সিলেট: সিলেটের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার উদ্যোগ যেন কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। পাহাড়-টিলা কেটে সাবাড় করে যেমন পরিবেশের বারোটা বাজানো হচ্ছে, তেমনি নদী সুরমার দূষণ রোধেও নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ।
প্রতিনিয়ত পরিবেশ অধিদপ্তরের নাকের ডগায় অবাধে চলছে পাহাড়-টিলা নিধন। এরই মধ্যে জেলার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পাহাড়-টিলা কেটে সাবাড় করা হয়েছে। আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পাহাড়-টিলা কাটতে একাধিক চক্র সক্রিয় রয়েছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিবেশ বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করবে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।
প্রভাবশালীরা এসব পাহাড়-টিলা কেটে প্লট ও কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ঘেঁষা ওইসব কলোনিসহ বাসা বাড়িতে সহস্রাধিক মানুষের বসবাস। বর্ষায় এসব এলাকায় চট্টগ্রামের মতো পাহাড় ধসে বড় ধরনের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না পরিবেশবিদরা। অথচ পরিবেশ দিবসে সচেতনতার ডামাঢোল পিটিয়ে রাজপথে ৠালি বের করাই যেন গুরুদায়িত্ব পরিবেশ অধিদফতর কর্মকর্তাদের।
বাংলাদেশ পবিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট শাহ শাহিদা আক্তার উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলানিউজকে জানান, পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে আদালতের নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না। এ আইন বাস্তবায়নকারীদেরও কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সিলেটের ৬টি উপজেলায় পাহাড়-টিলা কাটার ব্যাপারে উচ্চ আদালতে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে স্থিতাবস্থা জারি করা হয়। পাশাপাশি পাহাড়-টিলা সংরক্ষণ ও দুর্ঘটনা এড়াতে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বাংলানিউজকে বলেন, শুধু পাহাড়-টিলা কেটেই নয়, নদী দূষণ করেও পরিবেশের বারোটা বাজানো হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার মতো এখন সুরমার পানিও দূষিত হচ্ছে। সুয়ারেজ লাইন দিয়ে ময়লা-আবর্জনা গিয়ে পড়ছে সুরমায়। অথচ নদীর উপরে ব্রিজের সৌন্দর্য বর্ধনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে আলোকসজ্জা করা হচ্ছে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিলা কেটে ভবন নির্মাণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের কর্তারাও পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন। তাহলে ব্যক্তি পর্যায়ে কীভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।
তিনি আরও বলেন, সিলেট নগরীর বালুচরে ওঁরাও নৃ-গোষ্ঠীর ভূমি কৌশলে দখলে নিয়ে টিলা কাটাচ্ছেন সদর উপজেলার টুলটিকর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মছব্বির। একইভাবে সরকারি পাহাড়-টিলা বন্দোবস্ত নিয়ে আরেক দুষ্টচক্র চা বাগান মালিকরাও টিলা কাটাচ্ছেন। তারা ইচ্ছে করলে সিলেটে প্রকৃতিবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে পারেন।
ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, শুধু সিলেটের সদর উপজেলায় ১শ’ ৯৯টি পাহাড়-টিলার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কাটা হয়েছে। জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ৪শ’ ১৩টি পাহাড়-টিলার এক তৃতীয়াংশ এর মধ্যেই কাটা হয়ে গেছে। পরিবেশবিরোধী এমন তৎপরতার বিরুদ্ধে বেলার পক্ষে লিগ্যাল নোটিশও প্রদান করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবাসিক প্রকল্প তৈরি ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাটি বিক্রির উদ্দেশ্যেই সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটা হচ্ছে। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার প্রকাশ্যে দিনের বেলায় টিলা কাটা হয়। নগরীর আশপাশের এলাকার মধ্যে বালুচর, আরামবাগ, খাদিম, আখালিয়া, বড়শালা, লালবাগ, ছালিয়া, বাগবাড়ি, টিবি গেইট, মেজরটিলা, কুমরাগাঁও, ব্রাহ্মণশাসন, তারাপুর, কালাগুল, খাদিমপাড়া, শাহপরাণ এলাকায় অবাধে টিলা কাটা মহোৎসব চলছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বালুচরের আরামবাগে অবাধে টিলা কেটে আবাসিক প্লট তৈরি করা হচ্ছে। অনেক টিলা অর্ধেক কেটে ফেলে রাখা হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, সুযোগ বুঝে এসব টিলার বাকি অংশও কাটা হবে। ঠিকাদাররা মাটি কেটে ট্রাক দিয়ে অন্যত্র নিয়ে যায়।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে টিলা কাটা বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত পরিবেশ অধিদফতরের সিলেটের কর্মকর্তারা। আঞ্চলিক পরিচালক সালাহ উদ্দিন অবস্থান করছেন ঢাকায়। তার অবর্তমানে পরিদর্শক পারভেজ আহমদ বাংলানিউজকে জানান, টিলা কাটার অভিযোগে তারা শতাধিক মামলা করেছেন। তবে লোকবলের অভাবে অনেক সময় অভিযান চালাতে পারেন না।
তাছাড়া পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কত লোকের বসবাস। এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য তিনি দিতে পারেন নি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, ০৫ জুন, ২০১৪