার উপলব্ধিটা শুনতে চাচ্ছি।

আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথের সময়ের বর্ষাকাল থেকে আমাদের বর্ষাকাল তো একটু আলাদা হয়ে গেছে। আমার কাছে বর্ষাকাল প্রিয়তম ঋতু। অনেক বছর পর এবারের ১৪১৫-এর আষাঢ়-শ্রাবণ যে অবিশ্রাম বারিধারা ছড়িয়ে দিল, তা অসম্ভব ভালো লাগল। মনে হলো খানিকটা যেন ছেলেবেলায় ফিরে যাচ্ছি। তবে আগের মতো তিন-চার দিন ধরে বিরামহীন বৃষ্টি-বাদল, এখন আর তা দেখি না। বসন্ত ভালোই। কিন্তু আমাদের কাছে বর্ষাকালই বসন্তকাল। এই যে গতকাল বা পরশু সবুজ-হলদে আর কমলা তিনটে কদম ফুল নিয়ে এসেছি, এর রূপ কে বর্ণনা করবে? গাছের পাতাই যেন ফুলে রূপান্তরিত হয়েছে। শুধু একটাই অনুরোধ, গাছ কেটে আমাদের এই সবুজ দেশটাকে আর যেন মরুভূমিতে পরিণত না করা হয়।

: রবীন্দ্রনাথ তাঁর তরুণ বয়সে একবার মধুসূদনের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আবার অনেক পরে তিনি মধুসূদনকে স্বীকারও করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আবদুল মান্নান সৈয়দ : আসলে যেটা হয়েছে, আমি একটু সত্যভাষণ করতে চাই; মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুজনই মানুষ ছিলেন। দুজনই মহৎ কবি বলে আমি বিশ্বাস করি। কথার কথা নয়, এরা চিরকালের বাংলা সাহিত্যের`গ্রেট পোয়েট`। কিন্তু কবিরা তো মানুষ। দেখুন, মাইকেল তাঁর অগ্রজ বিদেশি কবিদের তো বটেই বাঙালি কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাসকেও অগাধ শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। এমনকি ঈশ্বর গুপ্তকেও। কিন্তু মাইকেল-পূর্ববর্তী শ্রেষ্ঠ কবি, অসাধারণ কবি ভারতচন্দ্র রায় সম্পর্কে মাইকেল ছিলেন নীরব কিংবা পরোক্ষ। চিঠিপত্রে ভারতচন্দ্রের নাম উল্লেখ না করে তিনি লিখতেন `কৃষ্ণনগরের সেই ভদ্রলোক`। এদিকে ভারতচন্দ্রকে নিয়ে না লিখলেও ভারতচন্দ্রের সৃষ্ট `অন্নদামঙ্গল`-এর দুই চরিত্রকে নিয়ে মাইকেল কিন্তু সনেট লিখেছেন। একটা`ঈশ্বরির পাটনি`; আরেকটার নাম ঠিক মনে পড়ছে না এখন।
তেমনি রবীন্দ্রনাথেরও আগের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ফলে রবীন্দ্রনাথকে নতুন পথ খুঁজতে হয়েছে। মাইকেলকে অস্বীকার না করে উপায় ছিল না তাঁর। এটা আমাদের একটু মানবিক দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সংযম সত্ত্বেও দু-একবার তিনি খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। `যোগাযোগ` উপন্যাসের সেই মারাত্মক চরিত্রটার নাম মনে আছে তো `মধুসূদন`। যে কুমুর জীবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। এত নাম থাকতে `যোগাযোগ` উপন্যাসের এ ভিলেন চরিত্রটির নাম রবীন্দ্রনাথ `মধুসূদন` না দিলেই পারতেন।

আবার আরেকবার বনফুলের `শ্রী মধুসূদন` নামের অসাধারণ নাটকটি পড়ার পর রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে বলেছিলেন তাঁকে নিয়ে অনুরূপ নাটক লেখা যায় কি না। এমনকি তিনি ওই নাটকের কোনো কোনো অংশ সম্পর্কে আপত্তিও তুলেছিলেন। এরকম মানবিক দুর্বলতা আর এরকম প্রবণতা পরবর্তী লেখক-কবিদের মধ্যেও আছে। কিন্তু এই সময়ে বাংলাদেশে পরশ্রীকাতরতা বোধ হয় সীমা ছাড়িয়েছে।

: মাইকেলের কবিতার প্রভাব কখনো কি রবীন্দ্রনাথে পড়েনি?

আবদুল মান্নান সৈয়দ : কোনো কোনো ক্ষেত্রে পড়েছে তো অবশ্যই। যেমন- মাইকেলের `কপোতাক্ষ নদ` কবিতার অনুসরণেই রবীন্দ্রনাথের `ইছামতি` একটি কবিতা আছে। তবে রবীন্দ্রনাথ যেহেতু মাইকেলের পরের লেখক, এক্ষেত্রে এ বিষয়টাতে আমি কোনো দোষের ব্যাপার দেখি না।

: রবীন্দ্রনাথকে আমাদের এখানে কিছু শুচিবায়ুগ্রস্ত লোক এক ধরনের বৃদ্ধ ঋষি হিসেবে তুলে ধরেছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে খুব সহজভাবে কথা বলা যায় না। আমার মনে হয় বিষয়টা রবীন্দ্রনাথ পাঠে আগ্রহী হওয়ার ব্যাপারে একটা বড় বাধা। অথচ আমরা যখন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখা পড়ি একজন চিন্তাশীল তরুণ-টিনএজারের দেখাই যেন পাই। এর প্রমাণ তাঁর শেষ বয়সের উপন্যাস `শেষের কবিতা` পড়লেও পাওয়া যাবে। আপনি এ বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন?

আবদুল মান্নান সৈয়দ : চমৎকার এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। বছর ত্রিশ আগে আশির দশকের গোড়ায়, রবীন্দ্রসংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ওয়াহিদ ভাই- আমাকে এরকম প্রশ্নই করেন। তিনি বলেছিলেন, বছর দশেক হয়ে গেল বাংলাদেশ হয়েছে রবীন্দ্রচর্চা তেমন হচ্ছে না কেন? আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম এবং এখনও তাই-ই বলব- তেমনভাবে রবীন্দ্রপ্রেমী নেই বলে। রবীন্দ্রচর্চার জন্য সবার আগে প্রেমিক হতে হবে। প্রকৃতার্থে বোদ্ধা হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অত সহজ নয়। ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবণে হৈচৈ করে, গান গেয়ে, বক্তৃতা দিয়ে রবীন্দ্রপ্রেমের কোনো সাক্ষর রাখা যায় না। রবীন্দ্রনাথকে অনেকেই ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারেনি, ফলে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তারা একটা ভুল শিক্ষা গ্রহণ করেছে- যথেচ্ছাচার।

রবীন্দ্রনাথের নামে ব্যবসা করার রেওয়াজ পশ্চিম বাংলাতেও আছে, বাংলাদেশেও কম নেই। খোদ বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথ নিজে প্রতিষ্ঠা করলেও, ষাট বছর ধরে কাজ করলেও `রবীন্দ্র রচনাবলী` সম্পূর্ণ করতে পারেনি। এর চেয়ে দুঃখের কথা আর কী হতে পারে? রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোও একত্র করতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বভারতী। এখন তো রবীন্দ্রনাথ লুটের মাল। রবীন্দ্রনাথের ঋষিত্ব মিথ্যা নয়; কিন্তু তার তারুণ্যও সমানভাবে সত্য।

এমনসব রবীন্দ্রসংগীত আছে যা শুনলে মনে হবে আধুনিক বাংলা গান শুনছেন। রবীন্দ্রনাথের একটি নাটক পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এ তো রাম বসুর কবিতা। রবীন্দ্রনাথ এক অফুরন্ত উৎস। আমি চাইব রবীন্দ্রনাথে নিমজ্জিত হন তরুণরা।

এ বছর বইমেলায় `মাতাল কবিতা পাগল গদ্য` নামে আমার একটি বই বেরিয়েছে। তাতে`গান`নামে আমার একটা গদ্য রচনা আছে। আমি তো বেশ খুশি যে- গদ্যে গান লিখলাম, পরে `গীতবিতানেই` দেখি বহু আগেই মিলহীন গদ্য-গান লিখে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। দেখে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্বের সত্যকে কে অস্বীকার করবে!

: ত্রিশের কবিতায় যে নতুন কবিতার সূত্রপাত এখানে যেন রবীন্দ্রনাথ ঠিক মানসিকভাবে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাঁর ওই সময়কার অনেক লেখা পড়লে মনে হয়, এ নতুনত্ব গ্রহণের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সংশয়ী। এ নতুন পথকে কখনো কখনো বিদ্রূপও করেছেন। সাহিত্যের এ নতুন প্রবণতা নিয়ে তাঁর এই বিদ্রূপ আর সংশয়ের পেছনের কারণটা কি বলে আপনি মনে করেন?

আবদুল মান্নান সৈয়দ : ওই যে আগে আমি বলেছি রবীন্দ্রনাথও মানুষ ছিলেন। যে-কবি অক্ষয়কুমার বড়ালের সঙ্গে লেখা শুরু করলেন তিনি যে সমর সেনকে স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন এই কি যথেষ্ট নয়? তবে আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথ খুব অন্তর থেকে বুঝেছিলেন, অসংশয়ে গ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস।

তিরিশের কবি-কথাশিল্পীদের সম্পর্কে যেটুকু প্রশংসা আমরা পাই তাঁর কাছ থেকে আমার তো মনে হয়- সেটুকুতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সৎ শিল্পী। কাজেই তাঁর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংশয়গুলোও তিনি লুকোননি। এজন্যই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমার আরও বেশি। আমার মনে হয় তিনি যদি ওই সংশয়গুলি স্পষ্টভাবে প্রকাশ না করে নীরব থাকতেন, ওটা হতো ভণ্ডামি।

: রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে বলুন ?

আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথ কিন্তু চলচ্চিত্র নিয়ে অসাধারণ ভবিষ্যদ্দর্শী। এ নিয়ে তিনি একটা চিঠি লিখেছিলেন একজনকে। এটা চলচ্চিত্রে আগ্রহী সবারই প্রথম পাঠ্য হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের তিনটি গল্প নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের করা তিনটা সিনেমা রয়েছে,ওইগুলো আমি দেখেছি। আমি মনে করি না সত্যজিৎ যথার্থভাবে ওখানে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলোকে তুলে ধরতে পেরেছেন। তবে এটাও তো ঠিক, চলচ্চিত্রের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা এক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, চলচ্চিত্র নিয়ে যত উন্মাদনাই থাকুক, যতই তার সর্বগ্রাসী ভূমিকা থাকুক- সাহিত্যই উন্নততর মাধ্যম।

: রবীন্দ্রনাথ লিখতে লিখতে একসময় যে কাটাছেঁড়া করতেন, পরর্তীকালে সেগুলোর চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে। এই প্রসঙ্গ ধরেই তাঁর চিত্রকলা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা শুনতে চাচ্ছি।

আবদুল মান্নান সৈয়দ : আমরা তো দেখেছি ফরাসি কবি অ্যাপোলিয়ানের হাতে এক ধরনের নকশি করা কবিতা। কাটাকুটি করা রবীন্দ্রনাথের কবিতা যেগুলো, সেগুলো ছবি আর কবিতার একটা মিশ্র মাধ্যম বলে আমি মনে করি। রবীন্দ্রনাথ তো ছেলেবেলা থেকে কমবেশি ছবি আঁকার চর্চা করতেন। ক্রমাগত বিদেশ সফরের ফলে তাঁর একটা দৃষ্টিও খুলে যায়। চিত্রকলার ক্ষেত্রে বড় বড় আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই হয়েছে ইউরোপে। হয়তো এদের দ্বারাও কিছুটা রবীন্দ্রনাথ উদ্বুদ্ধ হন। পৃথিবীর মহত্তম শিল্পীদের একজন হচ্ছেন মহাকবি গ্যেটে। তাঁর প্রতি রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ দৃষ্টি ছিল ছেলেবেলা থেকেই। গ্যেটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার এক ধরনের মিলও হয়ত রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তবুও গ্যেটেকে সর্বক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে অনেক বড়ই মনে করি আমি।

সে যাই হোক, ওটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেই বলি, তিনি আসলে চিত্রকলায় এমন কিছু বিষয় উপস্থাপন করেছেন, যা তাঁর পক্ষে সাহিত্যে বলা সম্ভব হয়নি। তখন তিনি `গুরুদেব` হিসেবে চিঠিতে সাক্ষর দিচ্ছেন। চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর গুরুদেবত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছেন। রামকিংকরকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি এখন শ্রেষ্ঠ বাঙালি ভাস্কর- এ তো কল্পনাই করা যায় না।

: রবীন্দ্রনাথের `ছিন্নপত্র` নিয়ে বলুন।

আবদুল মান্নান সৈয়দ : `ছিন্নপত্র` তো ইন্দিরা দেবী চৌধুরীকে লেখা। ইন্দিরা দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মেজদার মেয়ে। অসাধারণ রূপসী ও বিদুষী এক নারী। রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়পাত্রী ছিলেন তিনি। ফলে মন খুলে অনেক কথাই লিখেছিলেন তিনি তাঁর কাছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠিকেই বোধ হয়, বাংলা সাহিত্যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য বলা যেতে পারে।

: রবীন্দ্রনাথের সার্বিক সাহিত্য পাঠ করলে আমরা এক ধরনের সৌন্দর্য সৃষ্টিকারী মুগ্ধতা আর দার্শনিকতার দেখা পাই।

আবদুল মান্নান সৈয়দ : রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ছিল। কিন্তু এসবকে তিনি কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে একটু আনন্দময়তায়, মুগ্ধতায় রূপান্তরিত করার শক্তি রাখতেন। এ শক্তিই প্রতিভাবানের শক্তি। কাকে বলব প্রতিভা? যে তার পারিপার্শ্বিকতাকে অতিক্রম করে যেতে পারে। স্পর্শ করেই অতিক্রম- উন্মাদের অতিক্রম নয়, স্পর্শকারীর অতিক্রম। কঠিন সাধনা। আসলে রবীন্দ্রনাথ যেটা বলেছেন- যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই। তাঁর সাহিত্যজুড়ে এ কথাই প্রতিফলিত হয়েছে।

: সর্বশেষ প্রশ্ন। আপনি তো ইদানীং `গীতবিতান`সহ রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখাতেই ডুবে আছেন। পুনর্পাঠে আপনার নতুন কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে?

আবদুল মান্নান সৈয়দ : হ্যাঁ, হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, দীর্ঘকাল বিশ্বভারতী একটি অন্যায় করে চলেছে। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রনাথের নামে এমন অনেক বই বেরিয়েছে, যেগুলো রবীন্দ্র প্রযোজিত নয়, অন্যদের দ্বারা সম্পাদিত। যেমন- রবীন্দ্রনাথ বের করেছিলেন `ছিন্নপত্র`। পরে বিশ্বভারতী বের করল `ছিন্নপত্রাবলী` নামে একটি বই। রবীন্দ্রনাথ `খ্রিস্ট` বা `বুদ্ধ` নামে কোনো বই লেখেননি। এসব সংকলিত বই। প্রচ্ছদেই পরিষ্কার লেখা উচিত ছিল- কার বা কাদের দ্বারা সংকলিত বা সম্পাদিত। তাহলে আর রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে এত বিভ্রমের সৃষ্টি হতো না। `গীতবিতান`-এর ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। যে `গীতবিতান` আমাদের নিত্যব্যবহার্য, সেটা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পরিকল্পিত বা অভিপ্সিত `গীতবিতান` নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের একেবারে উপান্ত পর্বে- দুই খণ্ডে যে `গীতবিতান` ছেপে রেখেছিলেন, সেই আদর্শ প্রচলিত গীতবিতানে মানা হয়নি। আমার বিবেচনায়- রবীন্দ্র পরিকল্পিত `গীতবিতান` অক্ষুন্ন রেখে পরবর্তী সংযোজন সম্পন্ন হলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি এবং রবীন্দ্রমুগ্ধ আমাদের প্রতি সুবিচার করা হতো।


বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২১৫০ সেপ্টম্বর ৬, ১০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।