শাহবাগ থেকে: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ২৭-এর ৪ ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।
আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
মুষ্ঠিবদ্ধ মাইক্রোফোনে স্লোগানের মাধ্যমে সবাইকে আলোড়িত করেন তিনি। তার ছন্দবদ্ধ স্লোগানে উপস্থিত সবাইকে বিমোহিত করে ফেলেন তিনি। গত মঙ্গলবার থেকে লাকির উদ্দীপ্ত স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত শাহবাগ চত্বর।
তার স্লোগানের উদ্দীপনা জাগিয়ে চলেছে শাহবাগের ‘গণজাগরণ’/’প্রজন্ম চত্বর’।
লাকির স্লোগান শুনে কেউই চুপ থাকতে পারেননি। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুসহ গণজাগরণ চত্বরে উপস্থিত সবাই তার স্লোগানে গলা মিলিয়ে উচ্চারণ করেছেন- ‘একটাই দাবি, ফাঁসি ফাঁসি’।
লাকি যখন উচ্চারণ করেন, ‘আড়াই হাতের লাঠি তৈরি করো’, তার প্রতিউত্তরে ভেসে আসে-‘জামাত-শিবির খতম করো। ’ ‘জ্বালো জ্বালো’ বললে সমবেত কণ্ঠে উত্তর ধ্বনিত হয়-‘আগুন জ্বালো!’
মানুষের স্রোত আর স্লোগানের কণ্ঠস্বর যেন এক হয়ে যায় এখানে!
কাদের মোল্লাসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকে রাজধানীর শাহবাগে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সারা জাতিকে এক সুঁতোয় গেঁথেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৮ম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী অমিত সাহসী কন্যা লাকি আক্তার।
শুক্রবার রাতে বাংলানিউজের সঙ্গে এক আড্ডায় খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
তিনি বাংলানিউজকে নিজের রাজনৈতিক আদর্শ, স্বপ্নের দেশ গড়া আর মিছিলে ভালো স্লোগান দিতে পারার অনেক গল্প শোনান।
জবি-র ২৭-এর ৪ ধারা বাতিলের দাবির আন্দোলনে দেওয়া স্লোগান সর্ম্পকে লাকি বলেন, “সেদিন স্লোগান দিয়ে গলা ভেঙে যায়। অবশ্য পরের দিনই আবার এসে স্লোগান দিই। ”
“তখন কণ্ঠ আবার ঠিক হয়ে যায়”- বলেন লাকি।
মাঝে ছাত্রলীগের ছেলেরা মঞ্চের দখল নিতে লাকির ওপর চড়াও হয়। পেছন থেকে তার মাথায় আঘাত করে। এতে সে আহত হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অবশ্য মন্তব্য করতে রাজি হননি লাকি।
তার স্লোগানের প্রশংসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে শাহবাগ, সেখান থেকে দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
তার দেখাদেখি দেশের অনেক জায়গাতেই মেয়েরা ‘ফাঁসির দাবিতে’ স্লোগানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এদিকে, শাহবাগের গণজাগরণ চত্বরে তোজোদ্দীপ্ত স্লোগানের জন্য লাকির পরিচিতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তার স্লোগান দেওযার সময় বিভিন্ন টিভি চ্যানেল তাকে বার বার দেখাতে থাকে। সে সূত্রে বিশ্বের অনেক দেশেই তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে।
লাকি বাংলানিউজকে বলেন, “একটা সময় স্লোগান দিতে লজ্জা লাগতো। স্লোগান দেওয়ার সময় বন্ধু সজীব বলতো- তুই তো চিকার মতো আওয়াজ করিস। তখন একটা জেদ কাজ করতো। ”
“ভাবতাম এক সময় আমি ঠিকই ভালো স্লোগান দেবো” জানালেন লাকি।
তিনি বলেন, “এর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭-এর ৪ ধারার বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছে, সে সময় স্লোগান দিতে দিতে স্লোগান ভালো শিখে গেছি। ”
এই ৫ দিনেও লাকির স্লোগানের জোরালোভাবটা কমেনি।
স্লোগানের ধরন সম্পর্কে লাকি বলেন, “স্লোগানের একটি বড় ব্যাপার হচ্ছে, আন্দোলনের ধরন। এর ওপর নির্ভর করে স্লোগানের গতি। ”
রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে চলমান এ আন্দোলনে নিজের মধ্যে গতি কাজ করে লাকির।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার কাছ থেকে আমি শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধ কী! রাজাকার কী?”
“আমি এ আন্দোলনে নেমেছি রাজাকারকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করতে”- তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলেন লাকি।
জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ’৭২- এর সংবিধানের যে মূলনীতি, সে আলোকে ’৭১-এর চেতনা, মৌলবাদমুক্ত ও রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে আন্দোলনে নেমেছেন লাকি আক্তার।
আবারও স্লোগানের প্রসঙ্গে ফিরে আসেন লাকি।
বলেন, “আন্দোলনের সময় স্লোগান দেওয়ার সময় ভাবি, কোন কথাটা স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়াতে পারে। ছোট কথায় সেটি কত সহজে বলা যায়!’
শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনে নতুন একটি স্লোগান দিয়েছেন তিনি।
সে বিষয়ে তার মন্তব্য, “আন্দোলনে একটি নতুন স্লোগান দিয়েছি- ‘জামাতে ইসলাম, মেড ইন পাকিস্তান। ’
জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এর আগেও ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিয়েছেন বলে জানান লাকি।
রাজাকারদের বিরুদ্ধে হুমায়ূন আহমেদের টিয়া পাখির মুখ দিয়ে বলানো ব্যাঙ্গাত্মক স্লোগান- ‘তুই রাজাকার’ ভীষণভাবে সাধারণ মানুষকে আলোড়িত করে।
শাহবাগের লাখো জনতাকে ওই স্লোগান ‘তুই রাজাকার’ দিয়ে উদ্দীপ্ত করছেন লাকি।
এ সর্ম্পকে তিনি বলেন, “এটি হুমায়ুন আহমেদের একটি বইয়ে ছিল। ময়না পাখি বলতো। আবার ময়মনসিংহে উদীচী তাদের একটি অনুষ্ঠানে স্লোগান দিয়েছিল, “সাঈদী...তুই রাজাকার। ” এখানে এসে একটি ফেস্টুনে দেখলাম- এ স্লোগানটাও রয়েছে। ”
কিন্তু হুবহু এই স্লোগানটাই দিলেন না লাকি। “একটু পরিবর্তন করি আমি”- বলেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমি একটু পরিবর্তন করে স্লোগান দিলাম, ‘স-তে সাঈদী...তুই রাজাকার...তুই রাজাকার...। ”
জাহানারা ইমামের গণআদালত সচোখে দেখেননি লাকি। ওই সময়কার আন্দোলনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “সে সময়কার আন্দোলনে স্লোগান দেওয়া হতো- ‘জামাত ধর..শিবির ধর...ধইরা ধইরা..জবাই কর...। ”
এসব স্লোগানই শাহবাগে দিচ্ছেন বলে জানান ‘স্লোগান কন্যা’ লাকি।
ইতিহাস সচেতন লাকি বলেন, “সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমি অনেক ইতিহাস পড়েছি। ”
শাহবাগের আন্দোলনে নিজেকে বেশি করে সম্পৃক্ত রাখার বিষয়ে লাকি বলেন, “কারণ, আমি আমার স্বাধীনতা সর্ম্পকে অনেক বেশি পরিস্কার। ”
স্লোগান সর্ম্পকে তিনি বলেন, “২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের দাবিতে আন্দোলনে প্রথম স্লোগান ধরি। এর পর ২৭-এর ৪ ধারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন, ৫ হাজার টাকা উন্নয়ন ফি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে স্লোগান ধরি। ”
জানালেন তিনি “উন্নয়ন ফি বাতিলের দাবিতে যে ৮ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তার মধ্যে আমিও ছিলাম। ”
আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন বুধবার থেকেই দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেকেই লাকি’র মতো স্লোগান দিতে চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, “এখন অনেকেই চেষ্টা করছেন ভালো স্লোগান দিতে। যদি আমার স্লোগান থেকে কেউ উজ্জীবিত হয়, সেটা আমার জন্য বড় সাফল্য!”
টানা স্লোগান দিয়েও গলা না ভাঙার কারণ হিসেবে গানের রেওয়াজ করার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন লাকি। তিনি বলেন, “সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে- অভ্যাস ও মনোবল।
লাকি জানান, এ আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই রয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার রাত থেকেই মশাল মিছিল নিয়ে এ সমাবেশে অংশ নেয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন।
এই আন্দোলনে রোজ মাত্র দুই ঘণ্টার জন্য সমাবেশ স্থল ত্যাগ করেন বলে জানান তিনি।
ছাত্র ইউনিয়নের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ছাড়াও কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক লাকি।
গত ৪ দিনে শাহবাগের আন্দোলনে যিনিই এসেছেন, তেজোদীপ্ত কণ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেছেন, ‘ক-তে কাদের মোল্লা...তুই রাজাকার..তুই রাজাকার.... বা ‘ফাঁসি...ফাঁসি..ফাঁসি...’।
ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার এই ‘স্লোগান কন্যা’ লাকি আক্তারকে এখন সবাই ‘লাল সালাম’ দিয়ে যান।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৩
এমএন/এমএমকে/এআর/মোরশেদ/সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর