শ্রীমঙ্গল: এখন আর রাতের আঁধারে নয়, লাউয়াছড়া বনে দিনে-দুপুরেই চলছে গাছ চুরি! অর্থের বিনিময়ে বন কর্তৃপক্ষ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে লাউয়াছড়া, কালাপুর ও চাউতলি বিট থেকে একের পর এক প্রাচীন গাছ কেটে উজাড় করা হচ্ছে মহামূল্যবান বৃক্ষসম্পদ।
বিশালায়তনের এ সব বৃক্ষরাজি কেটে ফেলার ফলে পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন উল্লুকসহ বিভিন্ন গাছনির্ভর প্রাণীদের চলাচল ও খাদ্যগ্রহণে তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাছচোরদের দিয়ে চলছে বনের পাহারা! সত্যিই এটি বড়ই আশ্চর্য পদ্ধতি! তবে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার- চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী! গাছচোরদের সংশোধন করতে তাদের সঠিক কর্মসংস্থানের ঠিকানায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা করা হলেও কার্যত এর ফলাফল শূন্য। বরং বন পাহারায় এসে এর সঠিক ব্যবহার করছে তারা। অর্থাৎ, সংঘবদ্ধ গাছচোর সিন্ডিকেট দলের ওই সব সদস্য এ সুযোগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উজাড় করছে মহামূল্যবান বৃক্ষসম্পদ।
লাউয়াছড়া, কালাপুর ও চাউতলি বিট থেকে প্রতি রাতেই প্রাচীন বৃক্ষনিধনের ঘটনা ঘটছে। বনের চারপাশের জনপদের বিতর্কিত অধিবাসী অর্থাৎ, চোর দিয়ে বনরক্ষার চেয়ে বনের ক্ষতিই সাধিত হয়েছে বেশি।
সরেজমিন শনিবার (০১ নভেম্বর) দুপুরে লাউয়াছড়া বিটের উঁচু-নিচু টিলার আটটি স্থান ঘুরে বড় বড় গাছের মোথা (নিচের অংশ) পাওয়া গেল। এগুলো সব আওয়াল কাঠ। এদের একেকটির বয়স পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছর। যা গত দু’তিন আগে কাটা হয়েছে। এছাড়াও ফেলে রাখা হয়েছে তিনটি গাছ কেটে। এর মধ্যে দু’টি আওয়াল ও একটা আগর। এগুলো গাছচোররা নিয়ে যেতে পারেনি। নতুন ব্রিজের পাশ থেকে বিশালাকৃত্রির দু’টি সেগুনগাছ ২৯ নভেম্বর কাটা হয়েছে। শনিবার বিকেলেই গাছচোররা জানকিছড়া এলাকা থেকে থেকে আরও একটি সেগুন গাছ কেটে ফেলে।
সম্প্রতি লাউয়াছড়া বিট অফিসার মাহমুদুর রহমান দায়িত্বগ্রহণ ও স্থানীয় গাছচোরচক্রের ৫ সদস্যকে কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপের (সিপিজি) সদস্য হিসেবে অনুমতি দেওয়ার পর থেকে ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে বৃক্ষনিধন। মাসখানেক আগে লাউয়াছড়ার সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) মহসিন, সুফি, ফজর, সোহেল ও করিম হোসেন নামের পাঁচজনকে সিপিজি’র সদস্য হিসেবে অনুমতি দেয়। এই পাঁচজনের মধ্যে করিম হোসেন ব্যতীত সবাই চিহ্নিত গাছচোরচক্র ও পাচারকারী দলের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক বন মামলা রয়েছে বলে মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণি রেঞ্জ সূত্রে জানা যায়।
গাছচোর সিন্ডিকেট দলের সদস্য শহিদ, সিপিজি সদস্য বাবুল ও বনবিভাগের প্রহরী শাহিনের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে হাত করে সরাসরি গাছ পাচার করে থাকে। এছাড়াও অপর গাছচোর সিন্ডিকেট দলের সদস্য ফজরের সঙ্গে সরাসরি যোগসাজশ রয়েছে সিপিজি গ্রুপের সভাপতি তোয়াব আলীর।
তিনি ফজরকে গাছ পাচারে সহায়তা করেন বলেও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। এছাড়াও লাউয়াছড়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে তিনটি ফুট ট্রেইল (পায়ে হাঁটা পথ) যথাক্রমে আধঘণ্টা, একঘণ্টা ও তিনঘণ্টা থাকলেও তিনঘণ্টার ফুট ট্রেইলে যেতে কর্তৃপক্ষের নিষেধজ্ঞা জারি রয়েছে। এই পথের দু’পাশের সব গাছপালা আগেই কেটে ফেলে হয়েছে। বৃক্ষশূন্য দৃশ্য ধরা পড়ার ভয়ে কর্তৃপক্ষের এ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান স্থানীয় ট্যুর গাইডরা।
লাউয়াছড়ায় বন বিভাগের পাশাপাশি বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত ক্রেল। ক্রেল প্রজেক্ট কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলামের কাছে প্রশ্ন ছিল চোর দিয়ে বনরক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আগে আইপ্যাক-নিসর্গ প্রকল্পের আওতায় অবশ্য এমন একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে এটি সংশোধিত হয়েছে।
এখন কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপের (সিপিজি) সদস্যদের প্রথমে কিছুদিন পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। অপরাধের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সিএমসি মাসিকসভার সিদ্ধান্তক্রমে তাদের বাদ দেওয়া হয়।
লাউয়াছড়া বিট অফিসার মাহমুদুর রহমান সম্প্রতি গাছচুরি বেড়ে যাওয়ার কথা সমর্থন জানিয়ে বলেন, গতকাল রাতেও গাছচোরদের বাধা দিতে আমি দু’রাউন্ড গুলি ছুড়েছি। জনবল সংকটও প্রধান সমস্যা। আগে আমাদের বনপ্রহরী ছিল চৌদ্দ জন, এখন রয়েছে মাত্র ছয়জন। গত বছর ২১ আগস্ট গাছচোররা আমাকেও কুপিয়েছে।
সিলেট বিভাগীয় বন কমকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষক বিভাগ) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, গাছচুরিসহ বিতর্কিত সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্তক্রমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান বলেন, আমাদের লাউয়াছড়া সমৃদ্ধ একটি সংরক্ষিত বন। এভাবে গাছকাটার বিষয়টি আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি অবশ্যই আমি গুরুত্বসহকারে দেখবো।
বাংলাদেশ সময়:০৮৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৪, ২০১৪