ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শাখাওয়াৎ নয়নের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ : সালেহার জীবনী অথবা সালেহা চরিতমানস

মেহেদী উল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৩
শাখাওয়াৎ নয়নের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ : সালেহার জীবনী অথবা সালেহা চরিতমানস

এই মুহূর্তে যে সালেহার কথা বলছি, সে শাখাওয়াৎ নয়নের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ উপন্যাসের নায়িকা। তবে সালেহা বিষয়ে বিশেষ সুবিধার কথা হলো তাকে সবাই চেনেন, আরো ভেঙ্গে বললে, বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে সালেহার দেখা মেলে সহজে।

অথবা আরেকটু কাছাকাছি গিয়ে বললে, যে সালেহার খবর প্রায়ই চোখে পড়ে পত্রিকার পাতায়। এতই সুলভ সালেহা! উপন্যাসে সালেহা স্বামী পরিত্যক্ত নারী। তার দুইটি সন্তান আছে। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম। অবশেষে এক ঝড়ের রাত শেষে স্বামী ফিরে আসে। বস্তুত স্বামীকে ফিরে পেয়ে সালেহা ও তার সন্তানদের খুশি হওয়ার কথা থাকলেও তা আর সম্ভব হয় না। কারণ, সালেহার স্বামীর সঙ্গে আসে নতুন মেহমান। সহজ করে বললে, অতিথিটি সালেহার সতীন। সমাজে স্বামীহীন নারীর যে দশা হয়, সেই দশাসমূহ মোকামেলা করেই টিকে থাকতে হয়েছে সালেহা কে। পরপুরুষের কুনজর, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার গরজে শত বঞ্চনা সহ্য করে সালেহা পথ চেয়ে আছে স্বামীর। অথচ স্বামী এসে উল্টো তাকে ঘরছাড়া করে নতুন বউয়ের আসন পোক্ত করে। সালেহাকে গলাটিপে মেরে ফেলে। এখানেই শেষ সালেহার জীবন, সমাপ্তি উপন্যাসের। আশা করি পাঠক একমত হবেন, এই সালেহাকে আপনারা আগে থেকেই চেনেন। এই চেনা নারী, গ্রাম্য নারীর প্রতিনিধি সালেহাকে নিয়েই উপন্যাসের আখ্যান গড়ে উঠেছে। আসলে সাহিত্যে এমনই হয়। হয়ে থাকে। রাম চরিতমানসের আদলে সতীনাথ ভাদুড়ি যেমন নির্মাণ করেছেন ‘ঢোড়াই চরিতমানস’; আর সেই ঢোড়াইকেও কম-বেশি সবাই চেনে, উপন্যাসটি লিখিত হওয়ার আগেই, তেমনই নয়নের সালেহাও পূর্বপরিচিত। এখানে চেনা শব্দটি বার বার ব্যবহার করা হলেও এই চেনার একটা নির্দিষ্ট ব্যপ্তি আছে। এই ধরণের চরিত্রের জন্ম থেকে জীবন-যৌবনের পরিণতি পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট পথরেখা থাকে। এই গণ্ডির বাইরে এই ধরণের চরিত্রের উতরানো সম্ভব নয়। অর্থাৎ চেনা একটা ছক আছে। কাঠামোবাদী তত্ত্ব মেনে বললে, এই জীবন একটা নির্দিষ্ট ছক মেনে অগ্রসর হয়। এর বাইরে যেতে পারে না। সালেহার জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিবাহ, স্বামী-সংসার, দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম, পরিণতি প্রভৃতির একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ আছে। সেই ছাঁচের বাইরে যে জীবন যায় না। এই ছাঁচের নাম ‘সাবঅল্টার্ণ’। এই ডিসর্কোস অনুসারে, ভারতবর্ষের নারী সাবঅল্টার্ণের মধ্যে সাবঅল্টার্ণ। অর্থাৎ কোনো সমাজে পুরুষ যদি সাবঅল্টার্ণ হয়ে থাকে, তবে সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী আরেকধাপ নিচের সাবঅল্টার্ন। কারণ সমাজ পুরুষশাষিত। সেখানে নারীর স্থান আরো নিম্নগামী। এই উপন্যাসের সালেহা নামের নারীটি নিম্নবর্গের, ফলে উপন্যাসটি সাবল্টার্ন  স্টাডিজ বা নিম্নবর্গীয় অধ্যয়নে নতুন সংযোজন। আশির দশকের বাঙালি এক নারীর জীবন সংগ্রাম এই উপন্যাসে বিবর্তিত। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে সমাজ, সময় ও ইতিহাস।

উপন্যাসটির শুরু প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে। এই দুর্যোগের ভেতর গ্রামের ভালো-খারাপ সব মানুষকে এক ছাদের নিচে নিয়ে এলেন ঔপন্যাসিক। সালেহাও তার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে স্কুলঘরে আশ্রয় নেয়। এর আগেই সালেহাকে একঘরে দেওয়া হয়েছে। এই দুর্যোগ সালেহাকে আরেকবারের জন্য গ্রামের মানুষদের কাতারে নিয়ে আসে। এর আগে সে হয়ে ছিল সামাজিক মানুষের সাপেক্ষে ‘আদার্স বা অপর’। ঔপন্যাসিক  উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সালেহার জীবনীই রচনা করেন মূলত। আর তার চোখ দিয়েই আঁকেন স্বাধীনতা উত্তর গ্রাম-বাংলার প্রতিবেশ। সালেহা চরিতমানস বর্ণনায় ঔপন্যাসিক ১৭ টি খণ্ডের আশ্রয় নিয়েছেন। খণ্ডগুলোর দিয়েছেন আলাদা শিরোনাম। এতে বেশ সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। শিরোনামগুলো হলো- মায়ামুকুরের এপাশ-ওপাশ, সায়ংকাল, নুয়ে পড়া মন, ঝড়ের রাত, আদা আছে?,ক্ষুধাচিত্র, চন্দ্রসদন, মাতৃমঙ্গল, শূন্য উদ্যান, সংসার অবধি, গহীনাকূল প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৃষ্টির দিন, আঁধারের ভিতরে আঁধার, জুমাবার, স্বপ্নদুস্থ দীর্ঘরাত, পরী রোগ, দীর্ঘশ্বাস নিয়তিসমান। এতে সালেহার বিবাহ, স্বামী-সংসার, স্বামী আলমের চলে যাওয়া, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, জীবিকার সন্ধান, প্রচলিত সামাজিক সংস্কার ও ধর্মীয় ফতোয়ার প্রতিকূলতায় লড়াই, প্রতি পরপুরুষের কুনজর, বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ, ছেলের জন্য এতিমখানার খোঁজ, ছেলের অসুখ, ঝড়শেষে বাড়িফেরত, স্বামীর ফিরে আসা এবং স্বামীকর্তৃক পাশবিক নির্যাতন ও  মৃত্যু বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ তার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটা জার্নি আছে উপন্যাসে। তার দুঃখ-কষ্টই এই উপন্যাসের ক্লাইমেক্স।
 
আমরা আসলে কেন সালেহাকে সাবল্টার্ন বলছি? তার যথার্থ ভিত্তি উপন্যাসের শুরুতেই তৈরি করেন ঔপন্যাসিক। তিনি তার সহায়-সম্বল-স্বভাব-সংসারসহ ব্যক্তিক পরিচয় দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে সালেহা নিম্নবর্গের মানুষ। যেমন, যে ঘরটিতে সন্তানসমেত সালেহা থাকে তার অবস্থা নাজুক-তালপাতার ছাউনিতে ফুটো-ফাটা, বাঁশের খুঁটির ঘরে উইপোকায় খাওয়া পাটখড়ির বেড়া। আর ঘরের এককোণে দড়িতে ঝোলানো কিছু ছেঁড়া পুরনো জামা-কাপড়, আরেক কোণে কাঁথা-বালিশ। দরজার কাছে পূর্ব পাশের বেড়ার সাথে ছোট্ট একটা আয়না। ঘরের মেঝের এক পাশে মরচে ধরা প্রায় মুছে যাওয়া শুভ বিবাহ লেখা ছোট্ট একটা ট্রাংক এবং তার ওপর একটা পুঁটলি। ফেটে চৌচির হওয়া মেঝের এক কোণে উপুড় করা কান্দাভাঙা দুএকটা পাতিল, নারকেল ও ঝিনুকের চামচ। দেওয়া হয়েছে সালেহার শৈশবের বিবরণও। যার সঙ্গে তার বর্তমান দশার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

সালেহার সন্তান রিপন ও হেনা। চরিত্র দুটিকে আপত দৃষ্টিতে পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার মতো মনে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে বয়সের দিক থেকে চরিত্রদুটি তার বিপরীত। রিপন বড়, হেনা ছোট। আর ওদিকে অপু ছোট, দুর্গা বড়। তবে তাদের আচরণ ও স্বভাবগত নানা মিল পরিলক্ষিত।

উপন্যাসের শুরুতেই গহীনাকূল গ্রামের মানচিত্র এঁকেছেন লেখক। যা গ্রামভিত্তিক উপন্যাসগুলোর বড় বৈশিষ্ট্য। যেমন, জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’। গহীনাকূল গ্রামের পূর্বদিকে ফুলেশ্বরী নদী। পশ্চিমে বিল। উত্তরে কুলপদ্দি বাজার। দক্ষিণে তালতলা হাট। গহীন এক গ্রাম। সালেহার স্বামীর বাড়ি এই গহীনাকূল। তার বাপের বাড়ি গহীনাকূল থেকে পশ্চিমে ভদ্দরখোলা গ্রামে। সালেহার শৈশব কেটেছে সৎমায়ের সংসারে। সালেহার মা ছিলেন তার বাবার তিন নম্বর স্ত্রী। বিয়ের আগের জীবনটিও তার সুখের ছিল না, বিয়ের পর সৎমায়ের সংসার থেকে দজ্জাল শাশুড়ির হাতে পড়ে সালেহার জীবন হাঁপাতে থাকে, এরপর স্বামীকে ফিরে পেলেও কপালে সুখের পরিবর্তে সতীনের ঘর। অবশেষে মৃত্যু। নিজের ও সন্তানদের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করতে সালেহাকে বেছে নিতে হয়েছে নানা পেশা। যেমন, মানুষের কাঁথা সেলাই, ঢেঁকি পাড়ানো, ঘর লেপে দেওয়া, কুরআন শিক্ষা ও ধাত্রীসেবা দেয়া। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা মোটেও যথেষ্ট ছিল না। সালেহা চরিতমানস তাই হাজির করে নিম্নবর্গের এক পরিচিত ও চেনা-জানা নারীর বৃত্তান্ত।
 
ঔপন্যাসিকের বড় দুটি গুণের কথা বলতেই হবে। তা হচ্ছে প্রতীকায়িত বর্ণনা ও লেখকের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ দক্ষতা। এ নিয়ে দু’একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রতীক-‘অজস্র পিঁপড়া উদ্বাস্তুর মতো লাইন ধরে যাচ্ছে। ’ এই প্রতীকায়িত দৃশ্য দুর্যোগের পূর্বাভাস। উপন্যাসজুড়ে আইজ্জা পাগলার ‘আদা আছে?’ প্রলাপটিও এক ধরণের প্রতীক। এই প্রলাপের মধ্য দিয়ে সে আলাদা জগত তৈরি করতে পেরেছে। এর প্রভাব পরেছে গ্রামের নানা জায়গায়।   উপন্যাসের শেষে ‘পঙ্গু শালিক’  ও ‘সাপ’ এর প্রতীকও বেশ প্রকটরূপে আখ্যানকে প্রতিষ্ঠিত করে। সাপ বলতে বোঝানো হয়েছে সতীনকেই। পর্যবেক্ষণ শক্তির কারণে উপন্যাসের দৃষ্টিকোণই আলাদা হয়ে গেছে, নতুবা ফ্ল্যাট একটা গল্পই শোনানো হতো। এমন কিছু পর্যবেক্ষণ হলো- ‘এমন কোনো ঝাড়ু– কি পৃথিবীতে আছে, যা দিয়ে একবার ঝাড়ু– দিলে জীবনে আর কোনো দিন ময়লা জমবে না?’, ‘বংশ পরম্পরায় গরীবদেও বাড়িতে দুই-চারটে চারা গাছ ছাড়া আর কোনো দামি গাছ থাকে না। কিন্তু যারা গরিব হয়েছে বেশি দিন হয়নি, তাদেও বাড়িতে দু-চারটে বড় গাছপালা অবশিষ্ট থাকে’।   ‘মা-বাবার কাছে শুধু সন্তানেরাই ঋণী থাকে না। সন্তানদের কাছেও মা-বাবার অনেক ঋণ আছে’। ‘ঝড়-বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাখিরা। তারপর গরিব মানুষ’।   ‘আইজ্জা তিনশো হাত মাডির গভীরে যাইতে পারলেও মর্জিনার মনের গভীরে যাইতে পারে নাই’।   ‘এক লগে দুইডা চোখ, দুইডা কান খোলা রাহা বিলাসিতা। গরিবের এত বিলাসিতা ভালা না’। ‘যদি কখনো গহীনাকূল গ্রামটিকে দেখতে ইচ্ছে করে, তাহলে কোনো এক পূর্ণিমা রাতে ফুলেশ্বরী নদীর জোয়ারের জলের সাথে একবার এসে দেখে যাবে’।

উপন্যাসে সালেহাসহ অনেক চরিত্রকেই রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে দেখা যায়। এই স্বপ্নগুলো বেশ অর্থবহ। উপন্যাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এগুলো আখ্যানের রহস্যময় বিধায়ক। গল্পকে আরো সংহত করেছে। যেমন, সালেহার ‘বালিশ ছাড়া’  ঘুমানোর স্বপ্নটিকে ব্যাখ্যা করা যায়, তাকে কেউ পরামর্শ দিচ্ছে সম্ভ্রবহীন ভাবে চলতে। সালেহা যে সম্ভ্রম রক্ষা করছে, শেষে সেই সম্ভ্রমহানীর খোটা দিয়েই তার স্বামী তাকে ‘মাগী’  বলে গালি দিয়েছে এবং অভিযুক্ত করেছে। আর সালেহার সম্ভ্রমহানী ঘটাতে চেয়েও যে বশির তালুকদার ব্যর্থ হয়েছে, সেই কুচক্রি মানুষটিই মসজিদের ইমামকে দিয়ে তার বিচার করাতে চেয়েছে এবং শেষে সালেহার স্বামী ফিরে এলে তার কাছে সালেহার নামে অপবাদ রটিয়েছে। যা মিথ্যে ও বানোয়াট। বশির তালুকদার চরিত্রটি বর্তমানেও যেমন আছে, সক্রিয় তেমনি ছিল মধ্যযুগের কাব্যেও। বাংলা সাহিত্যে এমন দুটি উল্লেখযোগ্য কুচক্রি চরিত্র হচ্ছে মুরারীশীল ও ভাড়ুদত্ত।   এরা যুগে যুগে থাকে এবং কুৎসা রটিয়ে শুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অশুভ শক্তিকে জয়ী করতে অপচেষ্টা চালায়। যেমন, বশির তালুকদার সালেহার শেষ পরিণতির জন্য দায়ী।
 
স্বামী আলম কর্তৃক সালেহাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়া, ছোটবেলায় সালেহা ও তার বোন সুলতানার বউ দেখতে যাওয়ার শখ প্রভৃতি এই উপন্যাসের নতুন অনুষঙ্গ। বাংলা উপন্যাসে এই ধরণের অনুষঙ্গ এর আগে চোখে পড়ে নি। এসব অনুষঙ্গের দ্বারা শাখাওয়াৎ নয়ন উপন্যাসে নতুন ধরণের প্রতিবেশ নির্মাণ করতে পেরেছেন। এছাড়া আইজ্জা পাগলা ও বিবিসি চরিত্র দুটিও সম্পূর্ণ নতুন ও স্বাতন্ত্র্য। বিবিসি পেশায় রিকশা চালক। তার কাছে পাওয়া যায় না এমন কোনো খবর নেই। আর খনি শ্রমিক আজিজের বউ মর্জিনা পালিয়ে যায় জিল্লুরের সাথে। পালানোর আগে মর্জিনা জিল্লুরকে আদা দিয়ে চা বানিয়ে দিত। জিল্লুরের ছিল চায়ের মধ্যে আদা খাওয়ার অভ্যাস। ফলে মর্জিনাকে হারিয়ে আজিজ হয়ে যায় ‘আইজ্জা পাগলা’। গ্রামে ঘুরে ঘুরে সে প্রলাপ বকতো ‘ আদা আছে?’ পাগল হওয়ার আগে আইজ্জা হয়তো মনে করেছে আদাই যত নষ্টের মূল। আদার কারণেই মর্জিনাকে সে হারিয়েছে।
 
উপন্যাসে নানাভাবে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নমুনা। স্বামীহীন সালেহাকে গ্রামের কেউ কেউ বলে, পরের পোলাপান নিয়ে এত কষ্ট করে কেন? আরো বলতে শোনা যায়, পোলাপান কি মা’র। পোলাপান হলো বাপের। এভাবেই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। তবে সালেহার সৌন্দর্য বর্ণনায় লেখক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি সৌন্দর্যের গতানুগতিক সংজ্ঞায়ন থেকে দূরে থেকেছেন। নারীবাদী ডিসকোর্সের আলোকে তাই লেখককে সাধুবাদ জানাতে হয়। সালেহার রূপ বর্ণনায় ঔপন্যাসিক বলেন,‘ শারীরিক দিক থেকে সালেহাকে খুব সুন্দরী না বলা গেলেও কম সুন্দরীও বলা যায় না। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা চেহারায় যতখানি না সুন্দর, তাদের গুণে, ব্যক্তিত্বে তার চেয়েও বেশি সুন্দর। তাদের চারপাশটাকে তারা আরও বেশি সুন্দর করে তোলে। অন্যকে মুগ্ধ করে। এ ধরণের মানুষই প্রকৃত অর্থে সুন্দর। সালেহা সেই প্রকৃতির। ’  

উপন্যাসের সমকালীন সময়ে চিঠি লেখার রেওয়াজ ছিল। রিপন তার ছোট কাকা কামালকে ও কামাল রিপনকে যে চিঠি লেখে ঔপন্যাসিক চিঠির হুবহু ফর্ম তুলে দিয়েছেন। যা উপন্যাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ছোট্ট হলেও সরাসরি চিঠির আবেগ আস্বাদন করা যায় দু’টি চিঠি থেকে। এছাড়াও উপন্যাসে এসেছে দারিদ্যপীড়িত গহীনাকূল গ্রামের মানুষের কুসংস্কার-ধর্মান্ধতা-রাজনীতি আর ক্ষুধার চালচিত্র।

ঔপন্যাসিক সমাজের যে কুটিল স্তরবিন্যাসের প্রভাব বলয় দিয়ে সালেহা চরিতমানস নির্মাণ করেছেন তার ফলে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হতে পারবে। আর উপন্যাসটি হাতে নিলেই পাঠকের মনে পড়বে একদা ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ এসেছিল গ্রাম-বাংলায়। আশা রাখি, এই বলে স্বস্তি পাবেন, আজ আর নেই সেই দিনের মতো নষ্টসময়। অথচ নষ্টসময়ের স্মৃতিকে চিত্তে ও চৈতন্যে জাগরুক রেখে শিক্ষা নেওয়ার জন্যই তখন ডাক আসবে ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ উপন্যাসটির। গ্রাম-বাংলার এমন দলিল-ই লিপিবদ্ধ করেছেন শাখাওয়াৎ নয়ন।

শাখাওয়াৎ নয়নের উপন্যাস ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ বাজারে এনেছে ‘কথাপ্রকাশ’ পকাশনী। প্র্ছদাকার : মাহবুবুল হক। মূল্য : ১৬০ টাকা।

বাংলাদেশ সময় : ১৮২৩ ঘণ্টা, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩
সম্পাদনা : এম জে ফেরদৌস, [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

শিল্প-সাহিত্য এর সর্বশেষ