ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১২
শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব, জীবিত কিংবদন্তিদের অন্যতম, দৈনিক জনকন্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক, সাংবাদিক তোয়াব খানের ৭৯ তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল জন্ম হয় তার।

অর্ধ শতাব্দী ধরে সাংবাদিকতায় তার সক্রিয় বিচরণ। ১৯৫৩ সালে কে জি মুস্তাফার সাপ্তাহিক জনতা দিয়ে শুরু। এরপর কাজ করেছেন দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক বাংলায়। আর জনকন্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন প্রায় জন্মলগ্ন থেকে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব, এরও আগে পিআইডির প্রধানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দায়িত্বও পালন করেছেন এই মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার লেখা ‘পিণ্ডির প্রলাপ’ তখন স্বাধীনবাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রচার করা হতো।

আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধির পক্ষের একজন কাজপাগল মানুষ। নিজে সারাক্ষণ কাজ করেন। কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। সহকর্মীদের যারা কাজ ভালো্বাসেন, তাদেরকে উজাড় করে সবকিছু দিয়ে দিতে জানেন। তার হাতে কাজ শেখা মানুষেরা আজ দেশের প্রধান সব মিডিয়ায় উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে আছেন। মিনার মাহমুদ আমার প্রথম সম্পাদক (বিচিন্তা), সাংবাদিকতার প্রথম শিক্ষক; আর  দৈনিকে আমার প্রথম সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী(দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা। কিন্তু সাংবাদিকতায় আমার ধারাবাহিক বিকাশের এক পর্যায়ে অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে তোয়াব খানের কাছ থেকে। আমরা যারা তোয়াব খানের সঙ্গে, তার অধীনে কাজ করেছি, সেই গৌরবের অহংকার একান্তই আমাদের নিজস্ব।
 
১৯৯৪-৯৫ সালে তোয়াব ভাইকে প্রথম দেখি। জনকন্ঠের মতিঝিল অফিসে তার কাছে নিয়ে যান বন্ধু সাংবাদিক সৈয়দ বোরহান কবীর। আমি তখন লালসবুজ নামের একটি দৈনিকে কাজ করি। পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় ছেড়ে দেবার পর পত্রিকাটি বিবর্ণ-হতোদ্যম। ভালো কোথাও কাজের সুযোগ খুঁজছিলাম। দুই মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আর তোয়াব খানের নেতৃত্বে জনকন্ঠ তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। দেশের এক নম্বর পত্রিকা। কিছু রিপোর্ট দিতে বললেন তোয়াব ভাই। এরপর থেকে মাঝে মাঝে আমার রিপোর্ট ছাপা হতে থাকে জনকন্ঠে। ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ’ নামের একটি সিরিজ রিপোর্টও ছাপা হয় জনকন্ঠ রিপোর্ট ক্রেডিটে। যা জনকন্ঠ অফিসে তোয়াব খান ছাড়া আর কেউ জানতেন না।
 
আমার ‘একাত্তরের কলকাতা’ গবেষণাগ্রন্থটি বেরুবার পর এ নিয়ে আরও কাজ করতে চান প্রোব বার্তা সংস্থার প্রধান সম্পাদক ইরতিজা নাসিম আলী। এরপর আমরা দু’জন অনেকদিন কলকাতা, বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া কৃষ্ণনগরসহ পশ্চিমবঙ্গের অনেক শহরে ঘুরে বেড়িয়েছি। একাত্তরের কলকাতা নিয়ে সে ধারাবাহিক রিপোর্টটিও জনকন্ঠে ছাপা হয়। জনকন্ঠে অফিসিয়ালি কাজের ডাক পাই চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের আকস্মিক মৃত্যুর পর। তার শূন্যস্থানে  আমাকে নির্বাচন করেন তোয়াব খান। আমি বরাবর মোনাজাতউদ্দিনের গুণমুগ্ধ ভক্তদের একজন ছিলাম। এমন একটি কাজের স্বপ্ন মনের মধ্যে পোষণ করতাম। ১৯৯৬ সালের ১১ মে যোগ দিই জনকন্ঠে। প্রথম রিপোর্ট করতে যাই বৃহত্তর সিলেট এলাকায়। প্রতিদিন রিপোর্ট পাঠাই। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা পরের দিন ভিতরের পাতায় ছাপা হয়। অফিসে এ নিয়ে নিজের অসন্তুষ্টি জানালে আমাকে ঢাকায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর জড়িত হয়ে যাই জনকন্ঠের মেইনস্ট্রিম রিপোর্টিং’এ। তোয়াব ভাই’র বিপুল সমর্থনের কারণে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সে বছরের জুনের নির্বাচনে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ।
 
এরপর শুধু কাজ আর কাজ। কোনো একটি ভালো আইডিয়া মাথায় এলে তার সঙ্গে শেয়ার করতে গেলে তার পছন্দ হলেই বলে দিতেন, শুরু করে দাও। একাত্তরের কলকাতা ধাঁচের আরেকটি কাজের ধারণা দিতেই ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে আমাকে পাঠানো হয় আগরতলার। এক মাস ধরে ত্রিপুরা চষে বেড়ানো রিপোর্টটি জনকন্ঠে ‘একাত্তরের আগরতলা’ শিরোনামে ছাপা হয়। রিপোর্ট ছাপা শেষ হবার পর বলেন,  ``পাণ্ডুলিপিটা নওরোজ কিতাবিস্তানের আব্দুল কাদিরকে দিয়ে এসো। আমি তাকে বলে রেখেছি। সে এ বইটি বের করবে। `` এই হচ্ছেন তোয়াব খান।

মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে আগুন লাগলে সেখানে আমাকে একজন ফটো সাংবাদিকসহ দ্রুত পাঠানো হয়। এক নাগাড়ে তের দিন লিড হয় সে রিপোর্ট। ঢাকা ফেরার পর আবার তৈরি হতে বলা হয়। আমাকে যেতে হবে ফিলিস্তিন। ইন্তিফাদার দীর্ঘ আন্দোলন চলছে। ঢাকার তৎকালীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত শাহতা জারাব পিএলও’র কায়রো ও আম্মান মিশনকে চিঠি লিখে দেন। সিঙ্গাপুর হয়ে কায়রো পৌঁছে শুরু হয় ফিলিস্তিন যাবার সংগ্রাম। কিন্তু সেখানকার ভিসা অথরিটি ইসরায়েল। তাই পিএলও’র কায়রো আর আম্মান মিশন তিন মাস চেষ্টা করেও আমার ভিসা জোগাড় করতে পারে না। কারন বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। অগত্যা কায়রো-আম্মানে বসেই ফিলিস্তিনের ভিতরে থাকা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে পাঠাতে থাকি ইন্তিফাদার রিপোর্ট। তখনও আমার হাতে কম্পিউটার ওঠেনি। মোবাইল ফোনও নেই। হাতে লিখে ফ্যাক্সে পাঠাতে হতো রিপোর্ট।

প্রতি রাতে অফিস থেকে বাসায় ফেরার আগে হোটেলে ফোন করতেন তোয়াব ভাই। পিতার মতো সন্তানের স্নেহে নানান খোঁজ নিতেন। প্রতিদিন বলতেন আর কী কী রিপোর্ট চাই। ঢাকার পাকিস্তান দূতাবাস ভিসা না দেওয়াতে আমার আফগান যুদ্ধ কভার করা হয়নি। ইরাক, লেবানন যুদ্ধ কভার করেছি তোয়াব খানের উৎসাহ আর সমর্থনে। রিপোর্ট করতে কুড়িটির বেশি দেশে যাওয়াও হয়েছে তার কারণে। এক সময় তার পরিকল্পনা ছিল সারা বছর জনকন্ঠের কোনো না কোনো একজন রিপোর্টার বিদেশে থাকবে। এতে করে আলাদা একটি টেস্ট থাকবে পত্রিকায়। দেশের বাইরে কাজ করতে গেলে কনফিডেন্স বাড়বে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের।

ঢাকার যে কোনো দৈনিকের তুলনায় জনকন্ঠের কাজের পরিবেশটিও আলাদা। প্রতিদিন তোয়াব খানের নেতৃ্ত্বে রিপোর্টিং মিটিং। প্রতিদিনের জবাবদিহিতা। জনকন্ঠের রিপোর্টাররা জানেন সেটি প্রতিদিনের আদালত-ট্রাইবুন্যাল। রিপোর্ট ভালো না হলে অথবা মিস হলে সেই ট্রাইবুন্যালে যে চাঁছাছোলা ভর্ৎসনা। সবই নগদে নগদ। ঢাকার বাইরের রিপোর্টাররাও তাই রিপোর্টিং মিটিং’র সময় অফিসে অথবা টেলিফোনের কাছে থাকতেন। কখন তোয়াব ভাই’র ফোন আসে!

এমনিতে উপদেষ্টা সম্পাদক কথাটি শুনলে মনে হবে  যেন তিনিশুধু উপদেশ দিয়ে বেড়ান! কিন্তু তোয়াব খান থাকেন জনকন্ঠের প্রতিটি মুহুর্তে, প্রতিটি পাতায়। খুব সংক্ষেপে আকর্ষণীয় শিরোনাম করতে জুড়ি নেই তার। জনকন্ঠের ``আইন`` হচ্ছে প্রতিটি পাতা ছাড়ার আগে তাকে দেখিয়ে নিতে হয়। একই আইন তিনি দেশের বাইরে থাকলেও! পাতা ছাড়ার আগে তা তার কাছে পাঠাতে হয় ফ্যাক্সে বা কম্পিউটারে।

একজন নিপুন শিল্পীর মতোই আপাদমস্তক  অতৃপ্ত একজন মানুষ! তিনি নিজের ওপর অসন্তুষ্ট, রিপোর্টে-কাজে তাকে সন্তুষ্ট করা কঠিন। বঙ্গবন্ধু-জিয়া-এরশাদ-বিচারপতি সাহাবুদ্দীন থেকে শুরু করে এত মানুষকে তিনি কাছে থেকে দেখেছেন-- রিপোর্টিং মিটিং’এ তন্ময় হয়ে সে সব গল্প শুনতাম।

বাংলাদেশের সংবাদপত্র শিল্পের আঙ্গিক সৌ্ন্দর্য থেকে শুরু করে অনেক কিছুর গোড়াপত্তন তার হাতে। আজ দেশে যে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, এটি তার আর জনকন্ঠের দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফসল। জনকন্ঠে প্রকাশিত এলাকাভিত্তিক ‘সেই রাজাকার’ অনুসন্ধানী রিপোর্টসমূহ আজ ট্রাইব্যুনালের কাছে বড় দলিল। সেই রিপোর্ট বন্ধে সারাদেশে জনকন্ঠের বিরুদ্ধে মামলা করায় জামায়াত। পত্রিকার তৎকালীন ফরিদপুর প্রতিনিধি প্রবীর শিকদারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। দীর্ঘদিন এলাকা ছাড়া থাকেন নড়াইলের রিফাত-বিন-ত্বহাসহ আরও অনেকে। কিন্তু তোয়াব খান আর জনকন্ঠকে টলানো যায়নি। বাংলাদেশে ফতোয়াবাজী আর ধর্মীয় কূপমণ্ডুক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনকন্ঠের লড়াইটি এখনও চলছেই।

ছুটির দিনে বিশেষ ব্যবস্থায় পত্রিকা বের করার রীতিও তিনি শুরু করেন। এ নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে। কিন্তু তার যুক্তি, দেশে সংবাদপত্রবিহীন কোনো দিন থাকতে পারে না। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, নিউজ এজেন্সি এসবও কখনো বন্ধ থাকে না। এজেন্ট-হকাররা রাজি হলে ঈদের দিনও তিনি পত্রিকা বের করার পক্ষে ছিলেন।

সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন, শামছুর রহমান মারা যাবার পর তিনি সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে যাবতীয় পাওনা শোধের সঙ্গে পাঁচবছর বেতনের মূল টাকাটি দেবার ব্যবস্থা করেন। এমন আর কখনো বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। প্রবীর শিকদার গুলিবিদ্ধ হলে দেশে বিদেশে তার চিকিৎসার তদারকিও নিজে করেছেন। জনকন্ঠের অর্থনৈতিক জৌলুস আর পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সমর্থন-আস্থা তার ওপর ষোল আনা ছিল বলেই এসব তখন সম্ভব হয়েছে।
 
এ দেশের সাংবাদিকতার বিকাশে যার এত অবদান, তাকে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়নি। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচারবিমুখ, লাজুক প্রকৃতির তোয়াব খানের অবশ্য এসব নিয়ে কারো প্রতি কোনো অনুযোগ নেই। তিনি কাজের মানুষ, কাজ করে যাচ্ছেন। কাজ করছেন বলেই তার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে ভালো আছেন। বরাবরের মতোই তিনি পোশাকে-ফ্যাশনে কেতাদুরস্ত! পাজামা-পাঞ্জাবি তার প্রিয় পোশাক। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন। বাংলাটা বরাবর শুদ্ধ করেই লিখেন। নিজে যত পড়েছেন, পড়েন সে হিসেবে লিখেছেন কম। যা লিখেছেন তা বরাবরের মাস্টারপিস। সর্বশেষ কলকাতায় তার একটি বক্তৃতার লেখাটি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে। সম্পর্কে তিনি এদেশের সাংবাদিকতার কিংবদন্তি-পুরুষ মাওলানা আকরাম খাঁ’র নাতি; কিন্তু  নিজের কাজ আর বহুমুখি গুণপনার কারণে তোয়াব খানকে কোথাও সে পরিচয় ব্যবহার করতে হয়নি। কাজই তাকে সতত বাঁচিয়ে রেখেছে, বাঁচিয়ে রাখবে। শুভ জন্মদিন তোয়াব ভাই। আপনার পছন্দের কাজ নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন আরও অনেক অনেক বছর। হ্যাটস অফ!! 

ফজলুল বারী, সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১১৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১২

সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ