ঢাকা, শুক্রবার, ২৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৪ মার্চ ২০২৫, ১৩ রমজান ১৪৪৬

রাজনীতি

ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী দেবেন সিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী সোমবার

জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১২
ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী দেবেন সিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী সোমবার

নাটোর: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী ও  উপমহাদেশের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড দেবেন সিকদারের ১৮তম মৃত্যু বার্ষিকী ৯ জানুয়ারি, সোমবার।

কমরেড দেবেন সিকদার ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারার শোলকাটা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তার বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষক।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন সংগঠক ও সক্রিয় কর্মী ছিলেন কমরেড দেবেন সিকদার। বাংলাদেশের মজদুর পার্টির সভাপতি, বাংলাদেশ আখচাষী ইউনিয়নের আজীবন সভাপতিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

দেবেন সিকদার ২২ বছর আত্মগোপনে থেকে রেল, ডাক, বন্দর, বিদ্যুৎ, পাট, তুলা, ওয়াসা, ব্যাংক, সওদাগরি ফার্মসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৬৭ সালে (সিলেট) পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে তিনিই সর্বপ্রথম ‘স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা রাষ্ট্র কায়েম’-এর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল ‘রাজশাহী জেল বিদ্রোহ’ এবং ‘আখ বিদ্রোহে’র তিনিই ছিলেন মূল রূপকার ও দিকনির্দেশক।

ব্যক্তি হিসেবে দেবেন সিকদার ছিলেন শান্ত প্রকৃতির, বিনয়ী ও স্বল্পভাষী।

তার বিপ্লবী জীবন ইতিহাস থেকে জানা যায়, কমরেড দেবেন সিকদার কৃষি কাজের পাশাপাশি পান, মরিচ, তামাক, দই, ঘোল, কাপড় ও মুদিখানা প্রভৃতি ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। ছোটকাল থেকে বাবার সঙ্গে তার এসব কাজে অংশগ্রহণ ছিল।

১৯২৯ সালে ১২ বছর বয়সে ৭ বছর বয়সী সাবিত্রী রানীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ওই বছরেই তিনি ৪র্থ শ্রেণী থেকে লেখাপড়া বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের রহমতগঞ্জে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে গৃহভৃত্যের কাজ শুরু করেন। চাকরি জীবনের ২য় বছর অর্থাৎ ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল গভীর রাতে ভয়ঙ্কর গোলাগুলি ও ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে সমস্ত শহর জেগে উঠলে লোকমুখে ও কানাকানিতে তিনি জানতে পারেন মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টলার বিপ্লবীরা বৃট্রিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এই ঘটনা জেনে তিনিও আপন মনে সিদ্ধান্ত নেন- ‘আজ থেকে আমিও একজন বিপ্লবী ও বিপ্লবীদেরের সদস্য’। শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন। সেই থেকে তিনি দৈহিকভাবে গৃহভৃত্য হলেও মানসিকভাবে একজন দৃঢ়মনা বিপ্লবী হয়ে যান।

এরপর বিভিন্ন পেশা বদলের মধ্য দিয়ে তিনি চাকরি নেন চট্টগ্রাম শহরের জেম্জ ফিনলে নামক এক বিলেতি জাহাজ কোম্পানির অফিসে পাখা টানার বয় হিসেবে। ১৯৩৩ সালে তিনি ওই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বার্মাগামী জাহাজে করে আরাকান পৌঁছান।

আরাকান থাকাকালে তিনি ধানের গুদামে ও ইটের ভাটায় কুলির কাজ করেন। কয়েক মাস পর চট্টগ্রাম ফিরে এসে আগের চাকরিতে বহাল হন। পরবর্তীতে ‘পাঙ্খা বয়’ থেকে পদোন্নতি দপ্তরি, পিয়ন এবং জরুরি পত্রবাহক হিসেবে সাইকেল পিয়ন পদে উন্নীত হন। মাসিক বেতন ৩ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ টাকা ৩২ পয়সায়।

১৯৩৭ সালে তিনি আরও অনেকের সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রামে জেলা শাখায় যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে বার্মা ওয়েল শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম জেলার কোয়েপাড়া গ্রামে পার্টির চট্টগ্রাম জেলা সম্মেলনে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির তিনি সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৫৬ সালে কোলকাতায় গোপনে তৎকালীন পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান সেন্ট্রাল কমিটির কংগ্রেসে তিনি প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যায়। ১৯৬৭ সালে (সিলেটে) পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সে কংগ্রেসে প্রস্তাবিত দু’টি দলিল আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে বাতিল হলে প্রস্তাবিত ৩য় দলিলটি উপস্থাপন করেন কমরেড দেবেন সিকদার। প্রস্তাবিত দলিলটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

এটা ছিল এক ঐতিহাসিক দলিল। এই দলিলের অন্যতম একটি এজেন্ডা ছিল- পাকিস্তান ভেঙে পূর্ব বাংলায় পৃথক রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে।

এরপর রাজনৈতিক ভাঙা-গড়ার পালাবদলে ১৯৬৮ সালে কমরেড দেবেন সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। তিনি এ দলের সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৬৬৮-৬৯ সালে গণআন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সিদ্ধান্তে কাজ শুরু করলে ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই তিনি গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা রাষ্ট্র’ গঠনের প্রবক্তা হিসেবে ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে তার ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ তিনি রাজশাহী জেলের প্রায় ১২৫০ জন কয়েদিকে সংগঠিত করে ‘রাজশাহী জেল বিদ্রোহ’ সফল করেন। ১৯৭২ সালে তার নেতৃত্বে বাংলাদশ মজদুর পার্টি গঠিত হয়। তারপর বিপ্লবীদের ঐক্যের স্বার্থে বাংলাদেশের মজদুর পার্টি ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল.) এক পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। নব গঠিত পার্টির নাম হয়- বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল)। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কমিউনিস্টদের বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। অবশেষে ১৯৯৪ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তার মৃত্যুর পর তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য গঠিত হয় ‘কমরেড দেবেন সিকদার কেন্দ্রীয় স্মৃতি পরিষদ’। তার লেখা অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ‘বাংলাদেশে কমিউনিস্ট বিভ্রান্তি ও কমিউনিস্ট ঐক্য প্রসঙ্গে’,  ‘কমিউনিস্ট জাহাজগুলি জলে ভাসাবেন কারা’, ‘গল্প নয় ঘটনা’, ‘রাজনীতি কি ও কেন?’, ‘সমাজতন্ত্র কি ও কে?’, ‘জ্ঞানের উৎসাহ,’ ‘দ্বৈত শোষণের যাঁতাকলে বাংলার আখচাষী তথা কৃষক সমাজ‘, ‘বাংলার কৃষক আন্দোলন ও মাওলানা ভাসানী’, ‘হাতির ধর্মঘট’, ‘গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর ২২ বছরের গোপন জীবন’, ‘মহাআড়ম্বরে দূর্গা উৎসব’ প্রভৃতি।

কমরেড দেবেন সিকদারের ১৮তম মৃত্যু বার্ষিকী পালন উপলক্ষে সোমবার বিকেল ৩টায় ‘কমরেড দেবেন সিকদার স্মৃতি পরিষদ’ নাটোরের লালপুর উপজেলার বরমহাটি হাইস্কুল মাঠে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

রাজনীতি এর সর্বশেষ