ছাত্রলীগের মতো দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বদাতা এমন বৃহৎ সংগঠনের নেতৃত্ব পাওয়ার পরও নিজেকে সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন শোভন। সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত এই ছাত্রনেতা দায়িত্ব পাওয়ার পরও থাকছেন হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলে।
ছাত্রলীগের এই নতুন প্রধান বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন একান্ত আলাপচারিতায়। তিনি বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার প্রেক্ষাপট-প্রস্তুতি বা আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্বের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে।
বাংলানিউজ: আপনি দায়িত্বগ্রহণের আগের ছাত্রলীগ আর পরের ছাত্রলীগের মধ্যে কী পার্থক্য দেখছেন?
শোভন: আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে উঠেছি ২০০৮ সালে, এরপর থেকেই হল ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। ছাত্রলীগের হল ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পর কেন্দ্রীয় কমিটিতেও দায়িত্ব পালন করেছি। যখন কর্মী ছিলাম তখন থেকেই দলটাকে সার্ভ করার চেষ্টা ছিলো। মানুষকে সামনে দিয়ে আমি পেছনে থেকে কীভাবে কতোটুকু করলে দলটা সুন্দর হবে সেই চিন্তা করতাম। তখন দলের কর্মী হিসেবে সব কার্যক্রমেই অংশ নিয়েছি। এখন দেশরত্ন একটা দায়িত্ব দিয়েছেন। দায়িত্বের ভার অনেক, ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু আমি নিজেকে নেতা মনে করি না, কর্মী হিসেবে কর্মীদের মাঝে থেকেই সংগঠনটাকে সার্ভ করতে চাই। কারণ, কর্মীরাই দলের প্রাণ।
বাংলানিউজ: সম্মেলনের দীর্ঘদিন পর ছাত্রলীগের নেতৃত্ব ঘোষণা হয় এবং এর পর প্রায় এক মাস হতে চললো, কবে নাগাদ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হতে পারে?
শোভন: জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর অল্প কিছুদিন বাকি। দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাদের কমিটি করতে বলেছেন। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য যারা মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন তাদের বায়োডাটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে রয়েছে। এখান থেকে তার পরামর্শ অনুযায়ী আমরা একটা কমিটি করে তাকে দেখাবো। এরপর তিনি সবার বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তথ্য নিয়ে অনুমতি দিলে আমরা ফাইনাল করবো। সেটি সেপ্টেম্বরের মধ্যেই করার চেষ্টা করবো।
বাংলানিউজ: ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের কমিটিতে সন্ত্রাসী, মাদকসেবী বা বিশেষ রাজনৈতিক দল থেকে অনুপ্রবেশের মতো ঘটনা ঘটেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার নতুন কমিটিতে অনুপ্রবেশ বন্ধের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি-না?
শোভন: কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী যেন ঢুকতে না পারে, সে বিষয়ে আমরা তৎপর রয়েছি। কেন্দ্রীয় কমিটিতে একজন তখনই পদ পায়, যখন সে ছাত্রলীগের অন্য কোনো ইউনিটে অবদান রাখে। কমপক্ষে বিগত দুইটা কমিটিতে যে পদ হোল্ড করেছে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমরা তার জন্যই সুপারিশ করবো। বিগত কয়েক বছরে দলের জন্য তার কর্মকাণ্ড, দলের প্রতি নিবেদন, বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। আমরা নিজেরা যে কমিটি করবো, সেটা দেশরত্নের কাছে দেবো। তিনি সেটা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেবেন। আমাদের সম্পর্কে তার কাছে নিশ্চয়ই বেশি খোঁজখবর আছে।
বাংলানিউজ: সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের গুজব রুখতে ছাত্রলীগের পদক্ষেপ কী হবে?
শোভন: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ধারা ব্যাহত করতে অনেক আগে থেকেই গুজব চলে আসছে। ১৯৭৪ সালেও বাসন্তির গায়ে জাল জড়িয়ে দুর্ভিক্ষ তথা মঙ্গার কথা বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। সাম্প্রতিক এ গুজব সেই চক্রান্তের বাইরের কিছু নয়। প্রথমত, আমরা প্রত্যাশা করবো- তরুণ প্রজন্ম এবং তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে যেন পারস্পরিক সম্পর্কটা দৃঢ় থাকে। তাহলে তরুণরা আর গুজবে কান দেবে না।
এছাড়া, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াবে। তাদের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়লে আমরা এই গুজবের মোকাবেলা করতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। এর বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা সরকারের কর্মকাণ্ড তুলে ধরবো। যেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত না হয়।
বাংলানিউজ: একাধিক ছাত্র আন্দোলনে একটি স্বার্থান্বেষী মহল রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছে। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন সম্ভাব্য তৎপরতা রোধে ছাত্রলীগের ভূমিকা কী থাকবে?
শোভন: একটা আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে তখন শুরুতে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনই থাকতে দেখেছি। কিন্তু ২-১ দিন পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় জড়িয়ে গেছে। একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী- যারা সবসময়ই বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তারাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ভর করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করেছে। এসব বিষয়ে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বোঝাবো যে, আপনাদের যেসব ন্যায্য দাবি আছে, সঠিক পন্থায় সেগুলো দেশরত্নের কাছে আবদার করবেন। জনগণের এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণ হয় এমন দাবি বঙ্গবন্ধু কন্যা নিশ্চয়ই মেনে নেবেন।
বাংলানিউজ: প্রায় দশ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, সামনের নির্বাচনেও জনগণ কেন আওয়ামী লীগকেই বেছে নেবে বলে মনে করেন?
শোভন: বিগত ১০ বছর ধরে সরকারের কর্মকাণ্ড আপনারা দেখেছেন। শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত দিকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এখন মানুষের জীবন-যাত্রার মান বেড়েছে। এই ১০ বছরে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন তারই কন্যা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা দ্রুতই উন্নত দেশে পরিণত হবো।
সব ক্ষেত্রে এসব উন্নয়নের কথা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ছাত্রলীগ কাজ করবে। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা একটা টিম করে সারাদেশের প্রতিটি প্রান্তে ঘুরে বেড়াবো। আমাদের তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নগুলো আমরা সবার কাছে পৌঁছে দেবো। আওয়ামী লীগ নগরভিত্তিক দল নয়, এটি গ্রামের সাধারণ লোকের দল। সাধারণ লোকেরা আওয়ামী লীগের বিষয়ে জানে, কিন্তু তাদের আরও সচেতন করতে হবে।
বাংলানিউজ: জাতীয় নির্বাচনের খুব বেশি দেরি নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের ভূমিকা কী হবে?
শোভন: বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার সজীব ওয়াজেদ জয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে যার অবদানের কারণে মানুষের জীবন যাত্রার অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। আমরা দেশের নাগরিক থেকে বিশ্বনাগরিকে রূপান্তরিত হয়েছি। সজীব ওয়াজেদ জয় তরুণ প্রজন্মকে নতুন একটা পৃথিবী দেখিয়েছেন। এছাড়া, আমরা দেশরত্নের উন্নয়নের তথ্য জনগণের মধ্যে তুলে ধরবো।
বাংলানিউজ: ইতোপূর্বে ছাত্রলীগে নেতৃত্ব পাওয়ার পর কাউকে কাউকে ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে আয়েশি জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে দেখা যায়। কিন্তু আপনি এর ব্যতিক্রম, হলে থেকেই সাংগঠনিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন…
শোভন: প্রথম কথা হচ্ছে আমি এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ শিক্ষার্থী, সে হিসেবে আমার হলে থাকার অধিকার আছে। আমি হলেই থাকছি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমি ছাত্রলীগের সভাপতি, ছাত্রলীগ ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে এবং ছাত্রদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে। আমি যদি বাইরে থাকি, তাহলে আমার সঙ্গে ছাত্রদের একটা দূরত্ব তৈরি হবে। আমি যদি ক্যাম্পাসে থাকি, সবসময় চলাফেরা করি, সব ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলি তাহলে আমাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক বন্ধন তৈরি হবে। ক্যাম্পাসে থাকলে স্বভাবতই সবার সঙ্গে দেখা হয়। আমি তো ছাত্র-মানুষ, আমার চালচলন, চলাফেরা যদি সবসময় একজন ছাত্রের মতো থাকে তাহলে অন্য ছাত্ররা আমাকে মানবে ও সম্মান দেখাবে।
বাংলানিউজ: ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের কিছু পরিচয়ধারীর বিরুদ্ধে বিতর্কিত কাজে অংশগ্রহণের অভিযোগ শোনা গেছে। আপনার হাত ধরে ভবিষ্যৎ ছাত্রলীগকে কেমন দেখতে চান?
শোভন: ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া সংগঠন। এই ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর কাছে সন্তান সমতুল্য। যেই বাংলার অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু সারাজীবন কষ্ট করেছেন, তার জীবন-যৌবন ব্যয় করেছেন, সেই সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথচলায় ছাত্রলীগ সঙ্গী হয়ে থাকবে। ছাত্রলীগ সভাপতি হিসেবে আমি স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ হাসবে, অর্থনৈতিক-সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে আরও সমৃদ্ধ হবে।
বাংলানিউজ: ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে দেশের ছাত্রসমাজ তথা জনগণের উদ্দেশ্যে…
শোভন: আমরা সেই বাংলাদেশের জন্ম চেয়েছি, যেই বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। আমরা অসাম্প্রদায়িক, সুখী-সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়তে আসন্ন নির্বাচনে আমরা জনগণের সমর্থন প্রত্যাশা করবো।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৮
পিএম/এইচএ/