ঢাকা, শনিবার, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

পঞ্জিকা সংস্কার এবং বাংলা তারিখ বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে

শামসুজ্জামান খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১২
পঞ্জিকা সংস্কার এবং বাংলা তারিখ বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে

১৯৫০-এর দশক থেকে বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার শুরু হয়। প্রথমে ভারত সরকার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহাকে প্রধান করে ভারতবর্ষে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে।

১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে প্রফেসর মেঘনাদ সাহা এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে পঞ্জিকা সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন।

ড. সাহা-কমিটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা করে ভারতীয় পঞ্জিকা শকাব্দ পুনর্বিন্যাস করেন, সেই সঙ্গে তিনি তার রিপোর্টে বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ঢাকার বাংলা একাডেমী ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি পঞ্জিকা-সংস্কার কমিটি গঠন করে। এ কমিটি মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. সাহার সংস্কার প্রস্তাবের মর্মানুযায়ীই বাংলাদেশে বাংলাপঞ্জিকা সংস্কারের প্রস্তাব করে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র প্রতি মাস ৩০ দিনে গণ্য করা হবে এবং যে বছরে লিপ-ইয়ার বা অধিবর্ষ হবে সে বছরে চৈত্র মাস হবে ৩১ দিনে। আশির দশকে বাংলা একাডেমী কর্তৃক একটি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের আরো উন্নতি সাধন করা হয়। তাতে বলা হয়, মাসের দিন নির্ধারণের পূর্বোক্ত পদ্ধতি বলবৎ থাকবে। তবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অধিবর্ষে যে বাংলা বছরে ফাল্গুন মাস পড়বে সেই বাংলার বছরকে অধিবর্ষ গণ্য করা হবে। অধিবর্ষে চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুন মাসে ৩১ দিন হবে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তন হবে। বাংলা একাডেমী প্রবর্তিত বাংলা সনের এ সংস্কার সব সরকার গ্রহণ করেছে এবং এখন তা সারাদেশে সরকারিভাবে চালু রয়েছে।

ভারতবর্ষে মেঘনাদ সাহার মতো প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং বিজ্ঞানী পঞ্জিকা সংস্কার করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলা তারিখে একদিনের হেরফের হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলা একাডেমী পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। এবং এর ফলে বাংলা তারিখ নিয়ে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে তার দায় বাংলাদেশের। এ বক্তব্য এবং যুক্তি যে অবৈজ্ঞানিক, অসত্য এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আমরা তা ভারতবর্ষের পঞ্জিকাবিশেষজ্ঞ এবং Indian Journal of History of Science 39.4 (2004) 519-534  সংখ্যার বিস্তৃত তথ্যমূলক প্রবন্ধ থেকে প্রমাণ করবো।

ড. সাহা কমিটির প্রস্তাব যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার প্রফেসর এসপি পাণ্ডের সভাপতিত্বে আরেকটি পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। এ কমিটি ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে তাদের রিপোর্ট পেশ করে। এ কমিটি ভারতবর্ষের ঐতিহ্যগত, ধর্মসম্পৃক্ত নানা বিষয় বিবেচনা করে দেখেনি। এবং এ কাজে পঞ্জিকাকার বা জ্যোতিষীদেরও প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়। কমিটি দীর্ঘ যুক্তিতর্ক এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের পর ড. মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকা সংস্কারের সায়ন পদ্ধতি থেকে ঐতিহ্যগত নিরায়ন পদ্ধতিতে ফিরে আসেন এবং আরো দু’একটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধন করেন। তবে তারা মেঘনাদ সাহার মতো পূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানভিত্তিক বা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন না করেও একটি সুষ্ঠু ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। ভারত সরকার পাণ্ডেকমিটির উপর্যুক্ত প্রস্তাব বিচার-বিশ্লেষণ করে ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে তা গ্রহণ করে।

বর্তমান লেখায় পাণ্ডেকমিটির বিস্তারিত ও অনুপুঙ্খ বিবরণ দেয়ার সুযোগ নেই। তবে আমরা মূল বিষয়গুলো উল্লেখ করেই বোঝাতে পারবো বাংলা পঞ্জিকার সংস্কারে বাংলাদেশের সাহসী পদক্ষেপ ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞদের মতের মোটেই বিরোধী নয়; বরং বলা চলে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা বাংলা সন সংস্কারের যে নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে তা-ই বাংলাদেশের পঞ্জিকাবিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতেরা গ্রহণ করেছেন। এর কারণ হলো, বিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় ভারত-বাংলাদেশসহ সব দেশের সিদ্ধান্ত তো একই হবে, হয়েছেও তাই। অথচ না জেনে, না বুঝে কিছু কিছু শিক্ষিত লোকও পঞ্জিকা সংস্কার এবং দুই দেশে তারিখের হেরফেরের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করে থাকেন।

পাণ্ডে-কমিটিতে শুধু পঞ্জিকাবিশেষজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ছিলেন না, ড. বিভি রমণ নামে এক জ্যোতিষী এবং দ্বৈবজ্ঞ পঞ্জিকাকারও ছিলেন। তাদের সুবিবেচিত এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত হলো ‘The year shall start with the month of vaishkha when the sun enters nirayana mesarasi, which will be 14th April of the Gregorian calendar’ অর্থাৎ ভারতীয় পঞ্জিকাবিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি সুস্পষ্টভাবে ১৪ এপ্রিলকে প্রতি বছর বাংলার নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং ভারত সরকার ২০০২ সালে তা গ্রহণ করেছে। এছাড়া ফাল্গুন মাসের ৩১ তারিখ যে অধিবর্ষ হবে তাও তারা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং এটাও নির্ধারণ করেছেন যে রাত ১২টায় নতুন দিনের সূচনা হবে। বাংলাদেশের পঞ্জিকা সংস্কারেও এ সিদ্ধান্তগুলোই গ্রহণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের মতোই তা গ্রহণ করেছে এবং তার বাস্তবায়নও করা হয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে ৪-৫টি বৃহৎ পঞ্জিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বার্থের কাছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাথা নত করায় সংস্কারকৃত পঞ্জিকাটি পশ্চিমবঙ্গে গৃহীত হতে পারেনি। তারা এখনো মান্ধাতা আমলে আছে এবং দ্বৈবজ্ঞদের রহস্যময় ও গোপন পদ্ধতিতে নির্মিত পঞ্জিকাকেই ব্যবহার করে চলেছে। এ মূঢ়তার ও অবিমৃশ্যকারিতার দায় বাংলাদেশের ওপর কেন বর্তাবে?

shamsujjamankhanশামসুজ্জামান খান: ফোকলোরবিদ,
মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শিল্প-সাহিত্য এর সর্বশেষ